কলকাতা হল বাঙালিদের হৃদয়। কলকাতা তথা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ইতিহাসের টুকরো। ভারতবর্ষের ইতিহাস বলো কি বিশ্বের ইতিহাস, এই তিলোত্তমাকে ঘিরে আছে স্মৃতির ভান্ডার। বারবার ইতিহাসের অগ্রভাগে থেকেছে এই বাংলা রাজধানী। এইদিন মহানগরীর মুকুটে জুড়ল আরও একটি নোবেলের পালক। অমর্ত্য সেনের পর দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। সংবাদ মাধ্যমে এই খবর প্রচার হতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় উদযাপন শুরু হয়ে যায় বাঙালির। আর প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী অভিজিৎবাবুর হাত ধরেই নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে ষষ্ঠবারের জন্য জুড়ে গেল কলকাতার নাম।
কলকাতার বুকে জন্ম নেওয়া এক ব্রিটিশ নাগরিক ১৯০২ সালে নোবেল পেয়েছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী রোনাল্ড রসের জন্ম উত্তর ভারতের আলমোরায়। ১৮৯৮ সালে গবেষণার জন্য কলকাতায় আসেন তিনি। ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন এই চিকিৎসক। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন ম্যালেরিয়া আসলে মশাবাহিত রোগ এবং তা নিরাময়েরও সন্ধান দেন তিনি। সেই প্রথম কলকাতার সঙ্গে জুড়ে যায় নোবেল পুরস্কারের নাম।
তারপর দ্বিতীয় যে নামটির জন্য কলকাতার সঙ্গে আবারও নোবেলের সম্পর্ক জোড়ে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আপামোর বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত এক নাম। ১৯১৩ সালে প্রথম অইউরোপীয় ও অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গীতাঞ্জলী ইংরাজিতে অনুবাদ করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সন্তান।
তৃতীয় বার কলকাতার নাম নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পিছনে ছিলেন তামিল পদার্থ বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন। ১৯৩০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়েছিলেন এই তিনি। তৎকালীন মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর কলকাতায় চলে আসেন রমন। গবেষণার কাজে যোগ দেন বউবাজারের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের চাকরি শুরু করেন রমন।
চতুর্থ নামটি কলকাতাবাসী না হয়েও কলকাতার হৃদয়ে লিখে রেখে গেছেন তাঁর নাম। তাঁর ভালোবাসার ও শান্তি বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষের মধ্যে। আলবেনিয়ার এই ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি তাঁর গোটা জীবনটাই কাটিয়েছেন কলকাতায়। গরিবগুর্বো মানুষের জন্য সেবা করার যে দিগন্তপ্রসারী কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন টেরেসা সেই জন্য ১৯৭৯ সালে শান্তিতে নোবেল পান তিনি। ১৯৫০ সালে কলকাতায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ শহরেই ছিলেন এই খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর দ্বিতীয় বাঙালি হিসবে নোবেল পুরস্কার পান অমর্ত্য সেন। পাশাপাশি পঞ্চমবারের জন্য নোবেলের সঙ্গে জুড়ে দেন কলকাতার নাম। ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান তিনি। অমর্ত্য সেনের জন্ম শান্তিনিকেতনে। কিন্তু তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় অভিবক্ত বাংলার ঢাকায়। দেশভাগের পর আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে আসে তাঁদের পরিবার। ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। স্নাতক হওয়ার পর শুরু করেন গবেষণা ও অধ্যাপনা। এই কাজের জন্যই ১৯৭২ সাল থেকে অধিকাংশ সময়েই দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে তাঁকে।
অমর্ত্য সেনের নোবেল পাওয়ার ২১ বছর পর ফের কোনও বাঙালি এই পুরস্কার পেলেন এবং সেই অর্থনীতিতেই। অভিজিৎবাবু সাউথ পয়েন্ট স্কুলের পাঠ শেষ করে অর্থনীতি নিয়ে পড়া শুরু করেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারপর দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। অভিজিৎবাবুই কলকাতাকে ষষ্ঠবারের জন্য নোবেল জয়ের স্বাদ দিলেন।
এমনিতে অনেকেই কলকাতাকে আখ্যায়িত করেন মিছিল নগরী বলে। ক্রীড়াপ্রেমীদের অনেকে বলেন ফুটবলের মক্কা। কিন্তু সেই কলকাতাই জুড়ে রয়েছে ছ’জন নোবেলজয়ীর সঙ্গে। কলকাতা স্বমহিমায় আজও বিশ্ব দরবারে সম্মানিত এইসব রথী-মহারথীদের সমারহে। বাংলাবাসীর কাছে আজ আরও একটি গর্বের দিন হয়ে থাকল।