বাংলার ছাত্র আন্দোলনের লড়াকু ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনেছে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা। এজন্য তোমাদের অভিনন্দন। ছাত্রছাত্রীদের হাতে ধরা একটা পোস্টারে দেখলাম লেখা রয়েছে – ভাজিনি চপ পুষিনি গরু/ আসল লড়াই এবার শুরু। আমার প্রশ্ন এই আসল লড়াই তোমরা শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাতে সীমাবদ্ধ রাখবে, নাকি মানুষের সুস্থ ও স্বচ্ছভাবে বাঁচার অধিকারের লড়াইয়ে সামিল হয়ে তা ছড়িয়ে দেবে ক্যাম্পাসের বাইরেও?
বেশ কিছুদিন ধরে একটা জিনিস লক্ষ্য করছি বাংলার ছাত্র রাজনীতি কিছুতেই আর ক্যাম্পাসের বাইরে বেরোচ্ছে না। তোমাদের দাবিদাওয়াগুলোর মধ্যে বৃহত্তর রাজনীতির প্রেক্ষিতটা মাঝেসাঝে উঁকি দিলেও তা শুধু স্লোগান ও পোস্টারের মধ্যে আটকে থাকে! বাংলার ছাত্র আন্দোলন কিন্তু বারবার ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির সঙ্গে ছাত্রদের যুক্ত করতে চেয়েছে। বাংলা পথ দেখিয়েছে সারা দেশকে। নিজের ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি অতীতে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনও কিন্তু এই গৌরবের অংশীদার ছিল। এখন কিন্তু তা আর দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ তো রাজনীতিও শেষ! তারপরে সবাই দেশ, দশ সবকিছু ভুলে গিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটা কেন হচ্ছে এর উত্তর আজকের ছাত্র রাজনীতিকেই দিতে হবে।
অথচ বিজেপির শাসনে আজ দেশের মানুষের যে চরম দূরাবস্থা চলছে সেসময় দেশের ছাত্রদের বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলিতে আরও বেশি সরব হওয়া উচিৎ ছিল। ছাত্র থাকার সময়ে যাদবপুর সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের দেশকে শোষণমুক্ত করার লড়াইয়ে জড়িয়ে শহীদ হতে বা কারাবাস করতে দেখেছি। এখনকার ছাত্র আন্দোলনে সেই তেজি মুখগুলি যেন প্রায় হারিয়ে গেছে। ছাত্ররা সামাজিক জীব, তাই বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষিত ছাড়া ছাত্র রাজনীতি বাড়তে পারে না। যে ঝকঝকে তেজি চোখমুখের ছেলেমেয়েরা স্লোগান দিচ্ছিলে, প্রতিবাদ জানাচ্ছিলে বাবুলের প্ররোচনা ও এবিভিপির সন্ত্রাসের, তারা কথাগুলো একটু ভেবে দেখবে। বিস্তৃত না হলে, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না হলে কোন লড়াইয়েরই অর্থ থাকে না।
ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন থেকে আজকের ছাত্র রাজনীতিকে বেরোতেই হবে। দেশে এখন এমন অনেক কিছু আছে যা নিয়ে আবার হতে পারে ‘হোক কলরবের’ মত আন্দোলন। তার জন্য ছাত্রছাত্রীদের টিএমসি, কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম, সিপিআইএমএল কিছুই হওয়ার দরকার নেই। তোমরা যারা ছাত্র রাজনীতি করছো তারা শুধুই ক্যাম্পাস রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের পথ দেখাও। যে ৪ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছো অন্তত সেই বছরগুলিতে বলো মানুষের কথা। গরিব মানুষদের, আদিবাসীদের, পরিবেশের, দেশের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর বিষয়গুলো নিয়ে তোমাদের এখন আরও বেশি সরব হতে হবে।
এনআরসি তো একটা বিরাট ইস্যু। বাংলার ছাত্র সমাজ এ বিষয়টি নিয়ে এখনও কেন মুখ খুলছে না তা ভেবে আমার নিজের খুব অবাক লাগে। এই রাজনৈতিক খেলাটাতে কত ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে তা কল্পনা করাও কঠিন। বাবুল-কাবুল-হাবুলদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের থেকেও এর প্রতিবাদ করা আরও বেশি জরুরি।
বাবুল কুপ্রিয়র (সুপ্রিয়টা না বলাই ভাল) বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছাত্র রাজনীতির একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এই বিক্ষোভ যেন শারীরিক আক্রমণে না যায়। আমি এর তীব্র বিরোধিতা করি। আবার বাবুলকেও এমন পরিস্থিতিতে মেজাজ না হারিয়ে সংযত থাকতে হবে। ভাববে না আমি কোন জ্ঞান দিচ্ছি। এই কাজগুলো কিন্তু যে কোন ইতিবাচক আন্দোলনের গায়ে কালি ছিটিয়ে দিতে পারে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন যেন যাদবপুর থানার মোড় আর টিভির সাংবাদিকদের বুম ও ক্যামেরার সামনেই হারিয়ে না যায়। এ ঘটনা কিন্তু ঘটছে। বন্ধ করতে হবে যখন তখন পথ অবরোধ। তাতে প্রচার বাড়লেও মানুষের বিরক্তি আরও বাড়ে। আমি নিজে খুব ছোটবেলায় বীরভূমের তুমবনি লালপাহাড়ির রামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকে অতিবাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মহারাজদের অপমান করা হয় এমন কোন কাজ করিনি। আজকের ছাত্র রাজনীতি আমার মনে হয় অকারণে একটু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, মানুষের অসুবিধা ততটা ভাবে না। ভুলে যায় তাদের ঘেরাও বা অবরোধে যাদের অসুবিধা হচ্ছে তারাও কিন্তু ছাত্রদের ন্যায্য দাবিগুলোর সমর্থক।
সাদা বাড়ি কালো গ্রিলের (আনন্দবাজার) কাগজে গতকাল একটা ছবি দেখলাম – জেএনইউতে সীতারাম ইয়েচুরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইন্দিরা গান্ধীর সামনে ছাত্র আন্দোলনের দাবিগুলো পড়ে শোনাচ্ছেন। এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল উপাচার্যের পদত্যাগ। তিনি তা শোনেন এবং পরদিন পদত্যাগ করেন। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র উভয়পক্ষই ইদানিং বেশ অসহিষ্ণু। দুপক্ষই ভুলে যাচ্ছে বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের বলা সে কথাটা – তুমি যা বলছো আমার তাতে অমত থাকতেই পারে কিন্তু তোমার বলার অধিকার আমি প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবো।
তোমাদের লড়াই যেন আমাদের রাজনীতিকে টিভির বুম ও ঘন্টাখানেকের ঝগড়া, কাটমানি আর একশ্রেনির সাংবাদিকদের লক্ষ্যহীন চাটুকারিতার বাইরে নিয়ে আসতে পারে। দেশের মানুষের দাবি ও অধিকারগুলির লড়াইয়ে আরও বেশি করে সামিল হও তোমরা। তোমাদের আন্দোলনে উঠে আসুক আরও বৃহত্তর জীবনের কলরব। ছাত্ররা এগিয়ে না এলে কোন লড়াই গতি পায় না। ‘হোক কলরব’ মিশে যাক জীবনের কলরবের সঙ্গে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত