দেবী লক্ষ্মী ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা: উৎপত্তি, ইতিহাস, শাস্ত্র, কোজাগরী শব্দের অর্থ, দেবী লক্ষ্মীর ভেদ, বাঙালির জীবন ও সমাজে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার প্রভাব ও পরিবর্তন –
(ছবিতে- ১৮৯৫ সালে কলকাতার ‘বেঙ্গল আর্ট স্টুডিও’ থেকে প্রকাশিত দেবী লক্ষ্মীর একটি তৈলচিত্রের লিথোগ্রাফিক প্রিন্ট।
ছবি সৌজন্যে: ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ইউনাইটেড কিংডোম)
বাংলায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আরাধনা করা হয়। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে এক চিরন্তন প্রার্থনা। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পুজো হয়ে থাকে। লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পত্তির দেবী। ধন সম্পদের আশায় ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে। নারী পুরুষ উভয়েই এই পুজোয় অংশ গ্রহণ করেন।
অনেকেই সারা বছর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন। এছাড়া শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন পূর্ণিমা ও দীপাবলীতে লক্ষ্মীর পুজো হয়। লক্ষণীয় বিষয় হল-খারিফ শস্য ও রবি শস্য ঠিক যে সময় হয় ঠিক সেই সময় বাঙালি হিন্দু মেতে ওঠে লক্ষ্মীর আরাধনায়। তবে পুজোর উপাচারে পরিবর্তন হয় মাস ভেদে।
বর্তমানে গৃহস্থের সুবিধের জন্যই হোক বা পুরোহিতের স্বল্পতার জন্য, লক্ষ্মী পুজো (বারোমেসে পুজো বাদে) হয় সকাল থেকেই। কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর প্রকৃষ্ট সময় প্রদোষকাল। অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে দু ঘণ্টা পর্যন্ত যে সময়। যদিও প্রদোষ থেকে নিশীথ অবধি তিথি থাকলেও সেই প্রদোষেই পুজো বিহিত। কিন্তু আগেরদিন রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পুজো করা বিধেয়। আবার আগেরদিন রাতে তিথি থাকলেও যদি পরদিন প্রদোষে তিথি না থাকে তাহলে আগেরদিন প্রদোষেই পুজো করা কর্তব্য।
শাস্ত্রমতে শ্রীশ্রী লক্ষ্মী দেবী হলেন ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও সৌভাগ্যের দেবী। প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্মী দেবী ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির রজোগুণের প্রতীক। সত্ত্বগুণ সর্বশ্রেষ্ঠ, রজোগুণ মধ্যম এবং তমোগুণ সব থেকে নিকৃষ্ট। তবে জীবন ধারণের জন্য তিন গুণই আবশ্যক। সংসারী মানুষদের কেবল সত্ত্বগুণ আশ্রয় করলে হয় না, রজোগুণেরও বিশেষ প্রয়োজন। বিষ্ণু রজোগুণের দ্বারা প্রাণিকুলকে পালন করছেন। যে শক্তি দ্বারা বিষ্ণু জগৎকে পালন করছেন সে শক্তিই হলেন লক্ষ্মী দেবী। শক্তি বা প্রকৃতিকে নারী বা পত্নী রূপে কল্পনা করা হয়। সে অর্থে লক্ষ্মী দেবী হলেন বিষ্ণুপত্নী। তৈত্তিরীয় সংহিতায় শ্রী ও লক্ষ্মী দেবী হলেন আদিত্যের স্ত্রী। যেহেতু আদিত্য বা সূর্য ও বিষ্ণু একই দেবতা সেহেতেু লক্ষ্মীকে বিষ্ণু-শক্তি বলা যায়। অহির্বুধণ্য-সংহিতা মতে বিষ্ণুর ইচ্ছাত্মিকা ও ক্রিয়াত্মিকা এই দুই প্রকারের শক্তি রয়েছে। তাঁর ইচ্ছাত্মিকা শক্তিই লক্ষ্মী এবং ক্রিয়াত্মিকা বা সক্রল্প রূপ শক্তিই সুদর্শন। বিষ্ণুপুরাণে বিষ্ণুর যে তিনটি শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তা হল ‘সন্ধিনী’, ‘সংবিৎ’ এবং ‘হ্লাদিনী’। এই ‘হ্লাদিনী’ শক্তিই হলেন লক্ষ্মী দেবী।
লক্ষ্মী দেবীর আর এক নাম ‘শ্রী’। এই ‘শ্রী’ শক্তির উল্লেখ বহু গ্রন্থেই আছে। পরাশর-সংহিতায় যে তিনটি শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তা হল- ‘শ্রী’, ‘ভূ’ (ভূমি) ও ‘লীলা’। ‘জয়াখ্য-সংহিতা’য় ‘লক্ষ্মী’, ‘কীর্তি’, ‘জয়া’ ও ‘মায়া’ এই চার দেবীর উল্লেখ আছে। এখন ‘লক্ষ্মী’ ও ‘শ্রী’ শব্দের অর্থ জানা আবশ্যক। যাঁর দ্বারা লক্ষত হয় অর্থাৎ সকলে যাকে লক্ষ্য করেন বা দর্শন করেন, তিনিই লক্ষ্মী। অর্থাৎ লক্ষ্মী শব্দের অর্থ ‘সৌন্দর্য’। আবার যার দ্বারা সকলে আশ্রিত হয় তিনিই ‘শ্রী’। সেহেতু ধন দ্বারা সকলে আশ্রিত হন বা ধনকে আশ্রয় করে সকলে জীবন ধারণ করেন সেহেতু শ্রী অর্থ ধন। ‘অহির্বুধণ্য-সংহিতা’য় আছে জগৎ রূপে লক্ষ্যমানা বলে তিনি লক্ষ্মী। বৈষ্ণব ভাব আশ্রয় করেন বলে তাকে শ্রী বলা হয়, তাঁর মধ্যে কোন কালভাব বা পুংভাব ব্যক্ত হয় না বলে তিনি ‘পদ্মা’। কামদান করেন বলে তিনি ‘কমলা’, বিষ্ণুর ভাব পালন করেন বলে তিনি ‘বিষ্ণুশক্তি’। রমণ করান বা আনন্দদান করেন বলে তিনি ‘রতি’ বা ‘রমা’। ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলে লক্ষ্মীকে পাওয়া যায় ‘শ্রী দেবী’ হিসেবে। ঋগ্বেদের ‘শ্রী-সূক্তে’ শ্রী বা লক্ষ্মী দেবীর যে রূপ পাওয়া যায় তা হল, ‘দেবী হিরণ্যবর্ণা’ বা ‘স্বর্ণময়ী’। তিনি স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালা ধারণ করেছেন। তিনি ভক্তদের স্বর্ণ, গরু ও অশ্ব দ্বান করেন। দেবীর সামনে অশ্ব, মধ্যে রথ এবং পার্শ্বে হস্তি-নাদের দ্বারা তাঁর বার্তা স্থাপিত হয় অর্থাৎ হস্তির ডাক জানিয়ে দেয় দেবীর আগমন ঘটেছে। দেবী সকলের মনোবাসনা পূরণ করেন এবং অলক্ষ্মী বিনাশ করেন। দেবী পদ্মফুলের উপর বিরাজিতা। দেবী সকলকে যশ-খ্যাতি, ধনসম্পদ ও সৌন্দর্য প্রদান করেন।
‘শ্রী-সূক্তে’ ঋষি কর্দম দেবীকে যেসব শব্দে সম্বোধন করেছেন, তা হল- ‘আর্দ্রা’, ‘গজশুণ্ডাগ্রবতী’, ‘পুষ্টিরূপা’, ‘পিঙ্গলবর্ণা’, ‘পদ্মমালিনী’, ‘চন্দ্রাভা’, ‘হিরণ্ময়ী’, ‘ষষ্টিহস্তা’, ‘সুবর্ণা’, ‘হেমমালিনী’, ‘সূর্যাভা’ প্রভৃতি। কোন কোন পুরাণ মতে লক্ষ্মী দেবী (শ্রী) হলেন ভৃগুকন্যা। ভাগবত্ পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও ব্রহ্মা- পুরাণে বলা হয়েছে, ভৃগুপত্নি খ্যাতির গর্ভে শ্রী দেবীর জন্ম। শতপথ ব্রাহ্মণে অবশ্য বলা হয়েছে, শ্রীদেবী প্রজাপতি (ব্রহ্মা) হতে উৎপন্ন হয়েছেন এবং তিনি ধন, সৌন্দর্য ও সৌভাগ্য প্রদান করেন।
এবারে প্রশ্ন হল, ভৃগুকন্যা লক্ষ্মী কিভাবে বিষ্ণু-পত্নী হলেন? স্কন্দ পুরাণে এ প্রশ্নের উত্তর মেলে। সেখানে উল্লেখ আছে খ্যাতির গর্ভে জাতা লক্ষ্মী দেবী নারায়ণ বা বিষ্ণুকে পতি রূপে পাওয়ার জন্য সমুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করে বহুকাল কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলেন। তখন ইন্দ্রাদি দেবগণ বিষ্ণুর ছদ্মবেশে লক্ষ্মীর নিকট উপস্থিত হলে লক্ষ্মী দেবী তাঁদেরকে বিশ্বরূপ দেখাতে বলেন। কারণ লক্ষ্মী দেবী জানতেন যে, একমাত্র বিষ্ণুই বিশ্বরূপ দেখাতে সক্ষম। কিন্তু কেউই বিশ্বরূপ দেখাতে না পেরে লজ্জিত হয়ে চলে যান। তাঁরপর লক্ষ্মীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে একদিন বিষ্ণু নিজে লক্ষ্মীর নিকট উপস্থিত হলেন এবং তাঁর ইচ্ছায় বিশ্বরূপ দেখালেন। তারপর মহর্ষি ভৃগু তাঁর কন্যা লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর হস্তে সমর্পণ করলেন। এভাবে লক্ষ্মী দেবী বিষ্ণুপত্নী হলেন।
লক্ষ্মী দেবীর উৎপত্তি নিয়ে নানা তত্ব রয়েছে। বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ অনুসারে লক্ষ্মী দেবীর উৎপত্তি হয়েছে সমুদ্র থেকে। দুর্বাসা মুনির শাপে স্বর্গ একদা শ্রীহীন বা লক্ষ্মী-ছাড়া হয়ে যায়। তখন বিষ্ণুর পরামর্শে স্বর্গের ঐশ্বর্য ফিরে পাবার জন্য দেবগণ অসুরদের সাথে নিয়ে সমুদ্র-মন্থন শুরু করেন। সেই ক্ষীর-সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে আসল নানা রত্ন, মণি-মাণিক্য, অমৃতসুধা আরও কত কি। এসব ছাড়াও সমুদ্র-মন্থনের ফলে উঠে আসলেন লক্ষ্মী লক্ষ্মী দেবী এবং ঠাই পেলেন বিষ্ণুর বক্ষে। সমুদ্র থেকে দেবীর উদ্ভব বলে দেবীকে বলা হয় সমুদ্রোদ্ভবা। সমুদ্র হল অশেষ ধন-রত্নের আধার। ধনরত্নে পরিপূর্ণ বলে সমুদ্রকে রত্নাকরও বলা হয়। যেহেতু লক্ষ্মী দেবী হলেন ধন-সম্পদের দেবী সেহেতু সমুদ্র থেকে দেবী লক্ষ্মীর উৎপত্তির কাহিনী কল্পিত হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিষ্ণু হলেন জগতের প্রতিপালক। প্রজাদের লালন-পালন করতে ধন-রত্নের প্রয়োজন রয়েছে আর সেজন্যই বিষ্ণু ধন-ঐশ্বর্যের লক্ষ্মী দেবীকে বুকে স্থান দিলেন।
● দেবী লক্ষ্মীর রূপকল্প: ‘কৃত্যতত্তম-অষ্টবিংশতিতত্ত্বমে’ আছে, পাশ, অক্ষমালা, পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনা, ত্রিলোকের মাতা, গৌরবর্ণা, সুরূপা, নানা অলঙ্কারে সজ্জিতা, বাম হস্তে স্বর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণ করে বরদানকারিণী দেবীকে ধ্যান করি। তন্ত্রসার অনুসারে দেবী চার হস্তে বরমুদ্রা, অভয়মুদ্রা ও দুইটি পদ্ম ধারণ করে আছেন। তাঁর পীনোন্নত স্তনে মুক্তার শোভা পাচ্ছে। তন্ত্রসারের অন্যত্র গজলক্ষ্মীর যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা এরকম- দেবীর দেহ স্বর্ণবর্ণের। চারটি হস্তি শুড় দ্বারা অমৃতপূর্ণ স্বর্ণ-কলস তুলে অমৃতবর্ষণ করে তাঁর অভিষেক করছে। তিনি ডানদিকের উপরের হস্তে পদ্ম ও নিচের হস্তে বরমুদ্রা এবং বামদিকের উপরের হস্তে পদ্ম ও নিচের হস্তে অভয়মুদ্রা ধারণ করেছেন। তাঁর মস্তকে রত্নমুকুট, পরিধানে পট্টবস্ত্র এবং তিনি পদ্মে উপবিষ্টা আছেন।
চণ্ডীতে যে মহালক্ষ্মীর উল্লেখ আছে- তিনি অষ্টাদশ ভূজা। তিনি অষ্টাদশ হস্তে অক্ষমালা, পরশু, গদা, বাণ, বজ্র, পদ্ম, ধনু, কমণ্ডলু, দণ্ড, শক্তি, অসি, ঢাল, ঘণ্টা, শঙ্খ, সুরাপাত্র, শূল, পাশ ও সুদর্শন চক্র ধরে আছেন। তন্ত্ররাজ গ্রন্থে এক সিদ্ধলক্ষ্মীর কথা আছে যার কৃপায় যুদ্ধে জয়লাভ করা যায়। সে সিদ্ধলক্ষ্মীর একশত মুখ, দুইশত বাহু, প্রতিটি মুখ ত্রিনয়ন-বিশিষ্ট, ভয়ঙ্কর এবং সমান আকৃতি বিশিষ্ট শক্তি দ্বারা পরিবৃতা।
লক্ষ্মী দেবীর রূপ বিশ্লেষণ করে রজোগুণেরই আধিক্য পাওয়া যায়। হিরণ্যবর্ণ, স্বর্ণমুকুট, নানা অলঙ্কার, হস্তিদের ছেটানো অমৃত-জলে স্নান প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রকৃতির রজোগুণকেই সূচিত করে। দেবীর হাতে পদ্ম এবং তিনি পদ্মের উপর বসে থাকেন অর্থাৎ পদ্মের সাথে দেবীর একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। পদ্ম হল সূর্যের প্রতীক। আর সূর্য হল বিষ্ণুরই এক রূপ। বিষ্ণুর হাতেও পদ্ম রয়েছে। তাই বিষ্ণুশক্তি হিসেবে লক্ষ্মীর হস্তে পদ্ম থাকাটা স্বাভাবিক। আবার পদ্ম ভক্তিরও প্রতীক। দেবী ভক্তদের ভক্তি প্রদান করেন তাই ভক্তিপদ্ম তার হস্তে।
● দেবী লক্ষ্মীর রূপভেদ: লক্ষ্মী দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে অধিষ্ঠান করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে এই দেবী বৈকুণ্ঠে পরিপূর্ণতমা শ্রেষ্ঠা মহালক্ষ্মী, স্বর্গে ইন্দ্রের সম্পদরূপা স্বর্গলক্ষ্মী, পাতাল ও মর্ত্যে রাজাদের রাজলক্ষ্মী, গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী ও অংশরূপে গৃহিনী এবং গৃহিগণের সম্পদরূপিণী মঙ্গলকারিণী মঙ্গলা। তিনি গাভীদের জননী সুরভী, যজ্ঞের পত্নী দক্ষিণা, তিনি ক্ষীরোদ-সমুদ্রকন্যা, পদ্মফুলের সৌন্দর্যরূপিণী, চন্দ্রের শোভারূপা, সূর্যমণ্ডলের শোভারূপা এবং অলঙ্কারে, রত্নে, ফলে, জলে, নৃপপত্নীতে, গৃহে, সকল শস্যে, বস্ত্রে ও পরিষ্কৃত স্থানে বিরাজমানা। অষ্টলক্ষ্মী হলেন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আটটি বিশেষ রূপ। তাঁরা সম্পদের আট উৎস তথা লক্ষ্মীদেবীর শক্তির প্রতীক। অষ্টলক্ষ্মী লক্ষ্মীর অপ্রধান রূপভেদ। অষ্টলক্ষ্মী ‘সম্পদ’ কথাটির অর্থ হল সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, জ্ঞান, শক্তি, সন্তানাদি ও ক্ষমতা। মন্দিরে অষ্টলক্ষ্মীকে একযোগে পূজা করা হয়ে থাকে।
শ্রীঅষ্টলক্ষ্মীস্তোত্রম্ অনুযায়ী অষ্টলক্ষ্মী হলেন:
১) আদিলক্ষ্মী বা মহালক্ষ্মী: লক্ষ্মীর আদিরূপ এবং ঋষি ভৃগুর কন্যারূপে লক্ষ্মীর অবতার।
২) ধনলক্ষ্মী: লক্ষ্মীর অর্থ ও স্বর্ণদাত্রী রূপ।
৩) ধান্যলক্ষ্মী: কৃষিসম্পদদাত্রী লক্ষ্মী।
৪) গজলক্ষ্মী: গবাদি পশু ও হস্তীরূপ সম্পদদাত্রী লক্ষ্মী। স্বামী চিদানন্দের মতে গজলক্ষ্মী রাজক্ষমতা প্রদান করেন। পুরাণ অনুযায়ী, গজলক্ষ্মী দেবরাজ ইন্দ্রকে সমুদ্রগর্ভ থেকে তাঁর হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বসুধা নারায়ণ “গজলক্ষ্মী” শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন “গজ অর্থাৎ হাতিদের দ্বারা পূজিত লক্ষ্মী”।
৫) সন্তানলক্ষ্মী: সন্তানপ্রদাত্রী লক্ষ্মী।
৬) বীরলক্ষ্মী বা ধৈর্যলক্ষ্মী: যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব এবং জীবনের কঠিন সময়ে সাহস প্রদানকারী লক্ষ্মী।
৭) বিজয়লক্ষ্মী বা জয়লক্ষ্মী: বিজয় প্রদানকারিনী লক্ষ্মী, কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয় বরং কঠিন সময়ে বাধাবিপত্তি জয় করে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রেও।
৮) বিদ্যালক্ষ্মী: কলা ও বিজ্ঞানের জ্ঞানপ্রদানকারিনী লক্ষ্মী।
কোনো কোনো অষ্টলক্ষ্মী তালিকায় লক্ষ্মীর অন্যান্য কয়েকটি রূপও অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে:
১) ঐশ্বর্যলক্ষ্মী: ঐশ্বর্যপ্রদাত্রী লক্ষ্মী।
২) সৌভাগ্যা: সৌভাগ্য প্রদানকারিনী।
৩) রাজ্যলক্ষ্মী: “যিনি শাসককে আশীর্বাদ করেন।”
৪) বরলক্ষ্মী: “যে দেবী সুন্দর বর প্রদান করেন।”
● লক্ষ্মী দেবীর অবতার: বিষ্ণুর মত লক্ষ্মী দেবীরও অবতার রয়েছে। বিভিন্ন শাস্ত্র ও পুরানে বলা হয়েছে ‘সীতা’, ‘রুক্মিণী’, ‘রাধা’ প্রভৃতি দেবী লক্ষ্মীর অবতার। ‘প্রপঞ্চসার তন্ত্রে’ লক্ষ্মী দেবীর যে নয়টি শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তা হল- ‘বিভূতি’, ‘উন্নতি’, ‘কামিত্ম’, ‘হৃষ্টি’, ‘কীর্তি’, ‘সন্নতি’, ‘ব্যুষ্টি’, ‘উৎকৃষ্টি’ ও ‘ঋদ্ধি’। ‘মৎস্য পুরাণ’ মতে ‘সরস্বতীর অষ্টশক্তি’র এক শক্তি হলেন ‘লক্ষ্মী’। সরস্বতীর অষ্টশক্তি হলেন ‘লক্ষ্মী’, ‘মেধা’, ‘ধরা’, ‘পুষ্টি’, ‘গৌরী’, ‘তুষ্টি’, ‘প্রভা’ ও ‘সতী’। প্রকৃতপক্ষে দেবীর এক একটি শক্তি হল দেবীর এক একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য। লক্ষ্মী শুধু ধনের দেবী নয়। তিনি কৃষিসম্পদ, খনিজদ্রব্য, পশুসম্পদ, শিল্পসম্পদ ও বাণিজ্যেরও দেবী। তাই কৃষি ক্ষেত্রে, পশুপালনে, শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে দেবীর কৃপালাভ প্রয়োজন। ভূমিতে উৎপন্ন শস্য, খনিতে থাকা স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ সব কিছুর অধিষ্ঠাত্রী হলেন লক্ষ্মী দেবী। এজন্য তাঁকে ‘ভূলীলা’ বলা হয়।
● লক্ষ্মী দেবীর প্রিয় ও অপ্রিয়: লক্ষ্মী দেবীর কোন কোন স্থান প্রিয় আর কোন কোন স্থান অপ্রিয়, তা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ আছে। দেবী বলেছেন- যে সকল গৃহে গুরু, ঈশ্বর, পিতামাতা, আত্মীয়, অতিথি ও পিতৃলোক রুষ্ট হন সে সকল গৃহে আমি প্রবেশ করি না। আমি সে সকল গৃহে যেতে ঘৃণা বোধ করি, যে সকল ব্যক্তি স্বভাবতঃ মিথ্যাবাদী, সর্বদা কেবল নাই-নাই বলে, যারা দুর্বলচেতা এবং দুঃশীল, যারা সত্যহীন মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে, বিশ্বাসঘাতক ও কৃতঘ্ন, যে সকল পাপী সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ভয়গ্রস্ত শত্রুগ্রস্ত, ঋণগ্রস্ত, অতি কৃপণ, দীক্ষাহীন, শোকার্ত, মন্দবুদ্ধি সম্পন্ন, স্ত্রী-বশীভূত, কুলটার পতি, দুর্বাক, কলহপরায়ণ, যারা ভগবানের পূজা ও তাঁর নাম-গুণাগুণ-কীর্তনে বিমুখ, যারা শয়নের পূর্বে পা ধোয় না, নগ্ন হয়ে শয়ন করে, বেশী ঘুমায় অথবা প্রভাতে, সায়াহ্নে বা দিনে নিদ্রা যায়, যাদের দাঁত অসংস্কৃত, পরিধেয় বস্ত্র মলিন এবং হাত বিকৃত তাদের গৃহে আমি কখনো গমন করি না। আমি সে গৃহেই বাস করি, যে সকল গৃহে সাদা কবুতর রয়েছে, যেখানে গৃহিনী উজ্জ্বল ও সুশ্রী, যেখানে কলহ নাই, ধানের বর্ণ স্বর্ণের মত, চাল রূপার মত এবং অন্ন-তুষহীন। যে গৃহস্থ পরিজনের মধ্যে ধন ও ভোগ্যবস্তু সমান ভাগ করে ভোগ করেন, যিনি মিষ্টভাষী বৃদ্ধগণকে সেবা করেন, প্রিয়দর্শন, স্বল্পভাষী, অদীর্ঘসূত্রী অথাৎ কোন কাজে অধিক সময় ব্যয় করেন না, ধার্মিক, জিতেন্দ্রিয়, বিদ্যান, অগর্বিত, যিনি জনগণের সেবাপরায়ণ ও পরকে পীড়া দেন না, যিনি ধীরে সণান করেন, দ্রুত আহার করেন, ফুল তোলার পর গন্ধ নেন না, পরস্ত্রী দর্শন করেন না এবং সংযত সে ব্যক্তিই আমার প্রিয়।
আরও কয়েকটি কথা খেয়াল না রাখলেই নয়! লক্ষ্মীপূজায় কাঁসর-ঘণ্টা বাজাতে নেই! উচ্চকিত শব্দে বিরক্ত হন দেবী। দিতে নেই তুলসীপাতাও। কেন না, তুলসী দেবী লক্ষ্মীর সতীন! আর ব্যবহার করতে নেই লোহার কোনও বাসন। কেন না, লোহা দেওয়া হয় অলক্ষ্মীকে। তাই লোহা দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে ভক্তের গৃহ ত্যাগ করেন লক্ষ্মী।
মোটের উপর, ভক্তের কাছ থেকে ভক্তি ছাড়া আর কিছুই প্রার্থনা করেন না লক্ষ্মী। তাই একমাত্র তাঁর পূজাই মন্ত্র ছাড়া, শুধু তাঁকে স্মরণ করেই সম্ভব।
● লক্ষ্মী দেবীর আবাস: লক্ষ্মী দেবী গৃহিণীদের মধ্যে ‘গৃহলক্ষ্মী’ হয়ে বাস করেন। তবে সব গৃহিণীদের মধ্যে নয়। ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে’ দেবী বলেছেন- আমি সে সব নারীর শরীরে নিত্য বাস করি যারা গুরুজনের কাছে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং যারা গুরুভক্তিপরায়ণা, যারা পতিবাক্য কখনও অবহেলা করেন না এবং পতির ভোজনের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা ভোজন করেন, যারা পরিতুষ্টা, বীর্যশালিনী, প্রিয়বাদিনী, সৌভাগ্যবতী, সুশোভনা, লাবণ্যযুক্তা এবং প্রিয়দর্শিনী এরকম পতিব্রতা রমণীর মধ্যেই আমি বাস করি।
● লক্ষ্মী দেবীর বাহন: লক্ষ্মী দেবীর বাহন পেঁচা কেন? পেঁচা লক্ষ্মী দেবীর সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্ম ধারণ করে। পেঁচা কুৎসিত ও দিবান্ধ। যারা সারা জীবন শুধু ধনলাভের চিন্তায় মগ্ন থাকে, তারা ঐ পেঁচার মতই অন্ধ হয়ে যায়। তাই জ্ঞানের আলো তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। পেঁচা যেমন কালো অন্ধকারে পথ চলে, ধনলোভীরাও তেমনি কালো পথে অর্থাৎ অসৎ পথে ধাবিত হয়। ধনের দেবী তাঁর সঙ্গে পেঁচা রেখে সকলকে জানিয়ে দেন, যিনি ভক্তিধন অন্বেষণ করবে, তিনি আমাকে পাবে আর যিনি পার্থিব-ধন অন্বেষণ করবে তিনি আমাকে নয় আমার পেঁচা কে লাভ করবে।
● বঙ্গদেশে নানা ভাবে লক্ষ্মী দেবীর কল্পনা:
১) মূর্তি: মাটির দিয়ে তৈরী ছাঁচে বা কাঠামো তৈরি করে তাতে দেবী মূর্তি তৈরি করে পূজা করা হয়।
২) কলার বেড়: কলার বাকলকে গোল করে নারকেলের নতুন কাঠি দিয়ে আটকানো হয়। তাতে সিঁদুর দিয়ে বাঙালি স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা হয়। কলার বাকল দিয়ে তৈরী এই চোঙাকৃতি ভিতরে নিচুনি রাখা হয়। কাঠের আসনের উপরে লক্ষ্মীর পা অঙ্কিত আলপনার উপরে ৯টি চোঙা রাখা হয়। এই ৯টি বাকলের মধ্যে পঞ্চশস্য দেওয়া হয় সর্বশেষে শিস যুক্ত নারকেল রেখে লাল চেলি দিয়ে ঢেকে বউ সাজিয়ে লক্ষ্মী কল্পনা করা হয়।
৩) সপ্ততরী: নবপত্রিকা বা কলার পেটোর তৈরি নৌকা এই পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নৌকা এখনও বহু গৃহস্থেই তৈরি হয়ে থাকে। তবে বাজারেও এখন কিনতে পাওয়া যায় কলার পেটো। একে সপ্ততরী বলা হয়। এই তরীকে বাণিজ্যের নৌকা হিসাবে ধরা হয়। তাতে অনকেই টাকা -পয়সা, চাল, ডাল, হরিতকি, কড়ি, হলুদ সাজিয়ে রাখেন।
৪) লক্ষ্মীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘট: লক্ষ্মীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘটে চাল বা কখনো কখনো জল ভরে সেটিকে লক্ষ্মী কল্পনা করে পূজা করা হয়।
৫) অনেক বাড়িতেই পূর্ববঙ্গীয় রীতি মেনে সরার পটচিত্রে পুজো করা হয়। এই সরাতে লক্ষ্মী, জয়া-বিজয়া সহ কয়েকটি বিশেষ পুতুলকে চিত্রায়িত করা হয়। লক্ষ্মী সরাও হয় নানা রকম, যেমন ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি সরা, সুরেশ্বরী সরা এবং শান্তিপুরী সরা। নদিয়া জেলার তাহেরপুর, নবদ্বীপ এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন স্থানে লক্ষ্মীসরা আঁকা হয়। তবে অঞ্চল ভেদে লক্ষ্মী সরায় তিন, পাঁচ, সাত পুতুল আঁকা হয়। এতে থাকে লক্ষ্মী, জয়া বিজয়া সহ লক্ষ্মী, রাধাকৃষ্ণ, সপরিবার দুর্গা ইত্যাদি। ফরিদপুরের সরায় দেবদেবীরা সাধারণত একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন। আবার সুরেশ্বরী সরায় উপরের অংশে মহিষমর্দিনী আঁকা হয় আর নীচের দিকে থাকেন সবাহন লক্ষ্মী।
দেবী লক্ষ্মী ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। তিনি বিষ্ণুর পত্নী। তাঁর অপর নাম মহালক্ষ্মী। জৈন ধর্মেও দেবী লক্ষ্মী পূজিত ও স্বীকৃত ছিলেন, কারণ প্রাচীন জৈন স্মারকগুলিতেও লক্ষ্মীর ছবি দেখা যায়।
লক্ষ্মী ছয়টি বিশেষ গুণের দেবী। পৌরাণিক মত অনুসারে তিনি বিষ্ণুর শক্তিরও উৎস। বিষ্ণু রাম ও কৃষ্ণ রূপে অবতার গ্রহণ করলে, লক্ষ্মী সীতা ও রাধা রূপে তাঁদের সঙ্গিনী হন। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী রুক্মিনী ও সত্যভামাও লক্ষ্মীর অবতার রূপে কল্পিত হন।
● কোজাগরী শব্দের অর্থ: ‘কোজাগরী’ শব্দটির উৎপত্তি ‘কো জাগতী’ অর্থাৎ ‘কে জেগে আছ’ কথাটি থেকে। বলা হয়, ‘যার কিছু (সম্পত্তি) নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে, আর ‘যার আছে (সম্পত্তি) যে না হারানোর আশায় জাগে’। আর সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পুজোর বিশেষ আচার। কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন – কে জেগে আছেন? যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে , লক্ষ্মী তাঁকে ধন সম্পদ দান করেন।
“নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।।”
অক্ষক্রীড়া শব্দের সাধারণ অর্থ পাশা খেলা। এক শ্রেণির লোক এই দিন পাশা খেলার মাধ্যমে টাকা পয়সা বাজি রেখে জুয়া খেলায় মেতে ওঠে। আবার কেউ কেউ এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে গাছপালা তছনছ করে। এই সব অর্থহীন কাজের মাধ্যমে তারা ভাবে যে লক্ষ্মী দেবী তাদের কৃপা করবেন।
কিভাবে হয় এই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা? আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অর্থাৎ কোজাগরী পূর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ বইতে এই লক্ষ্মীপূজা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি জানান, দেবীর কাছে ভালো ফলনের কামনা করাই আসলে এই পূজার নৃতাত্ত্বিক কারণ। পূজা বা ব্রত কথার সঙ্গে আলপনার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আলপনা আসলে ‘কামনার প্রতিচ্ছবি।’ দেবী পূজা উপাচার হিসেবে থাকে ফল, মিষ্টি, মোয়া, নাড়ু প্রভৃতি। কোজাগরী লক্ষ্মীর প্রতি আচার নিবেদনের সঙ্গেও একটি লোকবিশ্বাস জড়িত রয়েছে। পূজার সময় মোট ১৪টি পাত্রে উপাচার রাখা হয়। তারপর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে জল দানের রীতি রয়েছে। কাঠের জলচৌকির ওপর লক্ষ্মীর সরাটিকে স্থাপন করা হয়। এরপর কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকি দিয়ে সাজানো হয় পূজার স্থানটিকে।
● বঙ্গদেশে লক্ষ্মীপূজা: “লক্ষ্মী মানে শ্রী, সুরুচি। লক্ষ্মীসম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসেবে তাকে পুজো করা হত। তবে পরবর্তীকালে ধনশক্তির মূর্তি নারায়ণের সঙ্গে তাকে জুড়ে দেওয়া হয়।” — বলছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী।
ধন ও সৌভাগ্যের দেবী মা লক্ষ্মী। অবাঙালিদের মধ্যে লক্ষ্মীপূজার রেওয়াজ কালীপূজা বা দিওয়ালির দিনে। কিন্তু বাঙালির ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মী পূজিতা হন দেবীপক্ষের শেষের এই পূর্ণিমাতে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার চল রয়েছে। তবে রীতিতে ফারাক রয়েছে দুই বাংলার। পশ্চিমবঙ্গে পূজা হয় মূলত মাটির প্রতিমায়, কিন্তু বাংলাদেশে প্রধানত সরায় এঁকে লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
● শাস্ত্র, লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাসে দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর পূজার পরিবর্তন: ভারতের সব দেবদেবীরই বিভিন্ন যুগে নানা পরিবর্তন হয়েছে। ঋষিরা তো এক জায়গায় বসে, কমিটি গঠন করে দেবদেবীদের নির্দিষ্ট রূপ ও গুণাবলির কথা রচনা করেননি। নানা জনে আলাদাভাবে ইচ্ছে মতো শ্লোক লিখেছেন। যুগ যুগ ধরে সেই সব পৃথক ভাবমূর্তি একটি মিলিত রূপ পেয়েছে। লক্ষ্মীও তার ব্যতিক্রম নন।
বৈদিক শাস্ত্র ও বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে লক্ষ্মীর উদ্ভব ও পরিচিতি নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিছু পুরাণ অনুযায়ী লক্ষ্মী দেবসেনা রূপে জন্ম নিয়ে কার্তিকেয়র পত্নী হন। আবার কিছু পুরাণ মতে তিনি গণেশপত্নী। নদীরূপিনী সরস্বতীই আদিতে উর্বরতা ও শস্যদায়িনী দেবী। পরে লক্ষ্মী-সরস্বতী একইরূপে গণ্য হওয়ার সময় থেকে শস্য ও সম্পদের দেবী হিসেবে লক্ষ্মীকে গণ্য করা আরম্ভ হয়। আবার শস্যের দেবী হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে লক্ষ্মীকে ধরিত্রী বা বসুমতী হিসেবেও ভাবা শুরু হয়।
বৈদিক লক্ষ্মী কিন্তু শস্য-সম্পদের দেবী ছিলেন না। বরং নদীরূপিনী সরস্বতী শস্যদাত্রী হিসেবে গণ্য হতেন। কেন? নদী পলি মাটি ভরাট করে উর্বর করত ভূ-তট। এর পরে তো বৈদিক আর্যরা চাষাবাদ শিখল ‘নিম্নবর্গ’-এর কাছে। সম্পদ এলো আর্যদের হাতে। শাসক বা শোষক হলেন তারা। আবার লক্ষ্মীর স্বামী একটা কাঁচা কাজ করে ফেললেন। কেমন কাঁচা? বেদম কাঁচা। দুর্বাসা মুনি, যিনি শুধু অভিশাপ দেওয়ার জন্যই বিখ্যাত, তার অন্য কোনও গুণের কথা বিশেষ জানা যায় না, তিনি এক দিন একটা পারিজাত ফুলের মালা উপহার দিলেন ইন্দ্রকে। এরপর ইন্দ্র যখন রম্ভা-সম্ভোগে মত্ত, ওই মালা নিজের বাহন ঐরাবতের গলায় ছুড়ে দেন। হাতি তো মালার কদর বোঝে না। তাছাড়া ঐরাবতের বোধহয় মালাটি পছন্দ হয়নি, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা সে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর পা দিয়ে চেপ্টে দিল। ব্যস! রগচটা স্বভাবের ঋষি অমনি জ্বলে উঠে উচ্চারণ করলেন অভিশাপ। অদ্ভুত সেই অভিশাপ। তিনি বললেন, কী! আমার দেওয়া মালা মাটিতে ফেলে দিলে, তাই তোমার ত্রিলোক এখন লক্ষ্মীছাড়া হবে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর নির্বাসন। দোষ করলেন ইন্দ্র, শাস্তি পেতে হবে লক্ষ্মীকে! অভিশাপে ইন্দ্রের ইন্দ্রপুরী হলো শ্রীহীন, লক্ষ্মীছাড়া দশা। স্ত্রী লক্ষ্মী, ইন্দ্রের অনুমতি নিয়ে পাতালে, মানে সমুদ্রে প্রবেশ করলেন।
পরে দেবতাদের ব্যকুল প্রার্থনায় বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন সমুদ্র মন্থনের। মন্থনের পর যিনি রত্নাকর থেকে উত্থিতা হলেন, তিনি কিন্তু লক্ষ্মী নন। সেই দেবীর নাম শ্রী। এই শ্রী ও লক্ষ্মী দুই পৃথক দেবী ছিলেন। বেশ কিছু কাল পরে দুজনে মিলেমিশে এক হয়ে যান। লক্ষ্মী দেবী ছিলেন ভৃগুর কন্যা, মায়ের নাম খ্যাতি। তার এক হাতে পদ্ম, আরেক হাতে অমৃতের কলস। তার রূপে-গুণে আকৃষ্ট হয়ে দেব-দানবের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। শেষ পর্যন্ত ছলে বলে বিষ্ণু তাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন। লক্ষ্মী ও শ্রী একাকার হয়ে বিষ্ণুর পত্নী হন। তিনি পদ্মাসনা আর বাহন শ্বেত পেঁচা। তবে উপপুরাণের অর্বাচীন পৃষ্ঠায় লক্ষ্মী একবার তুলসী, একবার ঘোটকী হয়েও জন্মান। জ্যোৎস্না প্লাবিত এই পৃথিবীর হেমন্তে আসেন শুধু একটি রাতের অতিথি হয়ে।
দুর্গাপূজা যেমন মূলত বারোয়ারি, লক্ষ্মীপূজা গৃহস্থের পূজা। যে রাতে লক্ষ্মীর পূজা হয়, সেটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা। কো জাগতী– অর্থাৎ কে জেগে আছ–কথাটি থেকে কোজাগরী। কোজাগর মানে, ‘কে জাগে?’ যার নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে। যার প্রচুর আছে সে হারানোর ভয়ে জাগে! ভক্তদের বিশ্বাস, পূজার পর ওই রাতেই নাকি মা ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন কে জেগে আছে। আর যে জেগে থাকে, তার হাতেই ধরিয়ে দেন ধন সম্পদে পরিপূর্ণ ঝাঁপিখানি। লক্ষ্মীপুজোয় যে আল্পনা দেওয়া হয়, তাতে মায়ের পায়ের ছাপও আঁকা হয়। বিশ্বাস ওই পথেই মা ঢুকবেন গৃহস্থের ঘরে।
লক্ষ্মী চঞ্চলা। তবে ক্রোধী দেবী নন। তাই যেকোনও গৃহস্থই লক্ষ্মীর ঝাঁপি করে লক্ষ্মীর পিঁড়ি পাতেন গৃহকোণে। স্থানাভাবে একটি মাত্র ঘরের কুলুঙ্গিতে। উপাচার তো সামান্যই। প্রতি বৃহস্পতিবারে (লক্ষ্মীবার শব্দটি ব্যবহৃত) সামান্য ফুল-বাতাসা আর ধোয়া পিঁড়িতে চাল পিটুলির আলপনা। সেটাই একটু বড় আকারের এই কোজাগরীর রাতে।
আসলে লক্ষ্মী হলো বাঙালির দেবী। লৈকিক দেবী। আগে আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামে দুর্গাপূজা নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাই ছিল বড় উৎসব। কোজাগরীর রকমফের ছিল দেখার মতো। ছড়া কেটেই মা লক্ষ্মীকে আবাহন করত গৃহস্থ। করজোড়ে বাড়ির নারীরা একসঙ্গে বলতেন, ‘আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি। দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি। আঁকি মাগো আল্পনা, এই পূজা এই বন্দনা।’ সব ছড়ার মধ্যেই থাকে বাসনা, অভিমান এবং আকাঙ্ক্ষা। পেঁচা, কড়ি, ধানের গোলা আঁকার সঙ্গে সঙ্গে তাই ছড়া কাটা হতো। ‘আমি আঁকি পিটুলির গোলা, আমার হোক ধানের গোলা। আমি আঁকি পিটুলির বালা, আমার হোক সোনার বালা।’ সেই সঙ্গে থাকে মন শুদ্ধ করার বার্তাও। ‘আঁকিলাম আল্পনা, দূরে ফেলি আবর্জনা। শুভ-শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।’
মৈমনসিংহ গীতিকার মতো প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে লক্ষ্মীপূজার উল্লেখ দেখে বোঝা যায়, সেকালে এই পূজার জনপ্রিয়তা কতটা ছিল। নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালীর ইতিহাস’-গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়।…আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা…। বাঙালী হিন্দুর ঘরে ঘরে নারীসমাজে সে পুজা আজও অব্যাহত। বস্তুত, দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।’
লক্ষ্মীপূজা আমাদের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে কেবল টাকাকড়িই ধন নয়। চরিত্রধন মানুষের মহাধন। যার টাকাকড়ি নেই সে যেমন লক্ষ্মীহীন, যার চরিত্রধন নেই সে তেমনি লক্ষ্মীছাড়া। যারা সাধক তারা লক্ষ্মীর আরাধনা করেন মুক্তিধন লাভের জন্য। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা কেন? কেউ কেউ বলেন, লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যারা অপব্যবহার করে, তাদের কপালে লেখা আছে যমের দণ্ড—এই কথা ঘোষণা করে লক্ষ্মীর বাহন। তাই কথায় বলে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। এছাড়া ধনসম্পত্তি, সে টাকাকড়ি হোক বা সাধনধনই হোক, সদাজাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয়। রাতে সবাই যখন ঘুমায়, তখন পেঁচা জেগে থাকে। পেঁচাই সেই ধনসম্পদ পাহারা দেয়।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলার ব্রত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রজ্ঞা বিকাশ (২০১৮)।
২- বাংলার ব্রত ও অন্যান্য ব্রত কথা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীপায়ন (২০১২)।
৩- বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, দে’জ পাবলিশিং (২০১৪)।
৪- শ্রী শ্রী কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা পদ্ধতি, বুক চয়েস।
৫- বাংলার লোকসংস্কৃতি, ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায়, অমর ভারতী (২০০৯)।
৬- বাংলার লোকসংস্কৃতি, দেবলীনা দেবনাথ, পরম্পরা (২০১৪)।)