বর্তমান সময়ে হাওড়া-তারকেশ্বর রেলপথে হাওড়া থেকে সিঙ্গুর দ্বাদশ রেলস্টেশন। শেওড়াফুলি থেকে তৃতীয় স্টেশন। রেলপথে হাওড়া থেকে দূরত্ব প্রায় তেত্রিশ কিলোমিটার। খ্রিস্টীয় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত হুগলি জেলার অনেক স্থানের পথ-ঘাট ছিল দুর্গম ও জনাকীর্ণ। সিঙ্গুর হুগলি জেলার এক প্রাচীনতম পল্লী। প্রাচীনকালে সিঙ্গুর সরস্বতী নদী তীরে মহারাজা সিংহবাহুর রাজধানী সিংহপুর বলে প্রসিদ্ধ ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে মহারাজ সিংহবাহু সিংহপুরে রাজত্ব করতেন। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বিজয়সিংহ পিতার অবাধ্য হওয়ায় পিতা কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে সাতশত যুদ্ধকুশল অনুচর নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করেন এবং তাম্রপর্ণি দ্বীপে অবতরণ করে সেখানকার অধিবাসীদের পরাস্ত করে লঙ্কাদ্বীপ অধিকার করেন। তিনি তাম্রপর্ণি বা লঙ্কাদ্বীপ অধিকার করে সেখানকার রাজকন্যাকে বিবাহ করেন এবং সেখানকার রাজা হন। রাজা হওয়ার পর তিনি ওই দ্বীপের নাম রাখেন সিংহল।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন সিঙ্গুরে ছিল নিবিড় জঙ্গল, পথঘাট বিশেষ ছিল না। পথ চলতে চলতে পরিত্যক্ত বাস্তুভিটা নজরে পড়ত। এছাড়াও ছিল পানা পরিপূর্ণ ডোবা এবং বড় বড় পুকুর। গ্রামে যেসব লোকজন দেখতে পাওয়া যেত, তাঁরা বেশিরভাগই ম্যালেরিয়া রোগে প্রপীড়িত ছিল। গ্রামবাসীরা ছিল অতি দীন-দরিদ্র, অন্নাভাবে জীর্ণ-শীর্ণ। গ্রামগুলোর অবস্থা ছিল অতীব শোচনীয়। গ্রামে যারা ধনী ঘরের সন্তান ছিলেন, তাঁরা সিঙ্গুর ছেড়ে শহরবাসী হয়েছিলেন। সিঙ্গুরের প্রসিদ্ধ মন্দির হল, ডাকাত কালী মন্দির। এটি একটি ঐতিহাসিক মন্দিরও বটে। এই মন্দিরের সাথে জড়িত রয়েছে অজস্র কিংবদন্তি ও ঘটনা। তবে বর্তমানে এই মন্দির ও তার আশেপাশের যে পরিবেশ দেখা যায়, অতীতে সেটা ছিল না। বরং বলা চলে ভয়ানক গা-ছমছমে পরিবেশ ছিল। ১৩৯৯ বঙ্গাব্দে, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর লিখিত ‘বাংলার ডাকাত’ বইতে তখনকার সময়ের সিঙ্গুরের ডাকাত কালী মন্দির ও তার পরিবেশের বর্ণনা করেছেন, নিম্নরূপে –
“সিঙ্গুরের পথ বনে জঙ্গলে পরিপূর্ণ। শীর্ণ সংকীর্ণ সর্পিল পথ। চৈত্রমাস। শুষ্ক পথের পাশে স্থানে স্থানে জঙ্গল ঘেরা ডোবা। অতি কষ্টে মন্দিরের কাছে আসিলাম। ডাকাত কালীর মন্দির ভগ্ন ও জীর্ণ। ইঁট খসিয়া পড়িতেছে। এদিক-ওদিকে সাপ ছোটাছুটি করিতেছে। দিনের বেলায়ও অন্ধকার। মন্দিরে ভীষণাকৃতি কালীমূর্তি। ভিতরে আবর্জনাপূর্ন। … একপাশে একটি বড় হাড়িকাঠ ভূমিতে পড়িয়া আছে। চারিদিকে পরিত্যক্ত বাস্তুভিটা জঙ্গলাকীর্ন। আমি ডাকাত কালীকে দেখিতে আসিয়া ভয়ে ও বিস্ময়ে শিহরিয়া উঠিলাম। মন্দিরের গায়ে আগাছা জন্মিয়াছে। বট, অশ্বত্থ, দেবদারু গজাইয়াছে। নানা আগাছায় পূর্ণ – ভয়াল স্থান। দিনের বেলায়ও ভয় করে।”
বহু পূর্বে ডাকাতির জন্য এই অঞ্চল প্রসিদ্ধ ছিল এবং এই স্থানের ডাকাত-কালীর নিকট প্রতি অমাবস্যায় নরবলি দেওয়া হত। সেকালে সিঙ্গুরের ডাকাত কালীমন্দিরের ঠিক পশ্চিম দিকে একটা বড় বাস্তুভিটা দেখা যেত, সেটা ছিল খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের শেষের দিকের কুখ্যাত ডাকাত সনাতন বাগদীর বাড়ি। সেই সময়ে তারকেশ্বর ও আশেপাশের অঞ্চলের লোকজন ডাকাত সনাতন বাগদীর নাম শুনলে আতঙ্কে আর ভয়ে কাঁপত। তারকেশ্বরে তীর্থ করতে যাওয়া কত নিরীহ মানুষ কে সে তাঁর নিজের বাড়িতে এনে তারপরে কালীবাড়ি তে নিয়ে এসে হত্যা করেছে সে হিসাব ইতিহাস রাখে নি। তবে এটা জানা যায় যে তাঁর দল ছিল অনেক বড়। নানা স্থানে তাঁরা ডাকাতি করে বেড়াত। হুগলি জেলার বিভিন্ন পল্লী অঞ্চল, ত্রিবেণী অঞ্চল, গঙ্গার তীরবর্তী ও দূরবর্তী পল্লী এবং বন্দরে তাঁদের অবাধ গতি ছিল।
সিঙ্গুরের ডাকাত কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠা কার হাতে সেটা ইরিহাসে পাওয়া যায় না। তবে ডাকাত সনাতন বাগদীর এই মন্দিরে কালী কে পূজা করত এবং সেই ছিল এই মন্দির আবার নতুন করে গড়ে ওঠার আগের শেষ পূজারী সেটা ইতিহাসে লিখিত আছে। ডাকাত সনাতন বাগদীর জন্যই এই মন্দিরে একদা পূজা বন্ধ হয়ে যায় ও মন্দিরটি দীর্ঘকালের জন্য পরিত্যক্ত হয়ে যায়, সেটার স্বাক্ষ দেয় ইতিহাসের একটি ঘটনা।
একদিন সনাতন বাগদী ডাকাতি করতে বের হবে। নিশীথে মায়ের পূজা হবে। নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে দেবী কালী। নানা পূজার উপাচারে মন্দির সুসজ্জিত। দীর্ঘ উচ্চ দীপাধারে প্রদীপ জ্বলছে। ডাকাতরা কেউ বাইরে তো কেউ মন্দিরে বসে রয়েছে। সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সজ্জিত এবং সুরাপনে মত্ত। নির্জন নিস্তব্ধ ঐ অরণ্যে ডাকাত ভিন্ন অন্য কেউই রাত্রে আসতে সাহস পেত না। হঠাৎ সনাতন উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘বলি কোথায়?’ ডাকতরা বলল, ‘সংগ্রহ হয় নি। কোথায় মিলবে বলি!’ সনাতন বলল, ‘সে কী! মা আজ অনাহারে থাকবেন? রক্ত পাবেন না?’ ডাকাতরা বলল, ‘চৈত্র মাস! ঝড় বৃষ্টি লেগেই আছে! সব ওলট-পালট করে দিচ্ছে। ঘর থেকে বের হতে পারেনি কেউ, কোথায় জুটবে শিকার! আমাদের লুটের মাল দিলে না – আজ কাল করে!’ সর্দার এই শুনে গর্জে উঠে বলল, ‘সে হবে না! শ্যামা মা অভুক্ত থাকবেন – যে ভাবে পারিস বলি আন।’ অন্য ডাকাতরা বলে উঠল, ‘তুমি আন না সর্দার। তুমি যাও’, এই বলে তাঁরা রেগে উঠে দাঁড়ালো। এতে যেন সনাতন বাগদীর রাগের আগুনে ঘৃতহুতি পড়লো। সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘কি! আমার ওপরে এত বড় কথা! তোদের সব কয়টাকে আজ মায়ের পায়ে বলি দেব।’ এরপরে সে উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে, মুখে বিকট শব্দ করে তাঁর নিজের দলের লোকেদের ওপরে চড়াও হল। সেদিন ছিল তুমুল ঝড়-জলের রাত। সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল। ডাকাতরাও বিভ্রান্ত হয়ে, ‘ভাগের টাকা দেবে না! আবার চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখাবে! কোনও কথা শুনবো না। আগে টাকা দে!’, বলে সর্দারের ওপরে পাল্টা চড়াও হয়ে বসলো। যাঁরা সর্দারের অনুগত ছিল তাঁরা তাঁর পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহী ডাকাতদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হল। দেখতে দেখতে সনাতন বাগদীর ডাকাত দলের নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি আরম্ভ হয়ে গেল। সেই সময় গ্রামের অপর প্রান্ত দিয়ে আরেক দল তীর্থযাত্রী তারকেশ্বরের দিকে যাচ্ছিল পূজা দিতে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও তাঁরা মশাল জ্বালিয়ে চলছিল। ওই দলে কেবলমাত্র সাধারণ দীন-দরিদ্র মানুষ ছিল না, ছিল চন্দননগর-ভদ্রেশ্বর-শেওড়াফুলি ও অন্যান্য স্থানের অবস্থাসম্পন্ন যাত্রীরা। তাঁদের সাথে ছিল জমিদার বাড়ির লোকজন, লাঠিয়াল ও সর্দার। তাঁরা মন্দিরের কাছাকাছি এসে দেখতে পেল যে ডাকাতরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। ডাকাতদেরও তাঁদের ওপরে নজর পড়েছিল। সনাতন তাঁর দলের বাকিদের যাত্রীদের দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখ মা তাঁর শিকার পাঠিয়ে দিয়েছেন! মা তাঁর বলি নিজে নিয়ে এসেছেন। জয় মা! চল চল, আজ মায়ের গলায় নরশিরের মালা দোলাব। জয় মা কালী! হা-রে-রে!’ বলে সে যাত্রীদলের দিকে তেড়ে গেল। বাকি ডাকাতরা কেউ সনাতনের কথা শুনলো, কেউ শুনলো না। যাত্রীরা গাজন উৎসব উপলক্ষে তারকেশ্বর যাচ্ছিল, দলে প্রচুর নারীও ছিল। যাত্রীদলের সঙ্গে থাকা লাঠিয়াল-সর্দাররা ডাকাতদের পাল্টা আক্রমণ করল। শুরু হয়ে গেল ভীষণ লড়াই। অন্ধকার ঝড়-জলের রাত্রে যাত্রীদলের সাথে ডাকাত দলের এই ভীষণ লড়াই তে ডাকাতরা হেরে গেল। সংঘর্ষে যাত্রী সমেত অনেক ডাকাত মারা পড়ল, অনেকে আহত হল, অনেক ডাকাত পালিয়ে প্রাণে বাঁচলো। কুখ্যাত ডাকাত সনাতন বাগদীর এই লড়াইতে মন্দিরের সামনেই নিহত হয়। মন্দিরের দরজার সামনেই তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। পরের দিন সকালে সংবাদ পেয়ে আশেপাশের পল্লীর লোকেরা এসে দেখেছিল, মন্দির চত্বর আর তার আশেপাশে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। কালীবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত। মা কালী ভূ-পাতিতা। এই ভয়ানক ঘটনার পর থেকে দীর্ঘদিন সিঙ্গুরের ডাকাত কালীবাড়ি পরিত্যক্ত ছিল। ভীষণ অরণ্যের মধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে একটি পুষ্করিণীর তীরে নিকটবর্তী শ্মশানের কাছে ছিল এই কালীমন্দির – ভগ্ন, জীর্ণ ও উপেক্ষিত।
এরপরে এই মন্দিরে কিরূপে পুনরায় পূজা চালু হয়, মন্দির সংস্কার হয় ও কে এগুলো করেন তার উল্লেখ ইতিহাসের পাতায় নেই। তবে ডাকাত সনাতন বাগদীর পরেও যে এই অঞ্চলে ডাকাতের উপদ্রব ছিল তার উল্লেখ ইতিহাসের পাতায় রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে এই অঞ্চলে ডাকাত গগন সর্দারের দাপট ছিল। কথিত আছে, মা সারদা একবার অসুস্থ রামকৃষ্ণদেবকে দেখতে কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বর যাচ্ছিলেন। পথে ডাকাতরা তাঁর পথ আটকে দাঁড়ায়। পরে মায়ের মুখে কালীর মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে ডাকাতরা ক্ষমা চায়। রাত্রি হয়ে যাওয়ায় মা সারদা ডাকাতদের ডেরায় থাকতে বাধ্য হন। রাতে মা সারদাকে খেতে দেওয়া হয় চাল ও কড়াই ভাজা। তাই কালীপুজোর সময় ভোগে অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে চাল ও কড়াই ভাজা দেওয়া হয়। সেই প্রথা এখনও চলে আসছে। তবে ডাকাত গগন সর্দার সম্ভবতঃ সিঙ্গুরের বাসিন্দা ছিলেন না। তবে এই মন্দিরে নিয়মিত পূজা দিতে আসতেন। তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।
বর্তমানে সিঙ্গুরের ডাকাত কালী মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত, দক্ষিণমুখী, আটচালা মন্দির। গর্ভগৃহের সামনে ত্রিখিলান প্রবেশদ্বারযুক্ত অলিন্দ। অলিন্দের সামনে রোয়াক। গর্ভগৃহে ঢোকার একটিই প্রবেশদ্বার। আগে মন্দিরের সামনের দিকে টেরাকোটা অলংকরণে অলংকৃত ছিল। কিন্তু এখন সেই টেরাকোটার সামান্যই অবশিষ্ট আছে। মন্দিরের সামনে চাঁদনি আকৃতির নাটমন্দির আছে। মন্দির চত্বর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কোন প্রতিষ্ঠাফলক না থাকায় মন্দিরটি কবে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা সঠিক ভাবে বলা যায় না। মন্দিরের গঠন, স্থাপত্য, জনশ্রুতি ও ইতিহাস থেকে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে, সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ মন্দিরটি আনুমানিক প্রায় তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন।
মন্দিরের গর্ভগৃহে ভীষণ মূর্তি কালী মা প্রতিষ্ঠিত ও নিত্য পূজিত। ডাকাতরাই এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। পরে স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে বর্তমান সিঙ্গুর থানার চালকেবাটির মোড়লরা এই মন্দির নির্মাণ করে দেন। তাই কালীপুজোর দিন মোড়লদের পুজো আগে হয়।
মন্দিরের বর্তমান সেবায়েতবৃন্দ, স্বর্গীয় কৃষ্ণধন ব্যানার্জীর দুই পুত্র, স্বর্গীয় কালীপদ চট্টোপাধ্যায়ের দুই পুত্র ও স্বর্গীয় শংকরনাথ সিমলাই- এর দুই পুত্র। এঁরাই পালাক্রমে পূজাকার্য সম্পাদন করেন। এ ছাড়া মন্দিরের উন্নয়ণের জন্য আছে “ডাকাতকালী মন্দির উন্নয়ণ কমিটি”। ডাকাত কালী মন্দিরের রাস্তার বিপরীত দিকে একটি শিবমন্দির আছে। শিবমন্দিরটি কালীমন্দিরের পরে প্রতিষ্ঠিত হয়।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলার মন্দির, হিতেশরঞ্জন সান্যাল, কারিগর (২০১২)।
২- তীর্থ ভ্রমণ, যদুনাথ সর্বাধিকারী।
৩- বাংলার ডাকাত, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান (২০১২)।
৪- বাংলার ডাকাত, ধীরেন্দ্রলাল ধর, দে’জ পাবলিশিং (২০১৭)।
৫- বাংলার ডাকাত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত