আকাশ পানে চাইলেই সাদা মেঘের ভেলা আর মাঠে-ঘাটে কাশ ফুলের মাথা দোলানো জানান দিচ্ছে যে আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। তারপরেই ঘরে ফিরবে ঘরের মেয়ে। শুরু হবে শারদোৎসব। যদিও শারদোৎসব মানেই এখন ‘পুজোর রাজ্যে পৃথিবী থিমময়’। কিন্তু শহরজোড়া এই থিমের ঘনঘটার মধ্যেও যেসব পুজোগুলি এখনও নিজেদের সাবেকিয়ানা ধরে রেখেছে, তাদের মধ্যে অগ্রণী বাগবাজার সর্বজনীন। আজও নিজের সনাতনি ঐতিহ্য, সাবেকিয়ানা থেকে এতটুকু সরে আসেনি বাগবাজার সর্বজনীনের পুজো। কিন্তু হালফিলের থিমের ঝলকানিতেও সনাতনী জৌলুস এতটুকু কমেনি ১০০ বছরের প্রাচীন এই পুজোর।
১৯১৯ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ার ১২ জন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে নেবুবাগান লেন ও বাগবাজার স্ট্রিটের মোড়ে ৫৫ নম্বর বাগবাজার স্ট্রিটে এই পুজো শুরু করেন। তখন নাম ছিল ‘নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজো’। এখানেই কয়েক বছর পুজো হওয়ার পর ১৯২৪ সালে পুজোটি সরে যায় বাগবাজার স্ট্রিট ও পশুপতি বোস লেনের মোড়ে। এর পর স্থান পরিবর্তন হতে হতে ১৯৩০ সালে বিখ্যাত আইনজীবী তথা তৎকালীন কলকাতা পুরসভার কর্তা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এবং তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসুর অনুমতিতে পুজো উঠে আসে কর্পোরেশনের মাঠে। নাম হয় ‘বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’। ১৯৩৮-৩৯ সালে এই পুজোর সভাপতিও ছিলেন নেতাজি।
তবে এখন বলরাম বসু ঘাটের ওপরে জোড়া শিবমন্দিরের পাশেই তৈরি করে নেওয়া হয়েছে চন্ডীমন্ডপ। সেখানেই হয় পুজো। থিমের চমক না থাকলেও প্রতি বছরই বাগবাজারের পুজো দেখতে ভিড় জমান লক্ষাধিক দর্শনার্থী। কারণ এই পুজোর প্রাণভোমরা হল নজরকাড়া মাতৃপ্রতিমা। মা এখানে একচালাতেই সনাতনী রূপে বিরাজমান। তাঁর গায়ের রং অতসী। পরনে ডাকের সাজ। বরাবরই এই একই প্রতিমা গড়ে আসছে তারা। তবু ফি-বছর সেই একই প্রতিমা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান বাগবাজারের মণ্ডপে। সেই মন্ডপের ধরণও চিরাচরিত।
এ প্রসঙ্গে বাগবাজারের পুজোর সহ সভাপতি অভয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসবে নতুনত্বের চমক বলে কিছু থাকে না। কারণ এখানে প্রথম থেকেই সাবেকি মতে পুজো করে আসছি আমরা। বছর বছর যারা থিম পালটায়, নানা রকমের আঙ্গিক আনে মন্ডপ ও প্রতিমায়, তারা হয়ত বলতে পারে নতুন ভাবে কী করছে। কিন্তু আমাদের যা হয়ে আসছে গত ১০০ বছর ধরে, এবারও তাই-ই হবে। তবে আমরা প্রবীণ হলেও নতুন প্রজন্ম আমাদের এই প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দেয়। তাদের কাছ থেকে বা বাগবাজার অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে থিম পুজোর দাবি আসেই না। আর তাই আমরা পুজোকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিই। লক্ষ্যের থেকে উপলক্ষ্য যাতে না বড় হয়ে যায়, আমরা সেদিকে লক্ষ্য রাখি।’
অভয়বাবু জানান, ‘আমাদের প্রতিমা শিল্পী নারায়ণ পাল। শিল্পী জিতেন পাল আমাদের প্রতিমা গড়তেন। তাঁর মৃত্যুর পর বংশপরম্পরা মেনে কার্তিক পাল এবং কার্তিক পালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নারায়ণ পালই এখন আমাদের প্রতিমা গড়েন। মন্ডপ গড়ছে মেদিনীপুরের মা শীতলা ডেকরেটর।’ পুজোর বৈশিষ্ট্যর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পুজোয় আমাদের একটা প্রদর্শনী থাকে। ১৯৩৮-৩৯ সালে নেতাজি যখন আমাদের পুজোর সভাপতি ছিলেন, তখন তাঁর উদ্যোগে এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরামর্শে সেই প্রদর্শনীর শুরু হয়। স্বদেশী দ্রব্য বিক্রির অভিপ্রায় নিয়েই শুরু হয়েছিল স্বদেশী মেলার। যা বাস্তবায়িত করতে পুজোর চাঁদা থেকেই অর্থসাহায্য করা হত। বর্তমানে এই মেলাই আমাদের পুজোকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’
এছাড়া অষ্টমীর দিনে বাগবাজারের পুজোয় যে ‘বীরাষ্টমী’ উৎসব হয়, সে কথাও জানাতে ভোলেননি অভিয়বাবু। তাঁর কথায়, ‘এই বীরাষ্টমী উৎসব করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে স্বদেশি হাওয়ায় অষ্টমীর সকালে এই পুজোর মাঠে লাঠিখেলা, ছুরি খেলা, বর্শা খেল কুস্তির মতো দেশজ খেলা হত। তখন অনেকেই মনে করত সাহেবরাই শক্তিমান, বাঙালি ভীরু, দুর্বল। এই বিশ্বাস ও ভীতি ভাঙতেই ১৯৩৩-৩৪ সাল থেকে বীরাষ্টমীর আয়োজন করা হত। আজও অষ্টমীতে সেই ট্রাডিশন অব্যাহত। তবে এখন মূলত লাঠিখেলাটাই হয়।’ অষ্টমীর পাশাপাশি নবমীতেও যে এখানে কুমারী পুজো হয় সেই বিষয়টিও উঠে আসে অভয়বাবুর কথায়। ওঠে সিঁদূর উৎসবের কথাও।
দশমীর দিন বাগবাজার সর্বজনীনের সিঁদুর খেলা ঠিক যেন শেষ পাতে মিষ্টির মতো। বিজয়ার দিন সকাল থেকেই মন্ডপের বাইরে লাইন পড়ে যায়। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহিলারা এসে এখানে ভিড় জমান মাকে সিঁদূর দিয়ে বরণ করতে। পাশাপাশি তাঁরা নিজেরাও মেতে উঠেন সিঁদুর খেলায়। সবমিলিয়ে শরতেই যেন একটা ছোটখাটো বসন্ত উৎসব হয়ে যায় বাগবাজার চত্বরে। ফুটবল তো অনেকেই খেলে, তবে সম্রাট একজনই, পেলে। তেমনি কলকাতা ও জেলায় অনেক পুজোই হয়। কিন্তু সকলের ভিড়ে কিংবদন্তি সেই বাগবাজার সর্বজনীনই। তাই শত থিমের চমক দেখার পরেও যে মায়ের রূপের ঝলক দেখতে বাগবাজারমুখো হবেন দর্শনার্থীরা, এ আর নতুন কী!