মরশুমের প্রথম ডার্বিই ড্র হয়েছে৷ হতাশ সমর্থকেরা৷ তবুও তার মধ্যে আলো ফুটিয়েছেন মোহনাবাগানের শেখ সাহিল৷ টালির ঘর থেকে ডার্বির ময়দান- বহু যুদ্ধ পার করে স্বপ্নের উড়ান শুরু করেছে যে৷
টিটাগড় স্টেশন থেকে অটোয় করাতকল স্টপেজ। সেখান থেকে কল্যাণী হাইওয়ে পার করে যে রাস্তাটা ঢুকেছে, সেই রাস্তা ধরে হেঁটে মিনিট তিনেক গেলেই সাহিলের বাড়ি।বৃষ্টি হলে সাহিলের টালির চালার বাড়ির সামনের রাস্তায় জল জমে৷কাদায় মাখামাখি হওয়া থেকে বাঁচতে প্র্যাকটিসে যাওয়ার সময় বুটজোড়া হাতে নিয়েই রাস্তাটা পেরোয় সাহিল। জীবনের কঠিন লড়াইতে এভাবেই হাজারো সব বাধা পেরিয়ে বড় ফুটবলার হওয়াটাই এখন পাখির চোখ তাঁর৷
পাড়ার বাসিন্দারা উচ্ছ্বসিত তাঁদের আদরের রনিকে নিয়ে৷ দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘর থেকেই পাড়ার গর্ব ১৯ বছরের সাহিলের স্বপ্নের উড়ানে ডানা মেলা। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে বাবা বললেন, ‘ডার্বির দিন ওকে বলেছিলাম, ঠান্ডা মাথায় খেলবি। চাপ নিবি না। এই সুযোগটা পেয়েছিস। কাজে লাগাতেই হবে।’ এখন মনে হচ্ছে, ডার্বির দিন চাপ ছিল না। ভাল খেলার পর চাপ বেড়ে গিয়েছে।’ প্রত্যাশার চাপ। ইট–বালি সরবরাহের ছোট ব্যবসায়ী শাহারফ বলছেন, ‘সবে শুরু। অনেকটা পথ যেতে হবে। ছেলেকে এটাই বোঝাচ্ছি।’
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ভালবাসা সাহিলের। বিকেল হলেই একা একা বল নিয়ে বাড়ির পাশের মাঠে চলে যেতেন। সন্ধে নেমে গেলেও হুঁশ থাকত না। মা সুলতানা বিবি গৃহবধূ। বলছিলেন, ‘ওর ফুটবল খেলাকে সমর্থন করেছি। কখনও পড়াশোনা নিয়ে চাপ দিইনি। বলেছি, যেটা ভাল লাগে সেটাই কর। কিন্তু যেটাই করিস, মাথায় রাখবি জীবনে সৎপথে থেকে বড় হতে হবে।’
সমস্যা উপেক্ষা করে ছেলের ফুটবলের সাজসরঞ্জাম কিনে দিয়েছেন। শাহারফ বলছিলেন, ‘আমরা চেয়েছি, ও বড় ক্লাবে খেলুক। নাম করুক। ওর কাকারা, কোচরা অনেক সাহায্য করেছেন।’
খড়দার বিবেকানন্দ স্টেডিয়ামে ফুটবলে পায়েখড়ি। তারপর রানা–রফিক নামে পরিচিত দুই দাদার হাত ধরে সোদপুরের ক্লাবের হয়ে নার্সারি লিগ খেলতে গিয়ে কোচ অনন্ত ঘোষের নজরে পড়া। তারপর মোহনবাগানের জুনিয়র দলে খেলতে খেলতেই সিনিয়র দলে সুযোগ আসে সাহিলের। সাহারব বলছিলেন, ‘নাসিম স্যরের (আলি) কথাও বলতে হয়। সকালে নাসিম স্যর ফোন করে বললেন, ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে। রোজ রাতে খাওয়া–দাওয়া করে যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। খাওয়া–দাওয়ার দিকে নজর দিতে।’ কথা বলতে বলতে গলা বুজে আসে তাঁর।
ব্যারাকপুর রামকৃষ্ণ মিশনে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন সাহিল। তারপর পড়ার চাপে সেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন। ভর্তি হন ব্যারাকপুরের নোনা চন্দনপুকুর মন্মথনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রথমদিনই প্রধান শিক্ষক মণিলাল সিন্হাকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যর, রোজ স্কুলে আসতে পারব না। অনেক কামাই হবে। আমাকে ভর্তি নেবেন?’ শুনে চমকে উঠেছিলেন মণিলাল৷
সাহিলকে তৎক্ষণাৎ ডেকেও পাঠালেন মণিলাল। প্র্যাকটিসে যাওয়ার তাড়া ছিল। কিন্তু হেডস্যরকে উপেক্ষা করেন কী করে! আধঘণ্টার মধ্যে স্কুলে হাজির। সঙ্গে বন্ধু রাজ বিশ্বাস, ইমরান, মিনাফি, সুহর্ষ, সৌরভ সাহারা। সাহিলকে দেখে পড়ুয়াদের মধ্যে হইচই। এক ছাত্র বলল, ‘দাদা, তোমাকে পেপারে দেখলাম। তুমি তো দারুণ খেলেছো।’ শুনে লাজুক হাসেন সাহিল। প্রধান শিক্ষক প্রিয় ছাত্রের হাত ধরে নিয়ে চলে গেলেন টিচার্স রুমে। শিক্ষকরাও উচ্ছ্বসিত। সেল্ফির আর্জিও এল। ইতিহাসের শিক্ষক অনিত মিত্র মোহনবাগান সমর্থক। এগিয়ে এসে সাহিলকে বললেন, ‘তুই কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে সই করিস না। মোহনবাগানেই থাকিস।’ পাশ থেকে কট্টর ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বাংলার শিক্ষক উত্তম সাহা সাহিলকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পরের ডার্বিটায় কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামিস না। নামলে কিন্তু তোকে কম নম্বর দেব।’
লাজুক সাহিল ‘টিচার্স রুমের ডার্বি’–তে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। প্রধান শিক্ষক মণিলাল সাহিলের হাতটা ওপর দিকে তুলে ধরে নিদান দিলেন, ‘হেডমাস্টার যখন মোহনবাগানি, তখন সাহিল মোহনবাগানেই খেলবে। জয় মোহনবাগান!’
কলাবিভাগের বিখ্যাত ছাত্রকে শুক্রবার সংবর্ধনা দেবে স্কুল। খবর শুনে খুশি বাগান মিডিও। আমন্ত্রণপত্র হাতে নিয়ে মাথা নীচু করে টিচার্সরুমের সিঁড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পা রাখলেন ১৯ বছরের ফুটবলার৷ লড়াই সবে শুরু৷ চোখে এক আকাশ স্বপ্ন, সবটা পেরোতে হবে, হবেই…