বহুদিন যাবৎ উৎকণ্ঠা দানা বাঁধছিল আসাম জুড়ে। অবশেষে দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত শনিবার প্রকাশিত হয়েছে আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা। যা থেকে বাদ গিয়েছে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম। কিন্তু এঁদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু। জন্মও এ দেশেই। ফলে এই মুহূর্তে ‘হিন্দু বিরোধী বিজেপি হুঁশিয়ার’ স্লোগানে কাঁপছে আসাম। শুধু তাই নয়। ফৌজি মহম্মদ সানাউল্লার মতোই মনবাহাদুর লিম্বা বা ভূপেন্দ্র পালের পরিবারও এখন ‘বিদেশি’ বিজেপির আসামে। এই বিদেশিদের জন্য নতুন করে তৈরি হচ্ছে বিশালাকার বন্দীশালা। ফলে বেজায় আতঙ্কে ওই ১৯ লাখ মানুষ।
বুধবারই নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ সাবিত্রী রায় গায়ে আগুন নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। গতকাল তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে শনিবার তালিকা প্রকাশের পর থেকে এনআরসির কারণে মৃত অন্তত ৩। এনআরসিতে এভাবে হিন্দু বলি দেখে ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমেছে কট্টরহিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। ‘হিন্দু বিরোধী বিজেপি ফিরে যাও’ স্লোগান দিয়ে আজ আসামে বনধ ডেকেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল। তাদের দাবি, বাদ পড়া ১৯ লক্ষের মধ্যে রয়েছেন মাত্র ছয় লক্ষ মুসলমান। আর হিন্দু ১১ লক্ষেরও বেশি। পাশাপাশি, এনআরসি সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে এফআইআর।
প্রসঙ্গত, কার্গিল যুদ্ধের বীর সেনানি সালাউদ্দিনের মতোই দেশের হয়ে যুদ্ধ করেছেন মনবাহাদুর লিম্বু। মিলেছে সেনাপদকও। ১১ গোর্খা রাইফেলসের এই জওয়ান ৩৬ বছর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাটিয়ে ১৯৮০ সালে অবসর নেন। অথচ এনআরসিতে তাঁর দুই সন্তানের নাম নেই। ৩৩ বছর সীমা সুরক্ষা বলে চাকরি করে অবসর নেওয়া হরকাবাহাদুর ছেত্রির জন্ম-কর্ম সবই আসামে। তিনিও ব্যর্থ এনআরসিতে নাম তুলতে। নাম নেই শিলচর মাসুমপুরের বাসিন্দা ভূপেন্দ্র পালেরও। ১৯৬৮ সাল থেকে ভূপেন্দ্রবাবু দীর্ঘদিন সিআরপিএফে চাকরি করেছেন। দেশের প্রকৃত ‘চৌকিদার’ হয়েও বিজেপির আমলে তাঁরা তিন সন্তানের মধ্যে দুই সন্তানই নাগরিকত্ব পরীক্ষায় ফেল।
দেশের হয়ে লড়াই করার পর এবার তাঁদের যুদ্ধ করতে হবে নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করতে। ব্যর্থ হলেই অবধারিত জেল। গোয়ালপাড়ায় তৈরি হচ্ছে বন্দীশালা। এখন ৬টি জেলখানার ভেতর রয়েছে বিদেশি ৬টি বন্দীশালা। আরও ১০টি বন্দিশালা বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আর বন্দীশালায় ঢোকানো নিশ্চিত করতেই গঠিত হচ্ছে আরও আরও ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। হিন্দুদের রক্ষাকবচের কথা বলা হলেও দেখা যাচ্ছে হিন্দু বাঙালিরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাই বিজেপির বিরুদ্ধেই এখন ক্ষোভ বাড়ছে গেরুয়া শিবিরের অন্দরে। যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতে, বিজেপি নেতাদের বলার মতো মুখই নেই।
এরই মধ্যে আসাম বিধানসভার অধ্যক্ষ হিতেন্দ্র গোস্বামী মন্তব্য করেন, ‘১০০ শতাংশ নির্ভুল কিছু হয় না। এনারসি–ও ১০০ শতাংশ নির্ভুল হয়নি।’ অধ্যক্ষ মুখ খুললেও মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এখনও মুখ খোলেননি। এ নিয়েও ক্ষোভ বাড়ছে সেখানে। এই বিজেপি-বিরোধী ক্ষোভকে ধামাচাপা দিতে এনআরসি সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলাকে ‘ভিলেন’ বানানোর চেষ্টা চলছে। সারা আসাম গরিয়া মরিয়া যুব ছাত্র পরিষদ গুয়াহাটির লতাশীল থানায় হাজেলার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। তাদের অভিযোগ, স্বদেশিদের নাম বাদ দিয়ে বিদেশিদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এনআরসিতে। হাইলাকান্দিতে সাবিত্রী রায়ের মৃত্যুর পর সেখানকার স্থানীয় বিজেপি নেতা মানব চক্রবর্তীও হাজেলার কুশপুতুল পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখাতে যান।