রাজ্যে শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপক রমরমার সময় আমার সাংবাদিক জীবন শুরু। তখন দেখতাম বন্ধ কারখানার গেটে শুকনো মুখ শ্রমিক-কর্মচারীরা বসে আছেন , সামনে বোর্ডে লেখা আজ লকআউটের ২১০ দিন। সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তাও যে এভাবে বিপন্ন হতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আজ সাংবাদিকদের নিজেদের পিঠেই রাতারাতি লাঠি পড়ছে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সাজানো নিরাপত্তার বলয়, বাংলার সাংবাদিককূল আজ এক বিপন্নতার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। রাজ্যে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি সংবাদপত্রের প্রকাশনা। যেগুলি চলছে সেগুলিতেও ব্যাপকহারে হচ্ছে ইচ্ছামতো কর্মী সঙ্কোচন। আজ যে সাংবাদিক বা চিত্রসাংবাদিক কাজ করছেন তিনি নিজেও তার চাকরির নিরাপত্তার সম্পর্কে নিশ্চিত নন। দুদিন আগেই আমাকে নামকরা এক কাগজের সাংবাদিক বললেন, আর কয়েকমাস আছি, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। প্রতিদিন গেটে কার্ডটা পাঞ্চ করার সময় ভাবি আজকে কার্ডটা পাঞ্চ হবে তো? অনেকে কার্ড পাঞ্চ হওয়ার আগে টেনশনে একটা সিগারেট ধরান, তারপর ভয়ে ভয়ে কার্ড পাঞ্চ করেন।
সারা কর্মজীবনে আমি দেখেছি সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকরা প্রাণপাত করে কাজ করেন, খবর ও ছবি সংগ্রহ তাদের ধ্যানজ্ঞান। ভালো ছবি ও খবর করতে পারলে সাংবাদিকরা নিজেরাই পরিতৃপ্ত হন। ভবিষ্যতে কী হবে তা তারা ভাবেন না, আজ একথা ভাবার সময় এসেছে। চিত্রসাংবাদিকদের অবস্থা আরও খারাপ। যে তরুণ চিত্রসাংবাদিকটি সদ্য কাজ শুরু করলেন, তাকে খুব কম করেও প্রায় এক লাখ টাকা দিয়ে ক্যামেরা কিনতে হয়। গাঁটের কড়ি দিয়ে অ্যাসাইনমেন্টে যেতে হয়, মাইনে ও কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই, সেই ছেলেমেয়েদেরই যখন রাতারাতি বরখাস্তের নোটিশ ধরানো হয় তখন তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল বললেও খুব কম বলা হয়। ব্যাপার যা দাঁড়াচ্ছে, এরপর থেকে যারা নতুন কাগজ কিংবা চ্যানেল খুলবেন তাদের কাছ থেকে অন্তত চার বছরের মাইনে আগাম না নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। নিজেদের ব্যবস্থা আজ আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ঘটনা আটকানোর জন্য নিজস্ব ইউনিয়ন গড়ে তোলা ছাড়া আমি তো আর কোন উপায় দেখছি না।
কর্তৃপক্ষের ধামাধরা যে ইউনিয়নগুলি প্রতিটি কাগজের অফিসে আছে এই বাজারে তারাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। সেইসব চামচা ইউনিয়নের নেতারা ক্যাথিটার পড়া অবস্থাতেও বহাল তবিয়তে চাকরি করে চলেন। বছরের পর বছর এরা এক্সটেনশন পেয়ে যান। চাকরি যায় সম্ভাবনাময় তরুণ ছেলেমেয়েদের। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোন অন্যায়ের এরা সমালোচনা করেন না, বরং ধরেন তাদের দোষ। কর্তৃপক্ষ এই অবস্থাটা বোঝেন বলেই তারা অবলীলাক্রমে বলতে পারেন, এখনই রিজাইন করুন আর দুমাসের মাইনে নিয়ে চলে যান।
কর্মহীন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হলেই মনে পড়ে তাদের পরিবারের লোকজনের ম্লান মুখগুলি। এইসব ম্লানমুখে খানিকটা আশার সঞ্চার করেছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ঘোষণা। কর্মরত সাংবাদিকদের চাকরি চলে গেলে তাদের সর্বোচ্চ মাসিক ১০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এই সহায়তা চলবে দু বছর পর্যন্ত। যারা ১০ হাজার টাকার কম বেতন পান তাদের সমপরিমাণ টাকা এবং যারা ১০ হাজার টাকার বেশি বেতন পান তাদের সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অনেকে বলবেন, প্রয়োজনের তুলনায় এটা খুব কম। আমি বলি, এটুকুও তো তিনি নিজের থেকে করলেন। সহায় সম্বলহীন সাংবাদিকরা একটা কিছু আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচার প্রস্তুতি নেওয়ার মত খানিকটা সময় তো পেলেন, এটুকুও তো কেউ করেন নি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বিপদের দিনে যেভাবে তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন তারজন্য সাংবাদিকরা তার প্রতি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন। বিশেষ করে তরুণ সাংবাদিকদের এতে একটু সুবিধা হবে।
আসল লড়াইটা লড়তে হবে কিন্তু সাংবাদিকদেরই। তাদের রাস্তায় নামতে হবে, নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে হলে চিহ্নিত দালাল, ইউনিয়ন নেতাদের সরিয়ে দিয়ে গড়তে হবে পাল্টা ইউনিয়ন, সাংবাদিকরা ইউনিয়ন করতে পারেনা এই জাতীয় দায় এড়ানো দালাল মার্কা কথাবার্তা যারা বলেন চিহ্নিত করতে হবে তাদের। দালাল ইউনিয়ন ছাড়াও সব কাগজের অফিসগুলিতে শিক্ষিত ও পণ্ডিত বলে বহু বিজ্ঞাপিত একশ্রেণীর উচ্চপদে আসীন জীব রয়েছেন, মুখে বামপন্থার ভান করলেও এরা আসলে সুবিধাবাদী।
সাংবাদিকদের লড়তে হবে নিজেদের শক্তিতে। কঠোর বাস্তব বলছে, নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও যোগাযোগ বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। আসুন, কর্মহীন বন্ধুদের পাশে আরও বেশি করে দাঁড়াই। অন্তত তারা বুঝুন তারা একা নন। ঐক্যের শক্তিই এই সঙ্কটে সাংবাদিকদের পথ দেখাতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত