তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিবাহের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পাত্রীও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, কথাবার্তা প্রায় পাকা।
পাত্রী এক বিশাল ধনী পরিবারের একমাত্র দুহিতা, সেই বিবাহে রবি শুধু রাজকন্যাই লাভ করবেন না, সেই সঙ্গে পাবেন রাজত্ব, সাত লাখ টাকা আয়ের জমিদারি।
পাত্রী পক্ষ অবশ্য বাঙালি ছিলেন না, দক্ষিণ ভারতীয়, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। সেই বিবাহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীরই উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি তাঁর স্বামী, রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভারতের নানা অঞ্চলে গিয়ে থেকেছিলেন, অন্য ভাষাভাষী মানুষজনের সঙ্গে মিশেছিলেন অন্তরঙ্গভাবে। তা ছাড়া রবির বিয়ে তো যেমন তেমন মেয়ের সঙ্গে হতে পারে না, এই কন্যাটি ইংরেজি জানে, পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতে পারে।
ঘটকের মুখে কন্যাটির রূপ-গুণের আরও অনেক পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, শুধু ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের একবার দেখে আসাটাই বাকি ছিল। বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ তো একটা কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন রবির আসন্ন বিবাহ উপলক্ষে।
পিতা দেবেন্দ্রনাথও তখন রবির বিবাহ-ব্যবস্থা করার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন মুসৌরি থেকে। রবির তখন বাইশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, তাঁকে তখন জমিদারি দেখাশুনোর কিছু দায়িত্ব নিতে হবে, তার আগে সংসারী হওয়া দরকার। সর্বক্ষণ তিনি যদি তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর নতুন বউঠানের ছত্ৰচ্ছায়ায় থাকেন তাহলে তাঁর নিজস্ব দায়িত্বজ্ঞান হবে কী করে?
জ্ঞানদানন্দিনী একদিন কয়েকজন ননদ-জা’কে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলেন। দলের একমাত্র পুরুষ সঙ্গী ছিলেন পাত্র স্বয়ং। রবি প্রথমে লাজুকতাবশত কিছুতেই যেতে চান নি, তাঁকে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী।
তখন মাদ্রাজি জমিদারমশাই কলকাতাতে একটি বড় বাড়ি ক্রয় করেছেন। পাত্ৰপক্ষকে বসানো হয়েছিল একটি সুসজ্জিত বৈঠকখানায়। সে ঘরে ছিলেন শুধু কয়েকজন মহিলা ও কিশোরী।
মাদ্রাজি মেয়েরা বেশ সপ্রতিভ হয়। বাঙালিদের মেয়ে-দেখার আসরে কন্যাটি গয়না ও পোশাকের পুঁটুলি হয়ে মুখ নিচু করে থাকত, সাতবার এক কথা জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিতে চাইত না। এখানে পাত্রী নিজেই তাঁদের অভ্যর্থনা জানাল। তাঁর গায়ের রং ছিল চাঁপা ফুলের মতন, মাথা ভর্তি চুল, গভীর টানা চোখ।
একটি প্রশস্ত ঘরে জমকালো গালিচা পাতা, তার এক দিকে বসেছিলেন পাত্ৰপক্ষ। অন্যদিকে কয়েকজন অল্পবয়েসী নারী-পুরুষ বসে ছিলেন, এক কোণে ছিল একটি পিয়ানো। জ্ঞানদানন্দিনীই ইংরেজিতে কথাবার্তা চালিয়েছিলেন মেয়েটির সঙ্গে। সে পিয়ানো বাজিয়েও শোনায়। তাঁর শিক্ষা অতি উত্তম ছিল তো বটেই, উত্তর ভারতের সঙ্গীত রীতির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের কী প্রভেদ, তাও বুঝিয়ে দিয়েছিল সে।
কথা বলতে বলতে রবির দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। রবির যে পছন্দ হয়ে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না তাঁর। যদিও রবি নিজে মুখ ফুটে যোগ দিচ্ছিলেন না আলোচনায়।
এক সময় চটি ফটফটিয়ে সেইকক্ষে প্রবেশ করলেন এক দীর্ঘকায় পুরুষ, তিনিই ছিলেন গৃহকর্তা। নমস্কার বিনিময়ের পর তিনি বললেন, “আমার কন্যার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তো? ইনি আমার স্ত্রী, আর ওই আমার কন্যা।”
ঘরের মধ্যে যেন একটি বজ্ৰপাত হল। এতক্ষণ যার সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল, যাকে এঁরা পাত্রী হিসেবে মনোনীত করে ফেলেছিলেন, সে আসলে ছিলেন ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী! আর দেয়াল ঘেঁষে জড়সড় হয়ে বসে থাকা, অতি সাদামাটা একটি কন্যাই ছিল আসলে পাত্রী!
হাসি চাপার জন্য দারুণ সংযম দেখাতে হয়েছিল পাত্ৰপক্ষকে। সৌজন্য রক্ষার জন্য বড় বড় মিষ্টির থালা থেকে মুখে দিতে হয়েছিল কিছু কিছু। তারপর, “পরে পাকা কথা জানাব” বলে, জ্ঞানদানন্দিনী সদলবলে বেরিয়ে এসেছিলেন।
বাড়ি ফিরে সবাই ফেটে পড়েছিলেন হাসিতে। মাদ্রাজি জমিদার মশাইয়ের সর্বগুণান্বিতা স্ত্রী’টি সম্ভবত তৃতীয় পক্ষের ছিলেন। বিমাতা ও কন্যা ছিলেন প্রায় সমবয়েসী।
সেদিন ঠাকুরবাড়িতে রবিকে নিয়ে কৌতুকের আর শেষ ছিল না।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আর একটু হলে যে পরস্ত্রীহরণ পালা ঘটতে যাচ্ছিল রে, রবি!”
এই সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়ায় সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন রবির বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ। তিনি বলেছিলেন, “বাড়িতে নতুন বউয়ের সঙ্গে সৰ্বক্ষণ ইংরাজিতে কথা বলতে হবে, এই ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলুম। আমাদের বাঙালি মেয়েরা কি ফ্যালনা যে রবির বিয়ের জন্য দক্ষিণ ভারতে ছুটতে হবে?”
(তথ্যসূত্র:
১- জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বসাহিত্য ভবন (২০১৬)।
২- রবীন্দ্রনাথ: একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী, উমা দাশগুপ্ত, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
৩- রচনা সংকলন, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, দে’জ পাবলিশিং।
৪- ঠাকুরবাড়ির হাসির গল্প, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (২০০৯)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত