যদি প্রশ্ন করা হয়, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে সর্ব কনিষ্ঠ শহিদ কে? সকলেই একবাক্যে উত্তর দেবেন, ক্ষুদিরাম বসু। মাত্র ১৮ বছর বয়সে হাসি হাসি মুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন বাংলা মায়ের দামাল ছেলে ক্ষুদিরাম বসু৷
এবারে যদি প্রশ্ন হল যে, স্বাধীনতা সংগ্রামী কারা? যারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অকুতোভয় হয়ে লড়েছেন, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, জেল খেটেছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁরা হয়ত ব্রিটিশ হত্যা করেন নি বা ব্রিটিশ হত্যা করতে উদ্যত হন নি, কিন্তু তাঁরাও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তাঁরাও স্বাধীনতা সংগ্রামী।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কেবলমাত্র ইতিহাসের বইতে থাকা বড় বড় নামগুলো তে সীমাবদ্ধ নয়। এই বড় নামগুলো ছাড়াও আরও অনেক নাম আছে, যাঁরা ছিলেন অতীব সাধারণ মানুষ। ইতিহাসের বইতে যে বড় বড় নামগুলো আমরা দেখি, তাঁদের আন্দোলন বা সংগ্রামের সফলতার পিছনে মূল শক্তি ছিলেন এই সাধারণ মানুষেরা। তাঁরা সাধারণ হয়েও অসাধারণ। তেমনই এক অসাধারণ সাধারণ বালক ছিলেন উড়িষ্যার বাজি রাউত। লাল পাগড়ির গুলি বুকে নিয়ে মাত্র ১২ বৎসর বয়সে শহিদ হয়েছিলেন ইনি৷
বাজি রাউত৷ তিনিই এদেশের সর্বকনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী৷ অথচ ইতিহাসের বইতে কোথাও তাঁর নামোল্লেখ নেই। সর্বত্র আমরা এটাই পড়ি যে ভারতের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ শহিদ হলেন ক্ষুদিরাম বসু। যদিও বইতে লেখাটি হওয়া উচিত ছিল, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে, মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে ফাঁসি তে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সর্বকনিষ্ঠ শহিদ হলেন ক্ষুদিরাম বসু’, আর ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বৃটিশ পুলিশের গুলিতে মাত্র ১২ বৎসর বয়সে শহিদ হওয়া সর্বকনিষ্ঠ শহিদ হলেন উড়িষ্যার বাজি রাউত’।
স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বৈপ্লবিক কার্যক্রম, শহিদদের সম্মান দিতে এই দেশ কখনই ভোলে না। কিন্তু কালের নিয়মে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় অনেক মুখ। ঠিক যেমন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা মনে রাখেননি অনেকেই।
১০ই অক্টোবর, ১৯৩৮। সকাল ৮ টা।
উড়িষ্যার ভুবন গ্রামে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। প্রতিবাদে থানার বাইরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন গ্রামবাসীরা। বন্দিদের মু্ক্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু পুলিশ তাঁদের কথায় কান না দিয়ে সোজা গুলি চালাতে শুরু করে দেয় নিরীহ গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে। মৃত্যু হয় দু’জনের।
গ্রামবাসীদের ক্ষোভ আরও বাড়ে। বিক্ষোভকারীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। ক্রুদ্ধ জনতার ভয়ে পালানোর চেষ্টা করে পুলিশ।
নীলকন্ঠপুর ঘাট হয়ে তারা ঢেঙ্কানলের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
১১ই অক্টোবর তারা নীলকন্ঠপুর ঘাটের দিকে রওনা দেয়। ব্রাহ্মনি নদী পার হয়ে যেতে হবে তাদের। সেইসময় একটি নৌকায় গার্ড ছিলেন কিশোর বাজি রাউত।
ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে নির্দেশ দেয় নদী পার করে দেওয়ার। তার আগেই অবশ্য ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসী হত্যার ঘটনার পৌঁছেছিল তাঁর কানে। তিনি এও জানতেন যে, জনতা ক্ষুব্ধ এবং ব্রিটিশদের যেভাবেই হোক আটকাতে হয়ে।
সুতরাং লালপাগড়ির প্রস্তাবে সরাসরি না করে দিয়েছিলেন বাজি।
ব্রিটিশরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কিন্তু অকুতোভয় বাজি কানও দেন নি পুলিশের কথায়৷
কোনও অবস্থাতেই যখন তাঁকে রাজি করানো গেল না, তখন বন্দুকের বাট দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করে এক পুলিশ।
মাথায় ব্যাপক আঘাত পেয়েছিলেন ১৩ বছরের এই কিশোর। মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। উঠে দাঁড়িয়েছিলেন আবার।
জোর গলায় পুলিশকে বলেছিলেন ফিরে যেতে। বলেছিলেন, তিনি পার করে দিতে পারবেন না, অন্তত তিনি বেঁচে থাকতে সেটা সম্ভব নয়।
এরপরই ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ পুলিশ বেপরোয়াভাবে গুলি চালাতে শুরু করে। বাজি রাউত সহ তাঁর সঙ্গী লক্ষণ মালিক, ফাগু সাহু, রুশি প্রধান ও নাটা মালিকের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় বাজি রাউতের বয়স ছিল ১২ বৎসর ছয় দিন। ইতিহাসের নথি বলে তাঁর জন্ম হয়েছিল ৫ই অক্টোবর ১৯২৬ সালে।
এই ঘটনায় নতুন করে কেঁপে ওঠে দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই নতুন করে জ্বলে ওঠে। বাজি রাউতকে শহিদের সম্মান দেয় গোটা দেশ। অন্য অনেকের মতো বাজি রাউতও তেমন পরিচিত নন৷ তবু মুক্তির মন্দিরে সোপানতলে এরকম কত বলিদানের ইতিহাসই না লেখা আছে৷
আজ কোথাও তাঁর নাম নেই। কিছুকাল আগেই তাঁর মৃত্যুর পরের ছবিখানি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানোর পরে ক্ষুদিরাম বসুর শেষ ছবি বলে বহুল প্রচারিত হয়েছিল’। হায়রে ভারতবর্ষ! গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কেউ প্রতিবাদ করে বলে নি যে ইনি ক্ষুদিরাম নন, ইনি বাজি রাউত, ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেওয়া ভারতের সর্বকনিষ্ঠ শহিদ।
(তথ্যসূত্র:
১- Shaheed Bhagat Singh and the Forgotten Indian Martyrs, page 192, Reginald Massey, Abhinav Publications (২০১৪)।
২- https://www.odisha.gov.in/content/eminent-personalities)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত