ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হয়। মূলত দেবী দুর্গার প্রতিরোধের চেতনা মাথায় রেখেই দেশমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের আকার নিয়েছিল। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দ মঠ উপন্যাসে ‘বন্দে মাতরম’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেন, যা পরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। সুভাষচন্দ্র বসুর মতো বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী নেতারা এই সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। ব্রিটিশবিরোধী মন্ত্রে উদ্দীপ্ত কাজী নজরুল ইসলাম এই দেবীকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা, যার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জেলে পুরেছিল। দুর্গাকে উদ্দেশ করে নজরুল লিখেছিলেন,
‘দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা
“ময় ভুখা হুঁ মায়ি” বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!’
কলকাতায় নেতাজির স্মৃতি জড়িত পূজা হিসাবে প্রথমেই নাম করতে হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতিরসার্বজনীন দুর্গোৎসবের। এটি ছিল কলকাতার প্রথম সার্বজনীন দুর্গোৎসব।
তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে কোথায় জমায়েত করা যায়? বিপ্লবীরা যখন বেশ চিন্তায়, তখন মুশকিল আসান করলেন খোদ নেতাজি।
তাঁর নির্দেশে অনুগামী বিপ্লবী অতীন বসু দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে আদায় হল চাঁদা। এভাবেই ১৯২৬ সালে কলকাতার প্রথম সর্বজনীন দুর্গোৎসব সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো শুরু। পুজোর ঐতিহ্য দিনদিন বেড়েছে। শুধু আড়ালে থেকে গিয়েছেন বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুই।
তখন ১৯২৬ সাল। ব্রিটিশ শাসনে পরাধীন ভারত। দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে সক্রিয় বিপ্লবীরা। বিভিন্ন গোপন আস্তানায় চলছে ব্রিটিশ বিরোধী কাজকর্ম। ঠিক তখনই কলকাতাতেও বিপ্লবীদের জোটবদ্ধ করতে একটা কনভেনশনের দরকার ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের ফাঁকি দিয়ে জমায়েত কার্যত অসম্ভব।
ফন্দি আঁটলেন স্বয়ং নেতাজি।
সিমলা অঞ্চলের মহেন্দ্র গোস্বামী লেনেই ছিল বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর বাড়ি। তাঁর বাড়িতে মাঝেমধ্যেই থাকতেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর নির্দেশেই এই বাড়িতে শুরু হয় কলকাতার প্রথম সর্বজনীন দুর্গোৎসব। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জমায়েতও সহজ হয়, সঙ্গে দেশমাতৃকার জন্য মাতৃ আরাধনার শুরু হয় এখান থেকেই।
সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে যুবকদের স্বাস্থ্যচর্চায় জোর দিয়েছিলেন বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু। নেতাজির নির্দেশে পুজো আয়োজনের দায়িত্বে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পুজোর খরচ উঠল বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদা কেটে। তখন এই ভাবনা ছিল একদমই নতুন। হোগলাপাতার বেড়া দিয়ে তৈরি হল সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্যান্ডেল। এভাবেই অতীন ঘোষের হাত ধরে যাত্রা শুরু তিলোত্তমার প্রথম সর্বজনীনের।
এই পুজোয় এসে সবার সঙ্গে পাত পেড়ে খেয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু। একবার বিপ্লবীদের জমায়েত টের পেয়ে পুজো বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। বেশিদিন নয়, দু’বছর পরই আবার চালু হয় পুজো। একচালা দুর্গামূর্তি থেকে পাঁচটি চালচিত্রে ভাঙা দেবীমূর্তির প্রচলনও এখান থেকেই। দেবীমূর্তির চালচিত্র বদলে দেওয়ায় রক্ষণশীলদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে পুজো কমিটি। সমালোচনা থামাতে ১৯৩৯ সালে ফের নেতাজি পুজোর উদ্বোধন করেন। সব কর্মকাণ্ডের নেপথ্য কারিগর একজনই। অতীন বসু। জমিদারবাড়ি বারোয়ারি পেরিয়ে সর্বজনীন পুজোই এখন মেনস্ট্রিম। তবু আড়ালে থেকে গিয়েছেন, কলকাতার সর্বজনীন পুজো সংস্কৃতির প্রবর্তক বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু।
এরপরেই নেতাজির স্মৃতি জড়িত ও সাহায্য ধন্য পূজা হিসাবে নাম নিতে হয় কলকাতার বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবের। যদিও এই পূজা শুরু হয়েছিল সিমলা ব্যায়াম সমিতির পূজার আগেই। কিন্তু তখন এই পূজার নাম ছিল ভিন্ন এবং এটি ছিল একটি বারোয়ারী পূজা।
উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষ প্রাচীন এই সার্বজনীন দুর্গাপূজাটি কলকাতার তথা পশ্চিমবঙ্গের সাবেকি পূজাগুলির মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে থাকে। বাংলার প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নির্মিত প্রতিমা বাগবাজার সার্বজনীনকে এক অন্যমাত্রা দিয়েছে যে কারণে বাগবাজার সার্বজনীন দর্শনার্থী ও পুণ্যার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।
বাগবাজার সার্বজনীনের পুজোর সূচনা ঘটে ১৯১৯ সালে৷ এই পুজো শুরু হয়েছিলো স্থানীয় নেবুবাগান লেন ও বাগবাজার স্ট্রিটের মোড়ে ৫৫ নম্বর বাগবাজার স্ট্রিটে। তখন এই বারোয়ারী পূজার নাম ছিল ‘নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গা পুজো’। এখানেই কয়েক বছর পুজো হয়। ১৯২৪ সালে পুজোটি সরে যায় বাগবাজার স্ট্রিট ও পশুপতি বোস লেনের মোড়ে। পরের বছর ফের সরে যায় কাঁটাপুকুরে। ১৯২৭ সালেও স্থানান্তরিত হয় এই পুজো। ১৯২৭ সালে দুর্গাপুজো হয়েছিল বাগবাজার কালীমন্দিরে।
১৯৩০ সালে বিখ্যাত আইনজীবী তথা তৎকালীন কলকাতা পুরসভার কর্মচারী দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গাপূজাটি বর্তমান চেহারা পায়। নাম হয় ‘বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’। তাঁরই উদ্যোগে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গাপুজো উঠে আসে কর্পোরেশনের মাঠে। তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু সানন্দে এই অনুমতি দেন। শুধু পুরসভার মাঠ ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন তা-ই নয়, কলকাতা পুরসভা তখন বাগবাজারের এই পুজোয় চাঁদাও দিত। দুর্গাচরণের উদ্যোগে এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশীয় শিল্প সম্পর্কিত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী। সেখানে দেশীয় উদ্যোগগুলিকে আমন্ত্রণ করে জায়গা দেওয়া হত। ২০১৮ সালে এই পূজাটি শতবর্ষ সম্পূর্ণ করেছে।
১৯৩৬ সালে এই পুজোর সভাপতি হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বহু প্রথিতযশা ব্যক্তিদের নাম বাগবাজারের পুজোর সঙ্গে জড়িয়েছে। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার হরিশঙ্কর পাল প্রমুখ।
এরপরেই আসে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কুমোরটুলি সার্বজনীনের নাম। যদিও এই পূজার সাথে সুভাষচন্দ্র বসুর জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি বাঙালির দুর্গাপূজার ইতিহাসে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। এক পুরানো প্রথার অবসান ঘটিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু নিজে।
জাতীয়তাবাদী ভাবধারার জন্য আপামোর ভারতবাসীর হৃদয়ে গেঁথে রয়েছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ চিরকাল থাকবেনও৷ কিন্তু জানেন কী সচেতনভাবেই দুর্গার সংসার ভেঙেছিলেন তিনি? এই সংসার অপু-দুর্গার নয়৷ দেবী দুর্গার৷ ঠিকই পড়েছেন৷
বছর ঘুরে কৈলাস থেকে মর্ত্যে আসা দুর্গার ঐক্যবদ্ধ সংসারকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন নেতাজি৷ তবে সংসার ভাঙার পেছনে রয়েছে অন্য গল্প৷ দুর্গাপূজোর গরিমা রক্ষা করতে বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷
বাঙালির দুর্গাপূজোর গল্পে চমকের শেষ নেই৷ এটাও তেমনই একটি৷ তবে গল্প হলেও এই ঘটনা আদ্যপান্ত সত্যি৷ উত্তর কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পুজো কুমোরটুলি সার্বজনীন৷ কুমোরটুলির শিল্পীরা মিলেই এই পুজো শুরু করেন৷ পুজোর প্রথম সভাপতি ছিলেন স্যার হরিশংকর পাল৷ সাতবছর পর কমিটির পক্ষ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে পুজোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়৷
কিন্তু নেতাজির সাফ কথা, যেখানে ইংরেজের তাঁবেদারি হয় সেখানে তিনি কোনওভাবেই জড়াবেন না৷ স্যার হরিশংকর পালের দিকেই যে তাঁর এই ইঙ্গিত ছিল সেটা বুঝতে কারোর বাকি ছিল না৷ হরিশংকর পাল নিজেও বুঝেছিলেন নেতাজির কটাক্ষ৷ কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন তিনি৷ সেইবছরই অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে কুমোরটুলি সার্বজনীনের নতুন সভাপতি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷
কিন্তু পঞ্চমীর দিনই ঘটে গেল মহাবিপত্তি৷ মন্ডপে চলে এসেছে একচালার ঠাকুর (সেইসময় একচালার প্রতিমাই পুজো হত)৷ হঠাৎ বিকেলে মন্ডপে আগুন লেগে যায়৷ মন্ডপ, প্রতিমা, সব পুড়ে ছাই৷ অথচ পরের দিনই বোধন৷
নেতাজি ছুটে গেলেন শিল্পী গোপেশ্বর পালের কাছে৷ বললেন, যেভাবেই হোক এক রাতের মধ্যে ঠাকুর তৈরি করে দিতেই হবে৷ সেকথা শুনে তো শিল্পী অবাক৷ তা কি করে সম্ভব?
মুহূর্তের মধ্যে নেতাজি সিদ্ধান্ত নিলেন আলাদা আলাদা করে প্রতিমা গড়া হবে৷ জি পাল দুর্গা প্রতিমা গড়লেন৷ আর অন্যান্য শিল্পীরা গড়লেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ৷ একচালা ভেঙে তৈরি হল পাঁচ চালার ঠাকুর৷ এক রাতের মধ্যেই সব তৈরি৷ ষষ্ঠীর দিন মন্ডপে এল প্রথম পাঁচ চালার ঠাকুর৷ যা সম্ভব হয়েছিল নেতাজির জন্যই৷
পুজো কমিটির বহু পুরোনো সদস্যরা সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যম কে জানিয়েছিলেন, সেবার একেই তো পাঁচ চালা আর তার উপর দেবীর জমকালো সাজসজ্জা দেখে পুরোহিত সমাজ বেঁকে বসেছিল৷ তারপর শিল্পীর সঙ্গে বহু আলোচনার পর মেলে পুজোর পুরোহিত৷ তবে এটাই শেষ প্রথা ভাঙা ছিল না৷ পরের বছর নেতাজি পুজো কমিটির সভাপতি থাকাকালীন কুমোরটুলি সার্বজনীনের দেবী দুর্গার গায়ে উঠেছিল সত্যিকারের বাঘের ছাল৷ যদিও এখনকার দিনে হলে নিশ্চিতভাবে ‘পেটা’-র প্রতিবাদের মুখে পড়তে হত পুজো কমিটিকে৷
পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের থেকে জানা যায়, স্যার হরিশংকর পাল ওইবছরই (১৯৩৮) কমিটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কুমোরটুলি সার্বজনীনের পাশেই আলাদা করে একটি দুর্গাপুজো করেন৷ পরবর্তীকালে সেই পুজো হাটখোলা গোঁসাইপাড়ায় উঠে এসেছে৷
কলকাতার একাধিক বনেদি বাড়ির পুজোতে পদধূলি দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তেমনই একটি পূজা হল প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্রের বাড়ির দুর্গাপূজা। গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ যাঁর নামে, সেই গণেশ চন্দ্র চন্দ্রই শুরু করেছিলেন এ বাড়ির পুজো।
১৮৭৭ সালে এই পুজো শুরু হয়। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র নিজে বসে থেকে পুজোর তদারকি করতেন এক সময়। নদিয়া থেকে কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। চন্দ্রবাড়ি তার ঠাকুরদালানের জন্য বিখ্যাত। শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নকশায় বানানো এই দালান আজও স্বমহিমায় বর্তমান। দুর্গাপূজায় শাক্ত এবং বৈষ্ণব— দুই মতই অনুসরণ করেন চন্দ্রবাড়ির সদস্যেরা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ পুজো দেখতে আসতেন এ বাড়িতে।
এবারে উল্লেখ করতে হয় নেতাজির নিজের বাড়ির পূজার কথা। সোনারপুর কোদালিয়ার বসু বাড়ির পূজা।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ঠাকুরদা হরনাথ বোসের বাড়ির দুর্গাপূজা প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। তখনকার দিনে সোনারপুর কোদালিয়া এলাকায় দুর্গাপূজা বলতে এই বসু পরিবারের পুজোকেই বুঝত এবং সবাই সার্বজনীন পূজো হিসেবে এতে যোগদান করতেন। বহু দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামের মানুষজন ষষ্ঠী থেকে বিজয় দশমী পর্যন্ত তাঁদের নিজেদের পূজা হিসেবেই এই বসু বাড়ির পূজায় আসতেন।
এছাড়াও অষ্টমীর দিন অঞ্জলি এবং সন্ধি পূজায় সমস্ত গ্রামের মানুষ বসু পরিবারের ঠাকুর দালানের সামনে জড়ো হতেন। আজও বসু পরিবারের যাঁরা শরিক রয়েছেন, যারা দেশে বা বিদেশে থাকেন, এখনো পর্যন্ত অষ্টমীর দিন কোদালিয়ায় সুভাষচন্দ্র বসুর এই পৈত্রিক ভবনে সবাই একত্রিত হন। সন্ধি পূজার পর কেউ থেকে যান কেউ বা কেউ চলে যান।
পরিবারের যেসব সদস্য বা সদস্যা, যাঁরা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ছোটবেলায় দেখেছেন তাঁদের মুখ থেকে শোনা যে, এই দুর্গা পূজার সময় যদি তিনি জেলে বা বিদেশে না থাকতেন, তাহলে তিনি অষ্টমীর দিন সকাল থেকে সন্ধিপূজা পর্যন্ত এই বাড়ির ঠাকুরদালানে সময় কাটাতেন। অষ্টমীর অঞ্জলি থেকে সন্ধ্যা আরতি পর্যন্ত, সর্বক্ষণ তিনি বসু বাড়ির ঠাকুরদালানে থাকতেন। রাত্রে তিনি কোদালিয়া তে তাঁর নিজের যে পৈত্রিক ভবনটি রয়েছে সেখানে রাত্রি কাটাতেন।
এছাড়াও বসু পরিবারের সদস্য ও সদস্যাদের কাছ থেকে জানা যায় যে, যাঁরা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য লড়াই তে সামিল ছিলেন তাঁরাও এখানে সুভাষচন্দ্রের সাথে দেখা করতে আসতেন। যাঁদের ওপরে ব্রিটিশ সরকারের ও পুলিশের নজর ছিল তাঁরা গোপনে আসতেন রাতের বেলায়। সুভাষচন্দ্র তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন নিজের ঘরে। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁরা আবার কোদালিয়ার বসু বাড়ি ত্যাগ করতেন।
এতো গেল দুর্গাপূজার সাথে সুভাষচন্দ্র বসুর জড়িত থাকার কথা। এবারে উল্লেখ করতে হয় তাঁর কালীপূজার কথা। নাহলে এই লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের অধিকাংশ বিপ্লবীদের মত সুভাষচন্দ্রও ছিলেন শক্তি-উপাসক। সুভাষচন্দ্রের পুণ্যশীলা এবং ধর্মপ্রাণা মাতৃদেবী প্রভাবতী বসুর প্রভাবে রামকৃষ্ণদেবের প্রতি তিনি ছেলেবেলাতেই আকৃষ্ট হন। আর তার সাথেসাথে মা-কালী হলেন তাঁর আরাধ্য দেবী। স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণের আদর্শে অনুপ্রাণিত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সেই ছেলেবেলা থেকেই।
১৯১৪ সনের অক্টোবরের ৩ তারিখে প্রিয় বন্ধু হেমন্ত সরকারকে লেখা একটা চিঠিতে সুভাষচন্দ্র বসু, ঠাকুর রামকৃষ্ণের ছবি এঁকেছেন এভাবে,
“মনে পড়ে একটি চিত্র – কালীমন্দির দক্ষিণেশ্বরে। সন্মুখে খড়্গহস্তা মা-কালী – আনন্দময়ী – শিবের আসনের উপর অধিষ্ঠাতা – শতদলবাসিনী – তাঁর সন্মুখে একটি বালক – বালক হইতেও বালপ্রকৃতি – আধ-আধ স্বরে কাঁদিতেছে, এবং কাকে যেন ডেকে-ডেকে বলিতেছে – ‘মা, এই নাও তোমার ভালো, এই নাও তোমার মন্দ। এই নাও তোমার পাপ, এই নাও তোমার পুণ্য।’ করালমুখী ভীষণদ্রংষ্ট্রা মা অল্পেতে সন্তুষ্ট নয় – সব গ্রাস করিতে চায় – তাই ভালোও চাই, মন্দও চাই – পুণ্যও চাই, পাপও চাই, বালককে সবই দিতে হইবে – না দিলে শান্তি নাই – মা ছাড়িবে না।
বড় কষ্ট। মাকে সব দিতে হইবে। মা কিছুতেই সন্তুষ্ট না – তাই কাঁদিতেছে এবং বলিতেছে – ‘এই নাও, এই নাও’। দেখিতে দেখিতে অশ্রুধারা বন্ধ হইল – গণ্ডস্থল ও বক্ষ শুকাইল – হৃদয় জুড়াইল – হৃদয়ে আর কিছু নাই – যেখানে ভীষণ কণ্টক যন্ত্রণা দিতেছিল, তার চিহ্নও নাই – সবই শান্তিময়। হৃদয় মধুতে ভরিয়া গেল। বালক উঠিল।
বালকটি রামকৃষ্ণ।”
সুভাষচন্দ্র বসুর এই প্রসঙ্গে তাঁর বন্ধু দিলীপ কুমার রায় লিখেছেন,
“আমরণ ছিল সে শক্তিসাধক – কৈশোরেও গঙ্গাজলে নেমে আবৃত্তি করত স্বামী বিবেকানন্দের Kali the Mother থেকে,
Who dares misery, loves
And hugs the form of Death,
Dances in Destruction’s dance,
To him the Mother comes.
নির্ভয়ে যে বরি’ যন্ত্রণায়
প্রেমে করে মৃত্যু আলিঙ্গন,
নাচে মহাকাল-নৃত্য সাথে
তারে করে জননী বরণ।”
শ্রী সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ সুভাষচন্দ্রের সাথে বার্মার মান্দালয়ে কারারুদ্ধ ছিলেন। তিনি বলেছেন যে সুভাষচন্দ্র মান্দালয় কারাগারে রোজ মা-কালীর ধ্যান করতেন।
ডাঃ শিশিরকুমার বসু’র বক্তব্য অনুসারে, “১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সিঙ্গাপুর থেকে আমি তাঁর এক গোপন বার্তা পাই। তাঁর নিজের হাতে লেখা বার্তাটির ওপরে লেখা ছিল ‘শ্রীশ্রী কালিপূজা, ২৯শে অক্টোবর ১৯৪৩’। দেশের দশের কাজে আরাধ্য দেবীর কাছে নীরবে ও নিভৃতে আত্মনিবেদনের নিশ্চয়ই খুব গভীর তাৎপর্য আছে।”
এছাড়াও জানা যায় যে আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর থাকার সময় প্রায়ই যেতেন সেখানকার রামকৃষ্ণ মিশনে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গভীর রাতে। পোষাক বদলে পরে নিতেন পট্টবস্ত্র এবং এক দুই ঘন্টা বসে ধ্যান করতেন। সেই মিশনের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী ভাস্বরানন্দ বা বুদ্ধ মহারাজ গবেষক-লেখক শ্রী শঙ্করীপ্রসাদ বসুকে বলেছিলেন যে নেতাজী তাঁর কাছে তখনকার বহুল জনপ্রিয় ‘মা-কালীর পায়ের কাছে বসা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের’ ছবিটি চেয়ে নিয়েছিলেন।
কালীপূজা খুব কঠিন। অনেক নিয়ম কানুন। তাই বোধহয় কালী বা মাতৃসাধক সুভাষ চন্দ্র কালীপূজা না করে কালীর আরেক রূপে মা-দুর্গার আরাধনা বা পূজা করেছিলেন কারাগারে।
(তথ্যসূত্র:
১- বসু বাড়ি, শিশির কুমার বসু, পূর্ণ প্রকাশন (১৩৭২ বঙ্গাব্দ)।
২- সুভাষ থেকে নেতাজি, দিলীপ চাকী, আনন্দ প্রকাশন (২০১৪)।
৩- নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, পূরবী রায়, এশিয়ান পাবলিকেশন (২০১৮)।
৪- Netaji: A Pictorial Biography, Dr. Sisirkumar Bosu & Brirendra Nath Singh, Ananda Publishers.
৫- অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, শংকর, পোদ্দার বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত