উত্তরের ঐতিহ্য মন্ডিত পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম দমদম পার্ক তরুণ দল। দিনে রাতে যাদের আমরা ট্রেনে, বাসে, রাস্তায় কর্কশ সুর তুলে লোকের সামনে হাত পাততে দেখি, দু’হাতের শিকল ভেঙে, এবার সেই ‘বৃহন্নলা’দের দশভুজা হয়ে ওঠার লড়াই কাহিনি শোনাচ্ছে তারা। এ বছর ৪২ তম বর্ষে তাদের নিবেদন ‘আমি বৃহন্নলা’।
ইতিহাসের পাতায় বৃহন্নলারা সগৌরবে বিরাজমান। মহাভারতে দেখা যায়, পান্ডুপুত্র অর্জুন নারীর ছদ্মবেশে বৃহন্নলা নামে বিরাট রাজার কন্যা উত্তরার নৃত্যগীতের ভার নিয়েছিলেন। রাজা ধ্রুপদের ছেলে শ্রীখণ্ডী তৃতীয় লিঙ্গের হয়েও রাজ সিংহাসনে বসে ছিলেন। এমনকী অর্জুন পরে মনিপুরের যে রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁর মধ্যেও পুরুষ সুলভ আচরণ ছিল। অর্থাৎ বৃহন্নলা ও তৃতীয় লিঙ্গরা কিন্তু প্রাচীন সাহিত্যে স্বসম্মানে প্রতিষ্ঠা পেত। পুরাণ তাদের সাদরে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাঁরাই আজ সমাজে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। কারণ তাঁরা ‘অন্যরকম’।
এই আধুনিক শিক্ষিত সমাজও এঁদের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে। রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রামে এঁদের দেখলেই নাক সিটকায়, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। তবে প্রতিবেশী, সমাজ তো অনেক পরের কথা। তাঁদের প্রতি বাড়ির আত্মীয়-স্বজন, এমনকী নিজের বাবা-মায়ের ব্যবহারও হয় বড়ই বেদনাদায়ক। ফলে প্রত্যেকদিন লাঞ্ছনার শিকার হওয়ায় কেউ বাড়ি ছেড়ে পালানোর কথা ভাবেন। কেউ আবার বেছে নেন আত্মহননের পথ। তরুণ দলের শিল্পী অনির্বাণ দাস এবার এঁদের জন্যই খুলে দিয়েছেন মুক্তির অজস্র দ্বার।
মন্ডপে ঢুকতে গেলে প্রথমেই দেখা যাবে, হাজার হাজার ঘুড়ি। এর মাধ্যমে বৃহন্নলাদের স্বাধীন ভাবে উড়তে পারাটাই প্রতীকী ভাবে দেখানো হয়েছে। এরপর দেখা যাবে, একটি চিলেকোঠার ঘর, যেখানে এক বৃহন্নলাকে বন্দী করে রেখেছে তার বাবা। যাঁর ক্ষোভের কারণ, সন্তানের বেশভূষা ও আচার-আচরণের জন্য তাঁর ‘নাককাটা যাচ্ছে’। আর তারপরই মূল মন্ডপে দেখা যাবে ওঁদের মুক্তির স্বাদ। কেমন সেই মুক্তি? ঘুঙরুর ইন্সটলেশনে ফুটে উঠেছে বৃহন্নলাদের সাজ। তাঁদের হাততালি হয়ে গিয়েছে ম্যাকাও পাখি। এমনকী বৃহন্নলাদের চুলের বেনুনীও অন্য মাত্রা যোগ করেছে মন্ডপসজ্জায়।
আর যেখানে বৃহন্নলা পুজোর থিম, সেখানে দেবীপ্রতিমার রূপেও মিশে গিয়েছেন তাঁরা। বৃহন্নলাদের মধ্যেও যে দেবীর বাস, প্রতিমার মধ্যে দিয়ে সেই বার্তাই তুলে ধরেছেন শিল্পী সনাতন দিন্দা। তাঁর তুলির টানে মৃন্ময়ী হয়ে উঠেছেন চিন্ময়ী। কলকাতার নামীদামি পুজোর তালিকায় দমদম তরুণ দলের স্থান বেশ খানিকটা ওপরের দিকেই। গত কয়েক বছর ধরেই নিজস্ব ভাবনা আর স্বকীয় শিল্পবোধের মিশেলে দর্শনার্থীদের নজরকাড়া থিম উপহার দিচ্ছে তারা। যার ফলে এখানে উপচে পড়ে দর্শনার্থীদের ভিড়। এবছরও তার অন্যথা হয়নি একেবারেই।