আজ মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা। রোজকার নিয়ম বদ্ধ জীবনে বাঙালিয়ানা হারাতে বসলেও হারায়নি সবটা। এখনো পুজো, মহালয়াতে উদ্বেল হয় বাঙালি। আর মহালয়ার ভোর মানেই রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত স্বরে বেজে ওঠা, “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জি, ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত; জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা…”। আর মহালয়ার ভোর মানেই গঙ্গার ঘাটে ঘাটে স্বর্গীয় পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা। পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানোর ভিড় সামাল দিতে গঙ্গার ঘাটে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা।
এবারে শরতের আকাশ কিছুটা হলেও বদলে গিয়েছে। পুজোর আগের চেনা রোদ্দুর নেই। পরিবর্তে সকাল থেকে চলছে মেঘ–রোদ্দুরের লুকোচুরি। শিউলি ফুলও কিছুটা অমিল। তবুও বাঙালির মহালয়ার সকালের কোনও বদল নেই। তাই তো ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন আমবাঙালি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠে মুখরিত প্রতিটি বাঙালির ঘর। অমাবস্যার অন্ধকার কেটে সূর্যের প্রথম রশ্মিতে অবসান পিতৃপক্ষের। সূচনা হয়েছে দেবীপক্ষের। এই দিনটিতে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তর্পণ করেন অনেকেই। তাই সকাল থেকে বহু মানুষের জমায়েত গঙ্গায়। ভোর থেকে পা ফেলার জায়গা নেই বাগবাজার, শোভাবাজার, আহিরীটোলা, সহ গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে। আর তো মাত্র ক’টা দিন তারপরেই শহরজুড়ে আনন্দযজ্ঞ। বছর ঘুরে মা ফিরছেন তাঁর বাপের বাড়িতে…
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে, তোমার ওই বাদল বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে’! তর্পণের মন্ত্রেও সবার কথাই বলা হয়। ‘‘চাইলে অনাত্মীয় বা সন্তানহীন কোনও প্রিয়জনকেও স্মরণ করা যায়।’’— বলছেন প্রবীণ পুরোহিত শম্ভুনাথ ভট্টাচার্য স্মৃতিতীর্থ। বিগত জন্মের বা কোটি-কোটি বছর পিছনের চেনা-জানা— সবার স্মরণেই মন্ত্র রয়েছে। শেক্সপিয়রের ‘নামে কি বা আসে যায়’-এর তত্ত্বও তর্পণের বেলায় খাটে। নাম-গোত্র জানা না-থাকলে বা মনে না-পড়লে ‘যথা নাম’ বলে মন্ত্রোচ্চারণের রীতি শোনা যায়।
মহালয়া আদতে বড্ড নস্ট্যালজিক। যে সমস্ত মানুষ কোনও দিনও ভোরে ওঠে না আজ তারাও ঘুম চোখে রেডিও চালায়। বীরেন বাবুর কণ্ঠে যখন দেবী আবাহন চলে কিরকম এক বুক চিনচিন অনুভূতি হয় সব বাঙালির। এ কোনো স্তুতি, নাকি অপরিমেয় ভক্তি-নাদ, নাকি নিছকই ভালোলাগা, তা বোধহয় এখনও ঠাওর করে উঠতে পারেননা আপামর বাঙালি জাতি। শুধু তাই নয়, জাতপাত-শ্রেনী বৈষম্য-আমরা-ওরা অদূরে রেখে বছর বছর ধরে বাঙালীর মহোত্সব দুর্গাপূজোর শুভারম্ভ হয়ে যায় ‘মহালয়া’ থেকেই। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ কথাটা হলফ করে বলাই যায়, মহালয়া ও দুর্গাপুজার আক্ষরিক অর্থই হয়ে উঠেছে, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অনতিমন্দ্র উচ্চারণে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, সুপ্রীতি ঘোষের আগমনি-গাথা ‘বাজলো তোমার আলোর বেনু, মাতল যে ভুবন…আজ প্রভাতে সে সুর শুনে খুলে দিনু মন’ , দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের করুনাঘন ‘জাগো দুর্গা…জাগো দশপ্রহরণধারিনী…অভয় শক্তি বলপ্রদায়ীনি তুমি জাগো’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বন্দনা ‘তব অচিন্ত রুপ চরিত মহিমা, নব শোভা নব ধ্যান রুপায়িত প্রতিমা…বিকশিল জ্যোতি প্রীতি মঙ্গলা বরণে’।
আর শুধু তর্পণ নয়, বাঙালির দুর্গাপূজায় এই মহালয়া তিথিতেই তো দেবী প্রতিমার চক্ষুদান করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই রীতি মেনে আজও বালুরঘাটে মহালয়া তিথিতেই দুর্গা প্রতিমার চক্ষুদান করেন মৃৎশিল্পীরা। শাস্ত্র মতে মহালয় থাকে ঘোর অমাবস্যা। এদিন মর্ত্যে দেবীর আগমন এর সাথে সাথেই সূচনা হয় মাতৃপক্ষের।
উল্লেখ্য, গঙ্গার ঘাটে ঘাটে তর্পণ করতে আসা মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে কলকাতা পুলিশ৷ মহালয়ার সকালে তর্পণের সময় দুর্ঘটনা এড়াতে ঘাটগুলিতে মোতায়েন করা হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। ঘাটের আশেপাশেই রয়েছে ডুবুরি। গঙ্গায় টহলদারি চালাচ্ছে কলকাতা রিভার ট্রাফিক পুলিশ। ঘাটের চতুর্দিকে দড়ি, বাঁশ নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে মাঝিদের।মহালয়ার দিন ভোরে গঙ্গা সংলগ্ন রাস্তাগুলিতে কিছুটা যানজট সৃষ্টি হয়। এই যানজট ঠেকাতে কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ যান চলাচলের জন্য কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যেমন, ভোর চারটে থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত স্ট্র্যান্ড রোড ও সেন্ট জাজেস গেট রোডে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকছে। পাশাপাশি শোভাবাজার স্ট্রিট, খগেন চ্যাটার্জি রোড, নিমতলা ঘাট স্ট্রিট, বি কে পাল অ্যাভিনিউ, কাশীপুর রোড, স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোডের মতো রাস্তাতেও ওই সময় পণ্যবাহী যান চলাচলে করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।