সারাদিন ধরে আকাশ মুখ গোমড়া করে আছে। পুজোর প্রাক্কালে রোদ-মেঘের খেলায় মেতে উঠেছে প্রকৃতি। সেইরকমই এক দিনে কলকাতার বুকে ঘটে এক প্রতিবাদী জমায়েত। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সমাজে মেয়েদের কিরকম ‘কুরুচি’ প্রসন করা হয় তা কয়েকদিনের ফেসবুকের দেওয়াল দেখলেই বোঝা গেছে। সেইরকমই একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ছিল এক প্রতিবাদের ডাক। সেই জমায়েতে ছিল না কোনো স্লোগান, না কোনও ব্যানার , না দল। থাকার মধ্যে ছিল, একরাশ ঘেন্না থেকে জন্মানো ওইরকম এক ফেসবুক পোস্ট। সে পোস্টে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে জমায়েতে পা মিলিয়েছেন শহরবাসী।
শুক্রবার বিকেল পাঁচটা, অ্যাকাডেমি চত্বর। একটু একটু করে ভিড় জমতে শুরু করল নানা বয়সি মানুষের। মহিলারা বেশি, পুরুষের সংখ্যা তুলনায় কম। আর পাঁচটা জমায়েতের থেকে, এ জমায়েত আলাদা। এ জমায়েত গলা তুলতে এসেছে, দিনের পর দিন মেয়েদের প্রতি বেড়ে ওঠা সাইবার ট্রোলিংয়ের বিরুদ্ধে। না, ট্রোলিং নতুন নয়। তবে সম্প্রতি বাচিকশিল্পী ঊর্মিমালা বসুর প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায় যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বয়স, লিঙ্গ, পেশা নির্বিশেষে চিৎকার করে উঠেছেন সকলে, ‘আমিও যৌনদাসী!’ তাই ফেসবুকে পোস্ট করা ইভেন্টের ডাকেই প্রতিবাদে ভিড় করলেন এত মানুষ।
প্রসঙ্গত, দিন কয়েক আগে ঊর্মিমালা বসুর নাম এবং ছবি দিয়ে, ঠিক এই ভাষাতেই কদর্য একটি মিম তৈরি করে ভাইরাল করা হয়েছে অনলাইনে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন নেটিজেনরা। ঊর্মিমালার ‘অপরাধ’, সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবুল সুপ্রিয়কে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ নিয়ে একটি পোস্ট শেয়ার করেছিলেন ফেসবুকে। তার পর থেকেই শুরু হয় নোংরা আক্রমণ। শেষমেশ তাঁকে দেগে দেওয়া হয় ‘বামপন্থীদের যৌনদাসী’ বলে।
ঊর্মিমালা নিজে জানান, ৭৩ বছর বয়সে এসে এরকম কুরুচিপূর্ণ আক্রমণ তাঁর পক্ষে বেদনাদায়ক। তিনি নিজের জন্য নয়, তরুণী মেয়েদের জন্য শঙ্কিত। তবে তিনি এটাও জানান, এ আঘাত তাঁকে কষ্ট দিয়েছে কেবল। কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তাঁর।
এর পরেই কলকাতার ফেসবুক মহলের এক পরিচিত মুখ, মিতুল দত্ত সোশ্যাল মিডিয়াতেই ডাক দেন পথসভা. জমায়েতের। আজ, শুক্রবার, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে সেই মুক্ত মঞ্চেই জড়ো হয়েছিলেন সকলে। এসেছিলেন ঊর্মিমালা নিজে। ছিলেন তাঁর স্বামী, বাচিক শিল্পী জগন্নাথ বসু। ছিলেন গায়ক শ্রীকান্ত আচার্য, অভিনেত্রী খেয়ালি ঘোষদস্তিদার, কবি মন্দাক্রান্তা সেন প্রমুখ।
ঊর্মিমালা বসু এ দিন বললেন, “এই শব্দটি, যৌনদাসী, আমায় অপমানিত করেছে ঠিকই। কিন্তু এ অপমান আমার একার নয়। এ অপমান রোজ ঘটছে কারও না কারও সঙ্গে। তাই অপমানে কণ্ঠ রুদ্ধ করা চলবে না। বরং এটাই সময়, আরও বেশি করে জোট বাঁধার।” তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করে দেন, যে কোনও অসম-লডা়ইয়ে তিনি নিজ নির্ধারিত পক্ষে থাকবেন চিরকাল। বুক চিতিয়ে। এ সব অপমান তাঁকে রুখতে পারবে না। যে কোনও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে গলা তোলার প্রয়োজন তিনি মনে করছেন ভীষণ ভাবে। তাই এই অপমান যেন সেই প্রয়োজনকেই আরও জোরদার ধাক্কা দিল! তবে শুধু নিজের জন্যই এই প্রয়োজন নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও অনালইনে যে কুরুচিপূর্ণ মিম, জোক, ভিডিও তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তা-ও রুখতে হবে বলে জানান তিনি। এ অপমান রাজনৈতিক পরিচয় বা ধর্ম বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে, নারীত্বের অবমাননা। গোটা সমাজের অবমাননা। সেই বার্তা আজ কানে কানে ঘুরছে জমায়েত মানুষের মনে। ছড়িয়ে পড়বে ফেসবুকের দেওয়ালে।