‘দিস ইজ অসাম।’ দিন তিনেক আগে তাঁদের কীর্তিকলাপ দেখে এমনটাই বলেছিলেন অলিম্পিকে ৫ বারের সোনাজয়ী কিংবদন্তী জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানেচি। তাঁদের ১৫ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপে মাতোয়ারা হয়েছিল দেশ-বিদেশের সোশ্যাল মিডিয়া। দেখা গেছিল, স্কুল ইউনিফর্মে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে আসা ওই দু’টি বাচ্চা ছেলে-মেয়েকে একেবারে নিখুঁত ভাবে ভল্ট দিতে। কিন্তু কে জানত, ভাইরাল ভিডিওর সেই ছেলে-মেয়ে দু’টি এই শহরেরই বাসিন্দা! গার্ডেনরিচ অঞ্চলের ভূকৈলাস রোডের বস্তির ঘুপচি টিনের ঘরে তাদের বাস।
নুন আনতে পান্তা ফুরোনো পরিবারের ছেলে-মেয়ে দু’টি যে এভাবে রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গিয়েছে, তা প্রথমে টের পায়নি কেউই। কারণ তাদের জিমন্যাস্টিকসের ভিডিও যখন ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়, তখন জানা যায়নি সেটি কোথাকার। কেউ কেউ বলেছিলেন, নাগাল্যান্ডের রাস্তায় তোলা হয়েছে ওই ভিডিও। মনে করা হয়েছিল, ছেলে-মেয়ে দু’টিও হয়তো নাগাল্যান্ডেরই। কিন্তু খোঁজ-খবর করে জানা গেছে, কলকাতারই সম্পদ ১২ বছরের আলি এবং ১১ বছরের লাভলি। তাদের ভাল নাম অবশ্য মহম্মদ আজাজউদ্দিন এবং জেসিকা খান।
গার্ডেনরিচের সঙ্ঘমিত্রা বিদ্যালয়ে ক্লাস এইটের ছাত্র আলি এবং ক্লাস সেভেনের ছাত্রী লাভলির রাস্তার ধারে ভল্ট, এখন দু’জনকেই রীতিমতো সেলিব্রিটি বানিয়ে দিয়েছে। এবার টুইটারে তাঁদের ‘কীর্তি’র আরও ভিডিও পোস্ট করেছেন আলি ও লাভলির নাচের শিক্ষক শেখর রাও। যেখানে ফ্রন্ট প্রদুনোভা ভল্ট দিতে দেখা যায় আলিকে। পিঠে স্কুল ব্যাগ নিয়ে এক পাঁচিলের উপর থেকে দুর্দান্ত ভল্ট দেয় আলি। অন্যদিকে, এবারের ভিডিওয় আর ফ্রন্ট নয়, বরং সকলকে চমকে দিয়ে ব্যাক ভল্ট দিতে দেখা যায় লাভলিকে। তাও এক নয়, দুই নয়, কমপক্ষে ৬ বার। এই ভিডিওগুলিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল।
তবে দুরন্ত ভল্ট দিতে জানলেও এই আলি ও লাভলি প্রথাগত জিমন্যাস্টিক্স শেখে না। তাহলে তারা এই ভাবে ভল্ট দেয় কী করে? আসলে দু’জনেই নাচ শেখে বিকেল বেলায়। আর এখনকার নাচে যে রকম শারীরিক সক্ষমতা দেখাতে হয়, তার জন্যেই কিছুটা জিমন্যাস্টিক্স আয়ত্ত করতে হয় ডান্সারদের। সেই নাচের হাত ধরেই ভল্ট শেখা। আলি-লাভলির নাচের শিক্ষক শেখর রাও বলেন, ‘লাভলি ও আলি দু’জনেই দারুণ প্রতিভাবান। আমি ওদের জন্য বেশি কিছুই করতে পারিনি। আশা করব, এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরে কেউ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে ওদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য।’
প্রসঙ্গত, আলি-লাভলি- দু’জনেরই বাস দরিদ্র পরিবারে। দুই পরিবারই বাস করে বস্তির টিনের ঘরে। লাভলির মা রেশমা খাতুন জানিয়েছেন, নিম্নবিত্ত মুসলিম পরিবারে ছেলেমেয়েদের জিমন্যাস্টিকস শেখানোটা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। রেশমা একটি দরজির দোকান চালান। তাঁর স্বামী তাজ খান ড্রাইভার। রোজগার ১৪,০০০ টাকা। তাই দিয়েই ৫ জনের পরিবারের দিন গুজরান। রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার কেনার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। ফলে জিমন্যাস্টিকস শেখা দূরের কথা, মেয়ে নাচের স্কুলে যেতে চাইলেও বাধা দিতেন রেশমা।
তবু সকালে উঠে ঘরের কাজ সেরে চুপিচুপি নাচ শিখতে চলে যেত লাভলি। কখনও সঙ্গে থাকত প্রতিবেশী পরিবারের শিশু আলিও। এই নাচ শিখতে শিখতেই জিমন্যাস্টিকসের নানা কসরত শিখে ফেলেছে তারা। আলির বাবা-মা চা পাতার গুদামে দৈনিক মজুরির হিসেবে কাজ করেন। রোজগার সব মিলিয়ে লাভলির বাবা-মা’র মতোই। আলির মা বলেন, ‘একেবারে দিন আনি দিন খাই পরিস্থিতি। হরলিক্স, দুধ বা কোনও স্বাস্থ্যকর খাবার আলিকে দিতে পারি না। কেবল ভাত, ডাল আর সবজি। কখনও সখনও ডিম।’
এখন অবশ্য আলি-লাভলি দুজনের মা-বাবাই বুঝতে পেরেছেন, তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। তাই এখন সেই প্রতিভার বিকাশ চান তাঁরা। তবে প্রথাগত ভাবে জিমন্যাস্টিকস শিখতে গেলে যে নিয়মিতপুষ্টিকর খাবারের বন্দোবস্ত করতে হয়, বা আরও বিভিন্ন খরচ করতে হবে, তা যে এখনও তাঁদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়, তা-ও স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁরা। তবে প্রতিকূলতা যতই থাক, সামারসল্ট, কার্টহুইল ও সাইড ফ্লিপে তুখোড়, শহরের দুই ছেলে-মেয়ে আজ বিশাল স্বপ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ সেলিব্রিটি হয়ে গিয়ে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও, তারা জানিয়েছে, ভাল করে শিখে দেশের জন্য পদক আনতে চায় তারা! আলি জিমন্যাস্টিককে যেমন ভালবাসে তেমনই ভালবাসে তার শিক্ষককে। সে জানাচ্ছে, ‘আমি স্যরের মতো জিমন্যাস্টিক করতে চাই। দেশের জন্য সোনার পদক পেতে আর অন্য বাচ্চাদের শেখাতে চাই।’ লাভলির স্বপ্নও বিরাট। তার কথায়, ‘আমিও দেশের জন্য পদক আনতে চাই। আমার বাবা-মা আমাকে সব সময় সাহায্য করে। আমার বাবা বলেন, তুমি কেবল আমার মেয়ে নয়, ছেলেও। নিজের স্বপ্নকে নিয়ে বাঁচো।’