বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যে একতরফা নিগ্রহের শিকার হননি, ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবি সে কথাই বলছে। বাবুল যে মেজাজ হারিয়েছেন, কনুই উঁচিয়ে এক ছাত্রীকে আঘাত করেছেন ফ্রেমবন্দী হয়েছে তাও। এমনকী ছাত্রীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময়েও তাঁদের উদ্দেশ্যে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন বাবুল। কিন্তু তারপরেও সমস্ত দায় পড়ুয়াদের ঘাড়ে চাপিয়ে, তিনি পুলিশে অভিযোগ দায়ের করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। যাকে ‘গান্ধীগিরি’ করে লাইমলাইটে আসার চেষ্টা বলছেন পড়ুয়াদের অধিকাংশই। তবে বাবুল ‘গান্ধীগিরি’ করলেও তাঁর দল তথা গেরুয়া শিবিরের একাংশ কিন্তু সেদিনের বিক্ষোভকারী পড়ুয়াদের চিহ্নিত করে হুঁশিয়ারি, ধর্ষণের হুমকি এমনকী পিটিয়ে মারার হুমকি দিচ্ছে। এবার এমনই অভিযোগ উঠেছে।
এই পরিস্থিতিতে বাড়ি থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসুকে উপাচার্য সুরঞ্জন দাস ভীত-সন্ত্রস্ত পড়ুয়াদের তালিকা প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তা নিয়ে তিনি প্রশাসনের দ্বারস্থ হবেন বলে উপাচার্য জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থাতেও পড়ুয়াদের খোঁজ নিয়েছিলেন সুরঞ্জন। শনিবার তিনি বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু এখনও তিনি পুরোপুরি সুস্থ বোধ করছেন না। তবে আজ, সোমবার ক্যাম্পাসে তিনি যেতে পারেন বলে খবর। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির আবহে সুরঞ্জন অবশ্য মহাত্মা গান্ধীরই শরণাপন্ন। তাঁর কথায়, ‘আমরা কেউই যেন গান্ধীজির অহিংসার আদর্শ ভুলে না-যাই। তিনি সারা জীবন অহিংস পথে আন্দোলন করেছেন। আমার আবেদন, সেই কথা মাথায় রেখে যেন সবাই চলেন।’
বাবুলের ‘মহানুভবতা’র পরও যাদবপুরের পড়ুয়া-প্রাক্তনীদের রাস্তাঘাটে নিগ্রহ হতে হচ্ছে। নেটে অশালীন পোস্ট, ধর্ষণ, খুন এমনকী পিটিয়ে মারার হুমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। কেবল যাদবপুরের পড়ার অভিযোগে এক পড়ুয়াকে প্রকাশ্য রাস্তায় প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবোস করানো হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। এমনকী, পড়ুয়াদের পিছু নিয়ে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেওয়ায় কাঠগড়ায় উঠেছে গেরুয়া শিবির। যদিও এবিভিপির পাল্টা অভিযোগ, যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা তাদের সদস্য-কর্মীদের হুমকি দিচ্ছেন। এ নিয়ে এবিভিপির রাজ্য সহ-সভাপতি সুবীর হালদারের হুঁশিয়ারি, ‘ওরা আমাদের সদস্য-ছাত্রদের ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে। এখনও না-শোধরালে সব ক’টার ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে দেব। চাকরি বা উচ্চশিক্ষায় ভিন রাজ্যে গিয়ে ওরা মার খেলে তার দায় নেব না।’
উল্লেখ্য, ‘নিগৃহীত’ হওয়ার দিন থেকেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেছেন, তিনি কোনও পড়ুয়ার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করবেন না। পড়ুয়াদের একাংশ অবশ্য বাবুল ও গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর ‘গান্ধীগিরি’র পরেও দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসুরা ‘যাদবপুরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করে ছাত্র পেটানো হবে বলে বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। ফলে, বাবুলের ক্ষমা প্রদর্শনকে আসলে ‘অভিনয়’ বলেই ধরে নিচ্ছেন অনেকে। পড়ুয়াদের একাংশের বক্তব্য, তাঁর চুল ধরে টেনেছেন বলে অভিযোগ করে বাবুল যে ছাত্রের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। প্রথমে ফেসবুকে তাঁকে হুমকি দেওয়ার পরে তাঁর বর্ধমানের বাড়িতে চলে যান এবিভিপির দুই সদস্য। তারপর তাঁর মায়ের কান্না ও আবেদনের ভিডিও তুলে ফের ফেসবুকেই ভাইরাল করা হয়।
তার পরদিনই মন্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ভিডিওটি দিয়ে বলেন, ‘চিন্তা করবেন না মাসিমা, আমি আপনার ছেলের কোনও ক্ষতি করব না।’ ফলে, ওই ছাত্রের বন্ধুদের অভিযোগ, ছক কষে চাপ তৈরি করার পর বাবুল ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ তোলার জন্য পরে ক্ষমার কথা বলছেন। তাঁর প্রশ্ন, ক্ষমা করাই উদ্দেশ্য হলে তিনি ওই ছাত্রের ছবি শেয়ার করলেন কেন? এছাড়া গত তিন-চার দিনে যাদবপুরের একাধিক ছাত্রছাত্রীকে রাস্তাঘাটে অজানা, অচেনা মানুষের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছে। ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্রী যাদবপুরে পড়েন শুনেই ক্ষিপ্ত কয়েক জন প্রকাশ্য রাস্তায় তাঁকে এমন মারধর করে যে, তিনি এখনও আতঙ্কগ্রস্ত।
পাশাপাশি, দর্শন বিভাগের এক ছাত্রীকে চিহ্নিত করে তাঁর পিছু নেওয়া এমনকী সামাজিক মাধ্যমে অশালীন কথা বলা থেকে খুন, ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই ছাত্রী পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। সম্প্রতি একটি ভিডিয়ো ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে এক ছাত্রকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যাদবপুরে পড়াশোনা করে বলে কান ধরে ওঠবোস করানো হচ্ছে- এমনটাই দাবি। বাংলার ছাত্রী উষসী পালের বক্তব্য, ‘সে দিন ক্যাম্পাসেও বাবুল সুপ্রিয় এমন ভাবেই অসভ্যতা করেছেন। হুমকি দিয়েছেন। ওঁর মিষ্টি ভাষণের নেপথ্যে রয়েছে হিংসার বিষ। ওঁরা এ রকমই।’