বর্তমান দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের একটি অঞ্চলের নাম মনোহরপুকুর। এখানে একটি রাস্তা আছে যেটার নাম বর্তমানে দেশপ্রিয় পার্ক রোড, অতীতে রাস্তাটির নাম ছিল মনোহর পুকুর রোড, পরে রাস্তাটির নাম বদল হয়। কিন্তু অঞ্চলটির নাম আজও একই রয়ে গেছে। এবারে প্রশ্ন হল এই অঞ্চল আর সাবেক রাস্তার নামটি কার নামে? নাম শুনে অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে যে এটি মনোহর বলে কোনও ব্যক্তির নামে। কিন্তু মনোহর কে ছিলেন? আমরা সচরাচর কলকাতার যে সকল রাস্তা-গলি দেখতে পাই, সেগুলোর সবেরই নাম কোনও না কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির নামে। হয় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী, নয় কোনও বৈজ্ঞানিক বা কোনও না কোনও বিষয়ের সাথে জড়িত কোনও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এই ‘মনোহর’ এর মধ্যে কোনোটাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ডাকাত। ডাকাত মনোহর বাগদী। তাঁর সম্বন্ধে আর তাঁর কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হলে আমাদের তাকাতে হবে সুদূর অতীতে।
আজ আমরা দক্ষিণ কলকাতা কে যে রূপে দেখি, প্রায় দু’শো বছর আগে সেই চেহারা ছিল না। সময়টা খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। পলাশীর যুদ্ধ শেষ হবার পরবর্তী সময় সেটা। তখন দক্ষিণ কলকাতা বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। কালীঘাট অঞ্চলের ওই দিকটা ছিল ঘন বন-জঙ্গল, খালবিল, জলা, হোগলা বন। লতাগুল্মে আর কাঁটাবনে চারিদিক আবৃত্ত ছিল। পথ-ঘাট ছিল না, লোকবসতি ছিল বিরল। ছোট খালগুলো দিয়ে ছোট সলতি নৌকা চলত। তাতে করে লোকে সুন্দরবনে যেত মধু সংগ্রহ করতে, কাঠ কাটতে ও শিকার করতে। বনের মাঝে সকলের অজানা ও নিরিবিলি স্থানে বাস করত চোর-দস্যু ও ডাকাতের দল। এই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল জেলে, বাগদী, বাউড়ি ও জংলী লোকেরা। কেউ মাছ ধরতে যেত গঙ্গায়, আদি গঙ্গায় ও আশেপাশের ঝিলে বিলে। মনোহর বাগদী এই অঞ্চলের দুর্গম বনের মধ্যে বাস করত। মনোহর ছিল দুর্দান্ত ডাকাত। যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে, তখন পুলিশের এত হাঙ্গামা ছিল না। হওয়ার কথাও নয়। কারণ কোম্পানির আমল ও শাসন, দুটোই তখনও শুরু হয় নি। পলাশীর যুদ্ধের শেষে দেশে চলছিল অরাজকতা, অভাব, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি নানা অশান্তি। সে সময়ে দস্যু ডাকাতদের অত্যাচারে মানুষের প্রাণ বাঁচানো ছিল দায়। একদিকে বন্য জীব-জন্তু তো অন্য দিকে ডাকাত, মানুষের জীবন ছিল সুতোয় ঝোলানো।
মনোহর বাগদী কখনও সন্ধ্যার পরে বা গভীর রাত্রীতে কখনও শহরের বসতির দিকে কিংবা নৌকায় করে নিজের দল নিয়ে ডাকাতি করতে যেত উত্তরপাড়া, চন্দননগর, ত্রিবেণী, নদীয়ার দিকে। তখন ওইসব অঞ্চলের ডুমুরদহ, গুপ্তিপাড়া প্রভৃতি ছিল ডাকাতদের আড্ডা। ডাকাতরা সব একত্রিত হয়ে, বিভিন্ন দলের সর্দাররা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে, কোথায় কোন অঞ্চলে ডাকাতি করলে সুবিধা হবে, সেদিকে ভিন্ন ভিন্ন দল পাঠিয়ে দিত। তাঁদের অদ্ভুত মন্ত্রগুপ্তি আর এমন একটি ব্যবস্থা ছিল যে, লুন্ঠিত মালের খবর বাইরের লোকেরা বিশেষ জানতে পারত না। প্রত্যেক সর্দার নিজ নিজ দলের লোকেদের লুন্ঠিত মাল সমান ভাবে ভাগ করে দিত।
কালীঘাট অঞ্চলের নিবিড় বনের মধ্যে মনোহরের, তা সেটাকে মনোহরের বাড়িই বলা হোক বা আস্তানা, দু’খানা মাটির দেওয়াল ও খড়ের চাল দেওয়া ঘর ছিল। মনোহরের স্ত্রী ছিল না, ছিল এক বুড়ি পিসি – সেই রান্নাবান্না করত, সে ছিল সংসারের কর্ত্রী। তাঁর বাড়ির অদূরে ছিল একটা ছোট্ট ভগ্নপ্রায় কালীমন্দির। তাতে ছিল একটা পাষানী কালীমূর্তি। মূর্তিটি আকারে ছোট হলেও, দেখতে ছিল ভীষণদর্শনা। ডাকাতরা ওই কালীমূর্তির নাম দিয়েছিল ‘কঙ্কালমালিনী’। কোনও অলঙ্কার ছিল না সেই মূর্তির অঙ্গে – দেবী ছিলেন আয়ুধভূষিতা, মুন্ডমালা বিভূষিতা এবং তাঁর হাতে দেওয়া হয়েছিল নরবলি দেওয়া কোনও হতভাগ্যের করোটি। নিত্য পূজিত হতেন সেই দেবী, নিত্য ছাগ-মহিষ বলি দেওয়া হত। কিন্তু পূর্ণিমা আর অমাবস্যা তে হত নরবলি। এরফলে বহু হতভাগা ওই পথে যেতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল।
একবার, এক সন্ধ্যায় কালীঘাটে পূজা দেবার পরে তিনজনের একটা দল ওই পথ দিয়ে ফিরছিল। তাঁদের বাস ছিল রাজপুর নামক গ্রামে। দলে ছিলেন একজন বৃদ্ধ পুরুষ, একজন মহিলা ও তাঁদের সাথে একটি পাঁচ-ছয় বছরের বালক, যাকে শিশুই বলা চলে। তখন অন্ধকার হয়েছে। অন্ধকারে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেন। কিছুদূরে একটা আলো দেখতে পেয়ে ওই তিনজন সেটা লক্ষ্য করে লতাগুল্ম, কাঁটাবন ভেঙ্গে সেদিকে দ্রুত যাচ্ছিলেন। পথে ছিল ছোট একটি খাল – আশেপাশে ছিল ডোবা – খালের গায়ে ছিল গভীর হোগলা বন। সেই হোগলা বনের আড়ালে থেকে একটা বাঘ খালে জল খাচ্ছিল। বৃদ্ধ আগে খাল পার হবার জন্য জলের কিনারায় আসামাত্র বাঘ তাঁকে আক্রমণ করে। মহিলা বৃদ্ধ কে বাঁচাতে গিয়ে বাঘের থাবার আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। শিশুটি ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেলেও ভয়ে মুর্ছিত হয়ে জলে ও কাদায় লুটিয়ে পড়ে। বাঘ বৃদ্ধ কে শিকার করে নিয়ে যায়। সেই পথে গভীর রাত্রে ফিরছিল মনোহর ও তাঁর সঙ্গীরা। মশালের আলোয় তাঁরা মহিলা ও শিশুকে খুঁজে পায়। তাঁদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে এঁরা ‘বড় শেয়াল’ এর শিকার। তখনকার দিনে বাঘ কে লোকে ‘বড় শেয়াল’ বলে আখ্যাও দিত। মনোহরের নির্দেশে তাঁর সঙ্গীরা মহিলা ও শিশুটিকে উদ্ধার করে মনোহরের বাড়িতে নিয়ে আসে। অনেক সেবা-শুশ্রূষা সত্বেও আহত মহিলা কে তাঁরা বাঁচাতে পারে নি। কিন্তু বেঁচে যায় শিশুটি। এবং তাঁকে নিয়ে ঘোর সমস্যায় পড়ে মনোহর। কার ছেলে? – বাড়ি কোথায়? – কে সন্ধান করবে? – সন্ধান নিতে গেলেই যে বিপদ ঘটবে আর একে পালন করবেই বা কে? শেষে মনোহর তাঁর পিসিকে বলল, ‘পিসি ছেলেটাকে দেখ। যত্ন কর। কার ছেলে কিছুই তো জানি না।’ পিসি বলল, ‘কার বাছা নিয়ে শেষটায় বিপদে পড়বি। তার থেকে বরং গলা টিপে মেরে বাদার জঙ্গলে ফেলে দে!’ একথা শুনে মনোহর গর্জে উঠলো, ‘তুই মাইয়া মানুষ হইয়া এমন কথা বলিস! ডাকাত বটি কিন্তু এ হাতে কোন দিন মাইয়া মানুষ আর ছোট ছোট ছাইল্যা মাইয়া মারি নাই। পিসি তুই কি পুতনা রাক্ষসী!’ মনোহরের বিকট রূপ দেখে পিসি চুপ থাকাই ঠিক মনে করল। সেদিন থেকে মনোহর শিশুটিকে আপন করে নিল। তাঁর কাছে সে গল্প করত, তাঁর জন্য ভালো কাপড়-জামা সংগ্রহ করে নিয়ে আসত। দিন যায় – বছর যায়, মনোহরের স্নেহ ক্রমে বেড়েই চললো। সকলেই বেশ অবাক হল। এ কি হল মনোহরের! ডাকাতিতে তাঁর তেমন মন নেই, দলের লোকেদের কথায় সে আর তেমন উল্লাসিত হয় না। দলের লোকেরা মনে করতে লাগল, তবে বুঝি সর্দার আর ডাকাতি করবে না। মাঝেমধ্যে অনুরোধ – উপরোধে পড়ে সে ডাকাতি করতে যেত।
মনোহর ছেলেটির নাম রেখেছিল হারাধন। আর হারাধন মনোহর কে ডাকত বাবা বলে। মনোহর যেদিন ডাকাতি করতে যেত, সেদিন হারাধন তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলত, ‘বাবা তুই কোথায় যাস? যাসনে কোথাও? কখন ফিরবি বাবা? আমার একা ভয় করে।’ মনোহরের হৃদয় গলে যেত। কিন্তু হারাধন কে একেবারেই সহ্য করতে পারত না মনোহরের পিসি। তবে মনোহরের ভয়ে তিনি খারাপ কিছু করতে সাহস পেতেন না। কেন সহ্য করতে পারত না সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। মনোহরের পিসির ভাবনা ছিল যে, যদি মনোহরের কিছু হয় তাহলে তাঁর সম্পত্তি তিনি নিজের এক গরীব দেওর কে দেবেন। কিন্তু হারাধন চলে আসায় সেটা আর হবার জো রইলো না। তবে মনোহরের পিসি বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। তিন দিনের জ্বরে তাঁর হঠাৎ মৃত্যু হয়েছিল। আর এতে হারাধন হয়ে গিয়েছিল একেবারে একা। ক্রমে মনোহরের বয়স বাড়ছিল, গায়ের জোর কমছিল। তাঁর চিন্তা ছিল যে ভবিষ্যতে তাঁর পালিত পুত্র হারাধনের কি হবে? এদিকে হারাধনের পূর্বস্মৃতি কিছুই ছিল না। সে জানত মনোহর তাঁর বাবা। সেই সময়ে ভবানীপুর অঞ্চলে খ্রিস্টান পাদ্রীরা ধীরে ধীরে পাঠশালা খুলছিল। গরীব-দুঃখী ছেলে মেয়েরা সেখানে পড়তে যেত, পাদ্রীরা তাঁদের শিক্ষা দিতেন, খ্ৰীস্টান করতেন, বাইবেল পড়াতেন। মনোহর একদিন হারাধন কে এক খ্রিষ্টান পাদ্রীর পাঠশালায় নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিল। মহা উৎসাহে পাদ্রী তাঁকে ভর্তি নিয়ে নিলেন। হারাধনের নতুন নাম হল ‘হারাধন বিশ্বাস’। দেখা গেল যে হারাধন মেধাবী। সে পাঠশালায় শিক্ষা নিতে শুরু করল। মনোহরের কাছে এসে সে বলত, ‘বাবা, সর্বদা সত্য কথা বলতে হয়। চুরি-ডাকাতি করতে নেই, সৎপথে চলতে হয়।’
ততদিনে মনোহরের মাথার চুলগুলো পেকে কাশফুলের মতন সাদা হয়ে গিয়েছিল। সে বিশেষ চলতে-ফিরতে পারত না। এদিকে দেশে কোম্পানি আমল শুরু হয়ে গিয়েছিল। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি কমে আসছিল। নতুন নতুন ফাঁড়ি-থানার সৃষ্টি হচ্ছিল, চারিদিকে ছিল আইনের কড়া নজর। মনোহরের ডাকাত দল ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন সে ছেলেকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারত না। এইভাবে দিন চলে যাচ্ছিল। ক্রমে মনোহরের শেষের দিন ঘনিয়ে এল। তাঁর মনে জাগছিল অনুতাপ। কিন্তু মনোহর ছিল বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ, সে তাঁর পূর্বজীবনের কথা গোপন করেছিল হারাধনের কাছে – পাছে তাঁর অতীত জেনে হারাধন তাঁকে ঘৃণা করতে শুরু করে। শেষ জীবনে সে চাষবাস করে, লোকজন খাটিয়ে চাষীরূপে জীবন কাটাত। হারাধন তাঁকে প্রফুল্ল চিত্তে সাহায্য করত। অবশেষে একদিন মনোহর জ্বরে পড়ল। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলল। সেই অবস্থায় সে হারাধন কে ঘরের এক জায়গার মাটি খুঁড়তে নির্দেশ দিল। হারাধন সেই স্থানের মাটি খুঁড়ে পেল তিন ঘড়া টাকা-মোহর আর অনেক সোনা-রূপার অলঙ্কার। মনোহর হারাধন কে বলল, ‘আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। এসব তোর। আমি মরলে খুব ঘটা করে শ্রাদ্ধ করবি, গরীব-দুঃখীদের খাওয়াবি। কয়েকটা দীঘি-পুকুর কাটিয়ে দিবি, এদিকে গরমকালে জলের খুব কষ্ট, মানুষ-গরু-মোষ কেউই গরমকালে জল পায় না। ভাল ঘর-বাড়ি করে সুখে বাস করবি। বড় ইচ্ছা ছিল তোকে একটা সুন্দরী মেয়ে এনে বিয়ে দি, সে আর হল না। সে সুখ আমার নেই!’
কিছুদিনের মধ্যেই মনোহর ডাকাতের জীবন দীপ নিভে গেল। কিন্তু তাঁর নাম অমর রয়ে গেল তাঁর পালিত পুত্রের হাত ধরে। হারাধন মনোহরের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। আজও দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে যে সব প্রাচীন দীঘি-পুকুর দেখা যায় সেগুলোর বেশিরভাগ হারাধন খনন করিয়েছিল তাঁর পিতা মনোহর ডাকাতের স্মৃতি ও শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য। আজ মনোহর নেই, হারাধন নেই, কিন্তু তাঁদের স্মৃতিকে এই শহর আঁকড়ে রয়েছে। সেই স্মৃতিতে রয়েছে এক ডাকাত পিতা আর তাঁর পালিত পুত্রের জীবনের গল্প। আজও কালীঘাট অঞ্চলে রয়ে গেছে মনোহরপুকুর রোড আর মনোহরপুকুর নামে অঞ্চলটি।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলার ডাকাত, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান (২০১২)।
২- বাংলার ডাকাত, ধীরেন্দ্রলাল ধর, দে’জ পাবলিশিং (২০১৭)।
৩- বাংলার ডাকাত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত