মাসখানেক আগেই হিন্দী দিবসের দিন ‘এক দেশ, এক ভাষা’র পক্ষে সওয়াল করে হিন্দী ভাষাকে দেশের সাধারণ ভাষা করার নিদান দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তারপর থেকেই যেন হিন্দি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে গেরুয়া শিবির। অবস্থা এমনই যে খোদ বাংলাতেই অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হতে পারে মাতৃভাষা বাংলাকে। তবে ‘মোদের গরব, মোদের আশা’কে বাঁচাতে এবার শহরে আবির্ভাব ঘটেছে একাধিক ফ্লেক্সের। যাতে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে— বাংলা ভাষা বিপন্ন। তাই এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে।
মূলত সাদা এবং মেরুন রঙে ছাপানো ফ্লেক্স। একই মাপ, একই রকম নকশা। তাতে লেখা ‘পরাঠা থেকে পরোটা ভাল’। বা ‘সওরভ থেকে সৌরভ ভাল’। বা ‘বঙ্গাল থেকে বাংলা ভাল’। বা ‘স্বচ্ছ্ ভারত থেকে পরিচ্ছন্ন ভারত ভাল’। গোটা কলকাতা তো বটেই, শহরের উত্তর এবং দক্ষিণের বিস্তীর্ণ শহরতলিও ছেয়ে গিয়েছে এই সব ফ্লেক্সে। কারা ছাপালেন? ফ্লেক্সগুলোয় কোনও সুলুক-সন্ধান নেই। শুধু ফ্লেক্সের নীচের দিকে লেখা হয়েছে, ‘ভালো ভাষা’ এবং ‘নিজের ভাষা নিজের থাক’।
শোনা যাচ্ছে, এর পিছনে রয়েছে ‘বাংলা পক্ষ’ নামের এক সংগঠন। যার মাথায় রয়েছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গর্গ চট্টোপাধ্যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যের নানা প্রান্তে সভা, মিছিল, বিক্ষোভ-সহ নানা কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠন। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি এ রাজ্যে বিপন্ন— গর্গর অধিকাংশ ভাষণের মূল কথা এই রকমই। বিভিন্ন সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলেও প্যানেলিস্ট হিসেবে কথা বলতে দেখা যায় তাঁকে। সেখানেও বাংলার ভাষা-সংস্কৃতি নিয়েই কথা বলেন তিনি।
এই সব ফ্লেক্স ছাপানো এবং ছড়ানোর পিছনে তিনি বা তাঁর ‘বাংলা পক্ষ’ রয়েছে কি? এ নিয়ে গর্গ অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে এই অভিনব প্রচারাভিযানের বিষয়বস্তুকে পুরোপুরি সমর্থন করে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষাকে যে ভাবে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে, তাতে এই ধরনের প্রচারাভিযান এখন খুব জরুরি।’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘বাজার, জমি, চাকরি— সব কিছু অবাঙালিদের দখলে চলে যাচ্ছে। পুঁজি তাদের হাতে। মনে রাখবেন, পুঁজি এবং আধিপত্য যাঁদের হাতে, তাঁদেরকেই অন্যরা অনুকরণ করতে চান। সৌরভ না বলে অনেক বাঙালি আজকাল সওরভ বলেন বা পরোটা না বলে পরাঠা বলেন।’
রাজ্যে বাংলা ভাষা এবং বাঙালির বিপন্নতা নিয়ে প্রচার এই প্রথম বার দেখা যাচ্ছে, তা নয়। আশির দশকের শেষ দিকে বা নব্বইয়ের দশকে ভাষা নিয়ে বেশ হইচই হয়েছে। বাঙালি সুশীল সমাজের খুব বড় বড় এবং প্রভাবশালী নাম সেই সব আন্দোলনে এক সময়ে শামিল হয়েছেন। সব দোকানে বাংলায় লেখা হোর্ডিং বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা হয়েছে। ইংরেজি বা হিন্দিতে লেখা হোর্ডিঙে কালি লেপে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গোটা বাংলা জুড়ে সেই আন্দোলন ঝড় তুলে দিতে পারেনি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তখন বাংলা ভাষাকে নিয়ে যা কিছু হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ ছিল না। কিন্তু এবার যা হচ্ছে, তাতে রাজনীতির ইন্ধন রয়েছে। তাই জল অনেক দূর গড়াতে পারে।