“বোধন” শব্দের অর্থ হল “জাগরণ” বা “জাগানো”। পুরাণ অনুযায়ী উত্তরায়ণে (অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে) দেবদেবীরা জেগেই থাকন। আর দক্ষিণায়ণের (অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে) সময় হল তাঁদের নিদ্রার সময়। দক্ষিণায়ণের এই ছ’ মাস হল- শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ। এ সময় তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই তাঁদের জাগানোর জন্য বোধনের প্রয়োজন হয়। এখন তাঁকে হঠাৎ জাগানোর প্রয়োজন কেন হল, সে কথায় আসা যাক।
©️রানা চক্রবর্তী©️
কৃত্তিবাস ওঝা লিখিত রামায়ণের ব্যাখ্যা অনুযায়ী (মহর্ষি বাল্মীকি লিখিত রামায়ণে অকাল বোধনের কোনও উল্লেখ নেই), রাবণ সীতাকে হরণ করার পর সীতা উদ্ধারের আশায় রামচন্দ্র বানরসেনা-সহ উপস্থিত হন লঙ্কায়। সেখানে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রাবনের উগ্ররূপ দেখে চিন্তায় পড়েন। রাম জানতেন না যে, রাবণ দেবাদিদেব মহাদেবকে কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট করে বর লাভ করেছেন। আর সেই সঙ্গে তিনি দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপেরও উপাসনা করেন। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে কালী স্বয়ং তাঁকে নিজের কোলে স্থান দেন। তাই রাবণকে যুদ্ধে হারানো অসম্ভব। এ দিকে রাবণ বধ না হলে তো সীতা উদ্ধারের আশা নেই। রামের এই অবস্থায় স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হন। কারণ রামই একমাত্র রাবণ বধ করতে পারবেন, এমনটাই দৈবববাণী হয়েছে। তা হলে উপায়? দেবরাজ প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে গিয়ে পরিস্থিতির বর্ণনা করে এর থেকে উদ্ধারের উপায় জিজ্ঞাসা করেন। ব্রহ্মা তখন নিজে দেবী দুর্গার পুজো করে তাঁকে সন্তুষ্ট করে উপায় জিজ্ঞাসা করেন। দেবী তখন বলেন, রামচন্দ্রকে অকাল বোধন করে দেবীর পুজো সম্পন্ন করতে হবে। তা হলে তিনি রাবণকে বধ করার জন্য রামকে সাহায্য করবেন।
ব্রহ্মা এবং দেবরাজ ইন্দ্র গিয়ে রামচন্দ্রকে দেবীর ইচ্ছা বলেন। দেবীর ইচ্ছা অনুযায়ী রাম নিজে হাতে দেবীর মূর্তি গড়ে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর বোধন করেন। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে যথাযথ বিধি পালন করে দেবীর পুজো সম্পন্ন করেন। কিন্তু দেবী তখনও রামকে দেখা দেন না। তপস্যায় ফল না পেয়ে রাম অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। সে সময় বিভীষণ বলেন, ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর আরাধনা করলে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন। কথানুযায়ী তিনি হনুমানকে দেবীদহ (দেব-দেবীদের হ্রদ) থেকে ১০৮টি নীলপদ্ম আনতে বলেন। যথাসময়ে হনুমান সেখান থেকে ১০৮টি নীলপদ্ম এনে দেন। পুজোয় বসে যখন পদ্মফুল দিয়ে দেবীর আরাধনা শুরু করেন, তখন রামচন্দ্র দেখেন সেখানে ১০৭টি পদ্ম রয়েছে। কিন্তু পুজো তো তাঁকে শেষ করতেই হবে। উপায়ান্তর না দেখে তিনি দেবীকে বলেন, তাঁর চোখকে নাকি সকলে নীলপদ্মের সঙ্গে তুলনা করেন। তাই ১টি পদ্ম না পাওয়া গেলে তিনি একটি চোখ উপড়ে দেবীর পায়ে নিবেদন করবেন। আসলে দেবী দুর্গাই একটি পদ্ম লুকিয়ে রামের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন, যে রাম দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য কতটা ব্যাকুল। শেষমেশ রাম যখন ধনুক নিয়ে নিজের চোখে তির মারতে উদ্যত হলেন, তখন দেবী সিংহবাহিনী রূপে প্রকট হন। এর পর রামচন্দ্র পুজো সম্পন্ন করে দেবীরর আশীর্বাদ লাভ করেন এবং রাবণকে বধ করতে সমর্থ হন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে কথিত আছে, রাবণ বসন্তকালে দেবীর আরাধনা করতেন। যেটাকে আমরা বাসন্তী পুজো হিসেবেই সবাই জানি। এটাই নাকি দেবীর আরাধনার আসল সময়, কারণ এ সময় তিনি জেগে থাকেন। তাই এই পুজোয় বোধনের প্রয়োজন হয় না।
©️রানা চক্রবর্তী©️
অকাল বোধনের উল্লেখ ভাগবতেও পাওয়া যায়। সেখানে বলা আছে, রাবণ বধের জন্য ব্রহ্মাই নাকি প্রথমে দেবীর আরাধনা করেন। পরে রামচন্দ্র যখন দুর্গা পুজোর আয়োজন করেন, তখন ব্রহ্মার নির্দেশে তাঁর মানসপুত্র দেবর্ষি নারদ। নারদের পরামর্শ মতো আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে দেবীর পুজো করেন। পুজোয় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী রাবণ-সহ অন্যান্য অসুরদের নিধনে রামকে সাহায্য করেন।
©️রানা চক্রবর্তী©️
অকাল বোধন নিয়ে আরও অনেক ব্যাখা রয়েছে। তবে রামচন্দ্রের পুজোকেই এর উৎস বলে ভাবতে বোধ হয় ভালো লাগে। কারণ, শুভশক্তির উদয় দেখতেই তো সবাই পছন্দ করেন। সে যে ভাবেই হোক, ‘অকালে’ই পুজোর প্রচলন হল, আর ক্রমে তা হয়ে উঠল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের যে প্রান্তে বাঙালিরা থাকেন, সেখানেই শরৎকালে ঢাকের বাজনা বেজে ওঠে। সত্যি যদি নাও বাজে, মনে তো বাজবেই। এর সঙ্গে যে সবার হৃদয়ের সম্পর্ক।
©️রানা চক্রবর্তী©️
(তথ্যসূত্র:
১- দুর্গোৎসবের উৎস সন্ধানে, অব্জ কেশব কর, দে’জ পাবলিশিং।
২- বাংলায় পটের দুর্গা, দীপঙ্কর ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
৩- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত,মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১৬)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত