? শ্রী ক্ষুদিরাম বসুর স্বীকারোক্তি:
(মজফ্ফরপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ. সি উডম্যানের কাছে ক্ষুদিরাম স্বেচ্ছায় যে স্বীকারোক্তি দেন সেটা বাংলায়, তারিখ ০১–০৫–১৯০৮। পরের দিন সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এন. সি. চৌধুরী।)
“আমার নাম ক্ষুদিরাম বসু। আমার পরলোকগত বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ বসু। জাতিতে আমি কায়স্থ এবং পেশায় একজন ছাত্র। মেদিনীপুরে আমার বাড়ি। মৌজা মেদিনীপুর, জেলা মেদিনীপুর। আমি মেদিনীপুরে বসবাস করি।
কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্যে আমি কলকাতা থেকে ৫/৬ দিন আগে মজফ্ফরপুরে এসে উপস্থিত হই। স্টেশনের কাছে ধর্মশালাতে আমি উঠেছিলাম। আমার সঙ্গে দীনেশচন্দ্র রায় নামে আরও একজন লোক এসেছিল। সে বলেছিল যে, সে বাঁকিপুরের লোক। আমি তাঁকে হাওড়া স্টেশনেই দেখেছিলাম, তার আগে কখনও দেখিনি। আমাদের দুজনের একরকম উদ্দেশ্য ছিল। আমরা উভয়েই একসঙ্গে যাত্রা করেছিলাম। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে পথে নেমেছিলাম, নানা ধরনের কাগজের সংবাদ পাঠ করে আমি উত্তেজনাবশত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এই কাগজগুলি হল ‘সন্ধ্যা’, ‘হিতবাদী’, ‘যুগান্তর’ ইত্যাদি। কাগজগুলিতে ভারতের ওপর ইংরেজ সরকারের জুলুমের কথা লেখা হত। অবশ্য কিংসফোর্ডের নাম কোথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু যেহেতু তিনি বহু লোককে জেলে পুরেছিলেন, সেহেতু আমি তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিই। আলোচনা করতে করতে তাঁদের কথাও উঠে আসে। অন্য কেউ তাঁকে এই কাজ করতে উসকানি দিয়েছিল কিনা, সে কথা আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করিনি। আমাদের ট্রেনেই হঠাৎ দেখা গিয়েছিল কিনা সে কথা আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করিনি। আমাদের ট্রেনেই হঠাৎ দেখা হয়েছিল এবং সেই সুবাদেই তাঁর সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত। কথায় কথায় সে তাঁর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে জানায়। আমিও আমার উদ্দেশ্যটা তাঁকে জানাই। গাড়িতে আরও অনেক সহযাত্রী ছিল। কিন্তু আমি তাঁদের কারওর সঙ্গে কথা বলিনি।
আমরা মজফ্ফরপুরের ধর্মশালায় পৌঁছে সেখানে ৪/৫ দিন থাকি এবং তাঁকে (কিংসফোর্ডকে) মারার সুযোগের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলি। দু–একদিন বাইরে থেকে তাঁর বাড়িটিও দেখে আসি। আমরা রোজ সকালবেলা তাঁকে দেখতে পেতাম। আমি একদিন কোর্টে গিয়েও তাঁকে দেখে আসি।
আমার কাছে দুটো রিভলভার ছিল এবং আমার ইচ্ছে ছিল তার একটা দিয়ে তাঁকে গুলি করে মারি। এইগুলো হল সেই রিভলভার (প্রদর্শ নং ১ ও ২)। দীনেশের কাছে ছিল একটা রিভলভার ও একটা বোমা। সে এটা (বোমা) কলকাতা থেকেই তৈরি অবস্থায় নিয়ে এসেছিল। ধর্মশালায় বসে ওটা বানায়নি। তবে ধর্মশালায় বসে সে কী যেন করত। আমি বাইরে থেকে ঘরে ফিরে এসে দেখতাম যে সে বোমাটা বার করে দেখে আবার আগের জায়গায় রেখে দিত। দীনেশ আমাকে বলেছিল যে এই বোমাগুলো কেমন করে বানাতে হয় সে তা জানে। কিন্তু বোমাটা সে কোথা থেকে জোগাড় করেছিল, সে কথা আমাকে বলেনি। বোমাটা টিন দিয়ে মোড়া ছিল এবং তার আকার ছিল প্রায় এতখানি (হাত দিয়ে প্রায় তিন–চার ইঞ্চি ব্যাসার্ধের একটি আয়তন প্রদর্শন)।
আমার পৌঁছবার দু’দিন পরে বোমাটা কাজের উপযোগী হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মশালায় একটা গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগের ভিতরে কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে আমরা সেটাকে ঢেকে রেখেছিলাম। দিন দুই–তিন আমি বোমাটাকে একটা টিনের মধ্যে পুরে বাইরেও নিয়ে গিয়েছিলাম। দীনেশ ও আমি দু–তিনদিন সন্ধেয় বেরিয়ে জজ সাহেবের বাড়ির সামনের ময়দান দিয়ে হেঁটে এসেছিলাম। আমার তাঁকে (কিংসফোর্ডকে) দু–তিনবার দেখেও ছিলাম। কিন্তু কোনও সুযোগ পাইনি। আমরা তাঁকে (ঘোড়ার) গাড়ির ভেতরেও বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু সব কিছু পরিষ্কারভাবে চিনতে পারিনি।
গতকাল রাতে আমি একটা সুযোগ পেয়েই বোমাটা ছুঁড়ে মারলাম। দীনেশ ও আমি ময়দানে একটা গাছের তলায় একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি দেখলাম (কিংসফোর্ডের) গাড়িটি ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি মনে করেছিলাম যে কিংসফোর্ডের গাড়িটা আমি সঠিকভাবে চিনতে পেরেছি। আর তাই বোমাটাও ছুঁড়ে মারলাম। (অবশ্য) এখন জানতে পারলাম যে আমার ভুল হয়েছে। কনস্টেবলরা আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমি কিন্তু একটা বোমাই ছুঁড়েছিলাম। আমি রাস্তায় নেমে গাড়িটির কাছে ছুটে গিয়ে তার ভেতরেই এটা ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম যে জজ সাহেব বুঝি গাড়ির ভেতরেই রয়েছেন। কিন্তু আসলে সেখানে কজন ছিল তা আমি ভাল মতো বুঝতে পারিনি। সময়টা ছিল মোটামুটি আঁধারে ভরা। তখন আমার গায়ে ছিল এই ডোরাকাটা কোট (প্রদর্শ নং ৩)। দীনেশের গায়ে ছিল একটা সাদা রঙের সিল্কের কুর্তা (প্রদর্শ নং ৪)। কিন্তু এটা পরে থাকতে অসুবিধে হওয়ায় সে এটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় গা থেকে খুলে আমায় দিয়েছিল। সে তখন একটা জামা আর চাদর গায়ে দিয়ে নেয়। আমাদের (দুজনের) পায়েই জুতো ছিল। কিন্তু বোমা ফেলার আগে আমরা গাছতলায় ওগুলো ছেড়ে রেখেছিলাম। আমি বোমা ছোঁড়ার জন্যে সবার আগে দৌড়ে গিয়েছিলাম। আর তাই দীনেশ কেমনভাবে আমার পিছু নিয়েছিল, তা খেয়াল করতে পারিনি। দীনেশের কাছেও একটা রিভলভার ছিল, তবে সেটা (তখন) তাঁর হাতে ছিল কিনা তা লক্ষ্য করে দেখিনি। সে গুলি ছুঁড়েছিল কিনা, তাও বলতে পারব না। বোমা ছোঁড়ার ফলে আমি কোনও আঘাত পাইনি। কিন্তু দীনেশ আঘাত পেয়েছিল কিনা, তা জানি না। আমরা কিছুক্ষণ একসঙ্গে ধর্মশালার দিকে ছুটে গিয়েছিলাম এবং তারপরেই আলাদা হয়ে যাই। আমি (রেল) লাইন ধরে এগোনোর পর সমস্তিপুরের রাস্তায় এসে উঠেছিলাম। (আর) ধর্মশালা থেকে আলাদা হয়ে পড়ার সময় দীনেশ সিধে পথে ছুট দেয়।
ধর্মশালার কাছে ছুটে আসার সময় একজন কনস্টেবল আমাদের ডেকেছিল, কিন্তু আমরা তা কানে না তুলে চুপিসারে ছুট মেরেছিলাম। ওইদিন রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা যখন জজ সাহেবের বাড়ির কাছে অপেক্ষা করছিলাম, তখন দুজন লোক আমরা কোথায় থাকি সে কথা জিজ্ঞাসা করছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তাঁর (কখনও) সাক্ষাৎ হয়নি। ওই লোকটি আমাদের ওখান থেকে চলে যেতে বলে, কেন না সে পথ দিয়ে নাকি সাহেবরা যাতায়াত করে। আমি বলেছিলাম যে, আমি একজন ছেলের জন্যে অপেক্ষা করছি। সে এলেই চলে যাব। তারপর আমরা পুবদিক ধরে চলে যাই। আমরা খানিকটা পথ গিয়ে আবার ফিরে আসি সেই জজ সাহেবের কোর্ট আর পুকুরের লাগোয়া গাছতলায় যেখানে আমরা (জজ সাহেবের ঘোড়ার) গাড়িটি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম। লোক দুটোর সঙ্গে আমার যখন কথা হচ্ছিল, তখন বোমাটা আমার বাঁহাতেই ধরা ছিল, হাতটা ঝুলছিল। বোমাটা একটা টিনের বাক্সে রাখা ছিল, গাছতলায় পৌঁছনোর আগেই আমরা এই টিনের বাক্সটা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। কেন না এই কাজে আমারই বেশি ইচ্ছে ছিল। ধর্মশালা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমি সেখানে একটা ধুতি ফেলে এসেছিলাম। দীনেশ কিছু ফেলে গিয়েছিল কিনা, তা আমার জানা নেই। দীনেশের বয়েস প্রায় আমারই মতো, তাঁর গোলপানা মুখ আর শরীরের গঠন আমার থেকে কিছুটা ভাল। লম্বায় সে আমারই মতো, ভ্রু জোড়া আলাদা আর আমার মতোই তারও চুল কালো ও কোঁকড়া। সে বলেছিল, তাঁর একজন ভাই বাঁকিপুরে রেলে চাকরি করে।
খবরের কাগজ পড়া ছাড়াও আমি বিপিন পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি এদের মতো লোকেদের বক্তৃতা শুনতাম এবং সেগুলো শুনে আমি এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিডন স্কোয়্যারে একজন শক্তসমর্থ সন্ন্যাসীও একবার বক্তৃতা করেছিল। কলকাতায় আমি আমার মামা সতীশচন্দ্র দত্তের সঙ্গে থাকতাম। তিনি একজন স্কুলশিক্ষক আর কর্পোরেশন স্ট্রিটের ৪ নং কী ৫ নং বাড়িতে থাকতেন। তাঁর স্কুলটাও ছিল ওই কর্পোরেশন স্ট্রিটেই।
এই কার্তুজগুলো (২৩টা ছোট ও ১৪টা বড়) আমারই (প্রদর্শ নং ৫) এবং এগুলি কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের একটা বাজার থেকে আমি কিনেছিলাম। আমার কোনও লাইসেন্স ছিল না। অমূল্যরতন দাস নামে একটা ছেলে দুটো রিভলভার এনে দিয়েছিল। আমি তাঁকে এর একটার জন্যে ২৫ টাকা আর অন্যটার জন্যে ১৫ টাকা দিয়েছিলাম। এটা প্রায় দুমাস আগেকার কথা। এই ঘড়িটা (প্রদর্শ নং ৬) আমার আর এই রেলওয়ে টাইমটেবল (প্রদর্শ নং ৭) ও এই মোমবাতি আর দেশলাইটাও (প্রদর্শ নং ৮) আমার। এই টাকা রাখার ব্যাগটাও (প্রদর্শ নং ৯) আমার, এটাতে তিনটে ১০ টাকার নোট, একটা (কাঁচা) টাকা, একটা দু আনি আর কিছু খুচরো পয়সা (মোট ৩১ টাকা ৭ আনা ৩ পাই) আছে।
এই টিনের কৌটোটাও (প্রদর্শ নং ১০) আমার। এর ভেতরেই বোমাটা একটা কাপড়ে মুড়ে রাখা ছিল। এই জুতো জোড়াটা (প্রদর্শ নং ১১) আমার আর ওই জোড়াটা (প্রদর্শ নং ১২) দীনেশের। ওই চাদরটা (প্রদর্শ নং ১৩) দীনেশের। সে ওটা মাথায় জড়িয়ে রাখত। চাদরের একটা টুকরো দিয়ে বোমাটা মুড়ে টিনের কৌটৌয় পুরে রাখা হয়েছিল। চাদরটা অন্তত দু–তিনবার ছেঁড়া হয়েছিল।
আমি প্রায় এক বছর আগে মেদিনীপুর কলেজ ছেড়েছি।
প্রশ্ন: এই বিবৃতির সবটুকুই কি তোমার?
উত্তর: আমি যা বলেছি, সব সত্যি আর আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় এই বিবৃতি দিয়েছি।”
? শ্রী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের স্বীকারোক্তি:
(বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ২৮ বছর বয়সকালে, তাঁর স্বাক্ষর করা বক্তব্য আলিপুরের প্রথম সারির ম্যাজিস্ট্রেট এল বার্লির সামনে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে রেখেছিলেন। ইংরেজি তারিখ ছিল, ০৩-০৫-১৯০৮)
“আমার নাম বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। আমার বাবার নাম ডঃ কৃষ্ণধন ঘোষ। আমি জাতে কায়স্থ এবং আমার জীবিকা সম্বন্ধে বলতে হলে বলা যায় যে পূর্বে যুগান্তর পত্রিকায় কিছু লেখালিখি করেছি। আমি ইংল্যান্ডের ক্রয়ডনে জন্মগ্রহণ করি। আমি মানিকতলার ৩২ নং মুরারিপুকুর রোডে থাকি।
– আপনি কি আমার সামনে কোনও বিবৃতি দিতে চান?
– হ্যাঁ।
– আপনি কি স্বেচ্ছায় এই বিবৃতি দিচ্ছেন, নাকি আপনার ওপর কোনও প্রকার জোর–জবরদস্তি করা হয়েছে?
– না, আমি পুরোপুরি স্বেচ্ছায় বলছি।
– আপনার যা বলার আছে, আমায় বলবেন কি?
– হ্যাঁ। সঠিক দিন–তারিখ মনে করা কঠিন বলে আমার বিবৃতিতে সময়ের উল্লেখ একটু অস্পষ্ট হবে। আমি দেওঘর বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করি।
– ভারতবর্ষে আসার সময় আপনার বয়স কত ছিল?
– আমার তখন এক বছর বয়স ছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করার পর আমি ঢাকায় যাই। আমার দাদা ওখানে অধ্যাপনা করতেন। আমি ঢাকায় কলা বিষয়ে প্রথম স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করি। তারপর পড়াশোনায় ছেদ টেনে আমি বরোদায় যাই। বরোদায় গায়কোয়াড় কলেজে আমার দাদা অরবিন্দ ঘোষ অধ্যাপনা করতেন। ওখানে আমি ইতিহাস ও রাজনৈতিক পত্রপত্রিকা পড়তে শুরু করি। ওখানে এক বছর থাকার পর স্বাধীনতা অর্জনের চেতনা জাগরণের জন্য রাজনৈতিক প্রচারকের ভূমিকা নিয়ে আমি বাংলায় ফিরে আসি। আমি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ঘুরে বেড়ালাম ও স্বাস্থ্য অনুশীলন কেন্দ্র স্থাপন করলাম। ওই সব কেন্দ্রে শারীরিক অনুশীলন ও রাজনৈতিক চর্চার লক্ষ্যে যুবকবৃন্দকে একত্রিত করতে থাকি। শিক্ষাদানের জন্য আমি যে দলটি গড়া শুরু করেছিলাম সেই দলের সদস্যদেরকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার বন্ধু অবিনাশ ভট্টাচার্য (এখানে গ্রেপ্তার হয়েছে) ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে (এখন জেল হেফাজতে) সঙ্গে নিয়ে আমার এই যাত্রা শুরু। আমি সদস্য সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করলাম। ১৯০৭–এ শুরু করে আজ পর্যন্ত আমি প্রায় চোদ্দো থেকে পনেরো জন যুবক সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। আমি এই যুবকদের ধর্মীয় পুস্তক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়ে শিক্ষাদান করতে থাকি। বৈপ্লবিক চিন্তা–ভাবনা সর্বদাই আমাদের মনে ছিল এবং নিজেদের প্রস্তুত রাখার জন্য অল্প অল্প অস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। আমি সর্বসাকুল্যে এগারোটা রিভলভার, চারটি রাইফেল ও একটি বন্দুক সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। অন্য যুবকদের মধ্যে আমাদের দলে উল্লাসকর দত্তও অন্তর্ভুক্ত হল; সঠিক দিন–তারিখ মনে না থাকলেও বলতে পারি মোটামুটি এই বছরের শুরুর দিকে বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করার ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান থাকায় উল্লাসকর আমাদের দলে যোগদানের ইচ্ছে প্রকাশ করে। লেফটেন্যান্ট গভর্নর কটক থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বোগরা নিবাসী প্রফুল্লচন্দ্র চাকী ও বিভূতিভূষণ সরকার যাত্রা শুরু করেছিলেন। আমি ওঁদের সঙ্গ নিয়েছিলাম। আমাদের অনুমান ছিল যে লেফটেন্যান্ট গভর্নর আসানসোলের পথে ফিরবেন। আমরা চন্দননগরে পৌঁছে অপেক্ষা করছিলাম।
– আপনাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্রাদি ছিল?
– একটা মাইন ও সংযোগকারী তার।
– আপনারা কি মাইন পেতেছিলেন?
– হ্যাঁ।
– কোথায়?
– চন্দননগর ও মানকুণ্ডু স্টেশনের মধ্যস্থলে। উনি আসছেন না জানতে পেরে ওটা তুলে নিয়ে আসি। আমরা চন্দননগর স্টেশনে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি যে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ওই পথে ফিরছেন না। তৃতীয়বার আমরা খড়্গপুর স্টেশনে একই উদ্দেশ্য নিয়ে যাই।
– কে কে গিয়েছিলেন?
– আমরা তিনজন। আমি প্রফুল্ল ও বিভূতি। সকাল দশটার সময় আমরা খড়্গপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামি। দুপুরবেলায় আমরা ট্রেনে করে নারায়ণগড়ে যাই এবং রেল লাইনের সমান্তরালে চলা এক রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে থাকি। অন্ধকারে নেমে এলে আমরা রেল লাইনের ধারে রাত নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।
নারায়ণগড় থেকে মাইলখানেক দূরে খড়্গপুরের দিকে একটা জায়গায় আমরা অপেক্ষা করছিলাম। এখানে আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেব কারণ ভুলবশত নির্দোষ মানুষ এই অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়েছে। মোটা লোহার পাত দিয়ে গড়া ঢাকনা দেওয়া পাত্রের মধ্যে ছয় পাউন্ড ডিনামাইটের মাইন আমাদের সঙ্গে ছিল। পাছে চুপসে না যায়, তাই আমরা সিসার নল ব্যবহার করেছিলাম। সিসার পাইপ দৈর্ঘ্যে অনেকটা বড় হওয়ায় মাইন পাতার সময় পাইপের কিছুটা অংশ কেটে বাদ দিয়ে একপাশে ফেলে দিয়েছিলাম।
আমাদের কাছে মোমবাতি সমেত একটা কালো লণ্ঠন আর কাগজের মোড়কে আরও জিনিসের মধ্যে ইংলিশম্যান ও বন্দেমাতরম্ পত্রিকাও ছিল। আমরা অবশ্য ওগুলো ওখানেই ফেলে রেখে আসি। ফিউজটাকে একই মোড়কের মধ্যে রাখার কারণে অন্য জিনিসগুলোতেও পিকরিক অ্যাসিডের দাগ লেগে গিয়েছিল। পিচবোর্ডের তৈরি তুলো ভর্তি একটা জুতোর বাক্সও আমরা ওখানে ফেলে রেখে আসি। এই বাক্সের মধ্যে প্রথমে তুলো, তার ওপর ফিউজ রেখে আবার তুলো চাপা দেওয়া হয়েছিল। রেল লাইনের পাশে একটা ঝোপের আড়ালে খিদে মেটানোর জন্য সামান্য মিষ্টি খেয়ে নিয়ে উচ্ছিষ্টসমেত শালপাতাগুলো ওখানেই ফেলে রাখি। মাইন পাতা হয়ে গেলে রাত এগারোটা–বারোটার মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে আমি একা নারায়ণগড়ে পৌঁছে শেষ প্যাসেঞ্জার ট্রেনে কলকাতায় ফিরে যাই। ওখানে অপেক্ষারত দুই যুবক বিশেষ ট্রেনটি আসার পূর্বমুহূর্তে রেল লাইনের ওপর ফিউজটিকে রেখে দেয়। ওদের দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী বিস্ফোরণ ঘটার সময় তাঁরা এক থেকে দেড় মাইল দূরত্বে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
আমরা কোনও কুলি বা অন্য কারও কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য নিইনি।
তারপরের বোমা হামলা ঘটানো হল চন্দননগরে। বোমাটি হেমচন্দ্র দাস বানিয়েছিল। যশোরের ইন্দুভূষণ রায়, আমি আর শ্রীরামপুরের নরেন্দ্র গোসাঁই একসঙ্গে চন্দননগরে যাই। সূর্যাস্তের পরে মানকুণ্ডু স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পরে আমরা সরাসরি চন্দননগর স্ট্যান্ডে পৌঁছে প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকি। সেই রাতে নগরের মেয়রের দেখা না পেয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী একটি গাছের নিচে এসে সারারাত অপেক্ষা করি। পরের দিন সকালবেলায় ইন্দ্র ও নরেন্দ্র শ্রীরামপুরে নরেন্দ্রের বাড়িতে চলে যায়। ওখানকার জমিদার নন্দলাল গোস্বামীর ছেলে হল নরেন। আমি কলকাতায় ফিরে আসি। সেই দিন বিকেলবেলায় আমরা তিনজন আবার চন্দননগরে যাই। আমি চন্দননগর স্টেশনে মিলিত হওয়ার পর ইন্দ্র স্বেচ্ছায় বোমাটি ছোঁড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
একটি গলির মধ্যে অবস্থিত বাড়ির নিচতলার খাবার ঘরের জানলার পাশে পৌঁছনোর পরে দেখি যে মেয়র ও তাঁর স্ত্রী রাত্রিকালীন আহারে ব্যস্ত। জানলার ফাঁক দিয়ে ইন্দ্র বোমাটি ছুঁড়ে দেওয়ার পর আমরা দ্রুত তেলিনিপাড়া ঘাটে পৌঁছে নদী পার হয়ে শ্যামনগরে গেলাম এবং সেখান থেকে কলকাতায় ফিরলাম। বোমাটি ফাটলই না এবং আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে পিকরিক অ্যাসিড ঠিক ছিল না। ইন্দ্র বোমাটি ছোঁড়ার সময় আমি খুব কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম।
মুজফ্ফরপুরেও একটা ঘটনা ঘটে, আমি তার বিবরণ দেব। স্বদেশি সংবাদপত্রগুলিকে বিভিন্নভাবে অভিযুক্ত করে আদালতে হেনস্থা করার প্রতিশোধ নিতে মিঃ কিংসফোর্ডকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বোমা সঙ্গে নিয়ে মুজফ্ফরপুরে যাওয়ার জন্য প্রফুল্ল চাকী জেদ করে। দেশের জনগণ কিংসফোর্ডের মৃত্যুই কাম্য বলে মনে করত। ১৫ নং গোপীমোহন দত্ত লেনে হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর বোমাটি বানায়। ডিনামাইট দিয়ে তৈরি বোমাটি একটি কাঠের হাতলযুক্ত টিনের বাক্সে রাখা হয়।
প্রফুল্লের মুজফ্ফরপুর যাওয়ার ব্যাপারে উপেন্দ্রনাথ ও আমি মত দিই এবং হেমচন্দ্র মেদিনীপুরের ক্ষুদিরাম বোসের নাম সুপারিশ করে। ক্ষুদিরামকেও যেতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পুলিসের হাতে ধরা পড়ে গেলে আত্মহত্যা করার মত প্রকাশ করায় আমি ওদের দুটো রিভলভার দিই। ক্ষুদিরাম আমাদের মধ্যে বহিরাগত ছিল। বাগানবাড়ি বা ১৫ নং গোপীমোহন দত্ত লেন সম্বন্ধে ওঁর কোনও ধারণা ছিল না।
— আপনি রিভলভার কোথায় পেলেন?
— এই ব্যাপারে আমি কিছু জানাতে অনিচ্ছুক।
— আপনাকে কখন গ্রেপ্তার করা হয়?
— গত পরশুদিন ভোরবেলায়।
— কোথায়?
— ৩২ নং মুরারিপুকুর রোড থেকে।
— আর কারা ওখানে ছিলেন?
— উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ইন্দ্র (ইন্দু) ভূষণ রায়, বিভূতিভূষণ সরকার, পরেশচন্দ্র মৌলিক, নলিনীকান্ত (কুমার) গুপ্ত, কৃষ্ণলাল সাহা, শচীন্দ্রনাথ সেন, পূর্ণচন্দ্র সেন, হেমেন্দ্রনাথ ঘোষ, শিশিরকুমার ঘোষ, বিজয়চন্দ্র নাগ ও আরও অনেকে।
— ওখানে ওঁরা কী করছিলেন?
— ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পুস্তক ইত্যাদি সম্বন্ধে উপেন্দ্রনাথ ও আমি ওঁদের শিক্ষা দিতাম।
—এই ধরনের কার্যসিদ্ধির জন্য নিযুক্ত আর কেউ এখনও কি পুলিসের নজরের বাইরে আছে?
— না। আমি এও বলব যে আমরা মিঃ অ্যালেনকে হত্যা করার জন্য দায়ী নই, কুষ্টিয়ায় গুলিচালনার ঘটনার জন্যও নয়।
— আপনারা আরও কাউকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন?
— না। বড়লাট ও সেনাধ্যক্ষকে হত্যা করার বিষয়ে আলোচনা করলেও বাস্তবিক কোনও পরিকল্পনা আমরা করিনি। রাজনৈতিক হত্যাসাধনের মাধ্যমে স্বাধীনতা–অর্জনের বাস্তবতা আমরা কখনওই বিশ্বাস করিনি।
— তা হলে আপনারা এরকম কেন করেন?
— আমরা বিশ্বাস করি যে জনসাধারণ এটাই চেয়েছে।
? শ্রী উল্লাসকর দত্তের স্বীকারোক্তি:
(আলিপুরের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এল. বার্লির সামনে ৪ঠা মে ১৯০৮ সালে, বাইশ বছর বয়স্ক উল্লাসকর দত্তের ইংরেজি ভাষায় দেওয়া জবানবন্দির বাংলা অনুবাদ)
“আমার নাম উল্লাসকর দত্ত। আমার পিতার নাম দুর্গাদাস দত্ত। আমি জাতে বৈদ্য এবং আমার কাজ গো–পালন করা। ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবেড়িয়াতে আমাদের বাড়ি। আমি হাওড়া জেলার অন্তর্গত শিবপুর থানার অধীন শিবপুরে বসবাস করি।
– আপনি আমার সামনে কোনও বিবৃতি দিতে চান?
– হ্যাঁ।
– আপনার জানা আছে কি যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে যা যা বলছেন তা আপনার বিরুদ্ধে আইন প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে?
– হ্যাঁ।
– কোনওরকম জোর জবরদস্তি করার জন্য কি আপনি এই বক্তব্য পেশ করছেন?
– না। আমি পুলিসকে লিখিতভাবে যা জানিয়েছি সেই একই কথা বলতে চাই।
– মৌখিক জবানি দিতে আপনার কোনও আপত্তি আছে কি?
– না।
– আপনার বক্তব্য কী?
– আমি বারীন্দ্র ঘোষকে চার–পাঁচ বছর ধরে চিনি এবং নয়–দশ মাস আগে আমি এই সঙ্ঘে যোগদান করি।
– কোন পরিস্থিতিতে আপনি যোগদান করেন?
– যুগান্তর সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানানো হয় যে একটি গুপ্তসঙ্ঘের স্থাপনা হবে এবং এতে যোগদানের জন্য আমার ইচ্ছে ছিল। বারীন্দ্র আমাকে এই সঙ্ঘে যোগদানে সহায়তা করে।
– এই সংগঠনে যোগদানের পর আপনার করণীয় কী, কী ছিল?
– আমি বিস্ফোরক যৌগ বানাতাম।
– কীভাবে?
– আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা নিজস্ব পরীক্ষাগার গড়ে কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাতাম।
– আপনাকে এ সব কি শেখানো হয়েছিল?
– না।
– কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা সম্বন্ধে আপনার জানা তথ্য জানাতে পারেন?
– চন্দননগরে ট্রেন ধ্বংস করার বিফল প্রচেষ্টার সময় আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি একাই গিয়েছিলাম এবং লোহার তৈরি নলের মধ্যে ডিনামাইট দিয়ে বানানো একটা মাইন আমার সঙ্গে ছিল। এত তাড়াতাড়ি ট্রেনটা এসে পড়ল যে আমি সব জোগাড় করে মাইনটা সাজানোর সময়ই পেলাম না।
– এই মাইনের লক্ষ্য কে ছিল?
– স্যর অ্যান্ডু ফ্রেসারের বিশেষ ট্রেন।
– এই মাইনটা কে বানিয়েছিল?
– আমি নিজে। এর পরের ঘটনা ঘটে খড়্গপুরে। আমি ওখানে যাইনি। বারীন, বিভূতি ও প্রফুল্ল চাকী গিয়েছিল। ওরা অন্য একটি মাইন সঙ্গে নিয়ে যায়।
– ওটা কে বানিয়েছিল?
– আমি বানিয়েছিলাম।
– কোথায়?
– গোয়াবাগানের একটি গলির মধ্যে অবস্থিত একটা বাড়িতে। গলির নাম মনে পড়ছে না। আমরা বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলাম, খুব সম্ভব বারীনবাবু ভাড়া নিয়েছিল।
– কী ধরনের মাইন ছিল ওটা?
– ঢালাই লোহার একটা নলাকার পাত্রে তিন পাউন্ড ডিনামাইট দিয়ে ওই মাইনটা তৈরি হয়েছিল। আর ফিউজটা পিকরিক অ্যাসিড ও পটাশিয়াম ক্লোরেটের মিশ্রণ দিয়ে বানিয়েছিলাম।
– অন্য আর কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদের বিস্ফোরক বানিয়েছিলেন কি?
– না।
– আপনাকে কোথায় গ্রেপ্তার করা হয়?
– ৩২ নং মুরারিপুকুর রোড থেকে।
– আপনি ওখানে কতদিন ছিলেন?
– আমি একসঙ্গে দুই থেকে তিন দিন থাকার জন্য যেতাম এবং আট–দশ মাস যাবৎ আমি এইভাবেই থেকেছি।
– ওখানে কী করা হত?
– ওখানে নবীন সভ্যদের ধর্মীয় ও নৈতিকতা বিষয়ক শিক্ষা প্রদান করা হত। আমি ওখানে উপনিষদ পড়তাম। বিস্ফোরক পদার্থ তৈরি ও পরখ করে দেখাও আমার কাজ ছিল।
– অন্য কেউ কি বিস্ফোরক পদার্থ বানানো ও পরীক্ষা ইত্যাদি করত?
– ওখানে নয়। ফ্রান্স থেকে সদ্য ফেরত হেমচন্দ্র দাস বিস্ফোরক পদার্থ ও বোমা বানাত গোপীমোহন দত্ত লেনে অবস্থিত ওর নিজের বাড়িতে।
– আপনার আর কিছু বলার আছে?
– আপনি প্রশ্ন করলে বলতে পারি।
– মুজফ্ফরপুরের নাশকতামূলক ঘটনা সম্বন্ধে আপনি কি কিছু জানেন?
– হ্যাঁ। আমি জানি যে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বোস ওই উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। আমি জানি কারণ প্রায় সপ্তাহখানেক আগে একদিন সন্ধেবেলায় আমার গোপীমোহন দত্ত লেনে থাকার সময় ওরা যাত্রা শুরু করে।
– ওরা নিজেদের সঙ্গে কী নিয়ে গিয়েছিল?
– একটা বোমা।
– কীভাবে ওটা নিয়ে গিয়েছিল?
– আমাদেরই একটা ক্যাম্বিস থলে করে, যদিও ওটার নির্দিষ্ট কোনও স্বত্বাধিকারী নেই।
– কে বোমাটি বানিয়েছিল জানেন?
– শুনেছি হেম ওটা বানিয়েছিল, কিন্তু যখন ওটা বানিয়েছিল আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না।
– এই সঙ্ঘের নেতৃত্বে কারা ছিলেন?
– আলাদাভাবে কোনও নেতা চিহ্নিত করা নেই তবে বারীনবাবু নেতার ভূমিকা পালন করে থাকেন।
– কারা এই সঙ্ঘের সদস্য?
– বারীন, আমি, হেমচন্দ্র দাস, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ইন্দুভূষণ রায়, প্রফুল্ল চন্দ্র চাকী, বিভূতিভূষণ সরকার, কার্যত এঁরাই হলেন মুখ্য কর্মী। অন্য নবীন সভ্যরাও ছিলেন এবং বাগানবাড়িতে থাকতেন কিন্তু ওঁদের ওপর ভরসা করা হয়নি।
– খড়্গপুরের ঘটনায় ব্যবহৃত মাইনটা আপনার বানানো জানিয়েছেন। আপনি ওটা কাকে দিয়েছিলেন?
– বারীনবাবুকে; গোয়াবাগানের বাড়ি থেকে উনি ওটা নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানে বলে রাখতে চাই যে আমার স্বীকারোক্তির একটাই উদ্দেশ্য, যেন কোনও নির্দোষ ব্যক্তি শাস্তি না পান। নারায়ণগড় থেকে মাইলখানেক দূরে খড়্গপুরের দিকে একটা জায়গায় আমরা অপেক্ষা করছিলাম। এখানে আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেব কারণ ভুলবশত নির্দোষ মানুষ এই অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়েছে। মোটা লোহার পাত দিয়ে গড়া ঢাকনা দেওয়া পাত্রের মধ্যে ছয় পাউন্ড ডিনামাইটের মাইন আমাদের সঙ্গে ছিল। পাছে চুপসে না যায়, তাই আমরা সিসার নল ব্যবহার করেছিলাম। সিসার পাইপ দৈর্ঘ্যে অনেকটা বড় হওয়ায় মাইন পাতার সময় পাইপের কিছুটা অংশ কেটে বাদ দিয়ে একপাশে ফেলে দিয়েছিলাম।”
(তথ্যসূত্র:
১- স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পত্রাবলী, তরুণ মুখার্জি সম্পাদিত, ইচ্ছে ফড়িং (২০১৭)।
২- আজকাল পত্রিকা, রবিবাসরীয়, ১০ই সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত