তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ। কলকাতার অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র, নরেন্দ্র নাথ দত্তই সন্ন্যাসী হয়ে নাম ধারণ করেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁরই অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ কিন্তু অগ্রজের প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাশীল হয়েও নিজে আধ্যাত্মবাদী বা সন্ন্যাসী হননি। তার বদলে তিনি হয়েছিলেন বস্তুবাদী ও সমাজবিপ্লবী। বস্তুবাদী তথা মার্কসীয় দৃষ্টিতে উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস-রচনায় বাঙালিদের মধ্যে তিনিই ছিলেন পথিকৃৎ। সংবাদপত্রসেবীও ছিলেন তিনি। সংবাদপত্রের মাধ্যমেও তিনি ঐতিহ্য-চেতনা ও বিপ্লব-ভাবনায় দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন।
“Dear Comrade Datta,
I have read your thesis. We should not discuss about the social classes. I think we should abide by my thesis on colonial question. Gather statistical facts about Peasant leagues if they exist in India.
Yours…
V. Ulyanov (Lenin).”
তারিখ ২৬শে আগস্ট, ১৯২১।
ছোট্ট একটা চিঠি।
তাতেই প্রাপক ওরফে ‘কমরেড দত্ত’ চার বছর বাদে দেশে ফিরেই শুরু করে দিলেন তাঁর কাজ! ভারতে তখন কিষাণ সভা সংগঠন নেই। কমরেড দত্ত একসাথে তখন শ্রমিক ইউনিয়নও গড়ছেন, আবার দেশের কোণায় কোণায় গড়ছেন কিষাণ সভাও! পরিসংখ্যানগত তথ্য চাই!
লেনিন চেয়েছেন যে!
ঋষি বাক্য অমান্য করা যায় না!
কোয়েশ্চেনেয়ার! জেলার কর্মীদের কাছে পাঠাতে থাকলেন নিয়মিত!
নাঃ, এদেশের মানুষের স্বভাব-আলিস্যিতে কোনও কাজই সময়ে হয় না! অতএব স্বীয় কর্ম স্বীয় কর্তব্য!
নিজেই ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করলেন কৃষকদের সম্বন্ধে তথ্য! সেসব স্থান পেল ‘ডায়ালেকটিক্স অফ ল্যান্ড-ইকনমিক্স অফ ইন্ডিয়া’তে। কিন্তু শুধু এই পরিসংখ্যানগত তথ্যেই ভরা নয় বই, তার আগে রয়েছে ভারতের হাজার বছরের ইতিহাসে ভূমিব্যবস্থার নানা দিক, বৈদিক যুগ থেকে মুঘল যুগ, বিভিন্ন সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ দলিল, তারপর ব্রিটিশ আমলে আসা! শুধু বর্তমান নয়, অতীতটাকেও জানা! শিকড়টাকে জেনে বর্তমানের আঙ্গিকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার চিন্তা! অখণ্ড ইতিহাসচেতনার এই সুরসাধনা! সাধকের নাম ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত!
ভূপেন্দ্রনাথের জন্ম ৪ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮০। প্রোক্টর বিশ্বনাথ দত্ত আর ভুবনেশ্বরী দাসীর কনিষ্ঠতম সন্তান। বিশ্ববরেণ্য দাদার চেয়ে সতেরো বছরের ছোট! যে বছর তাঁর জন্ম, সে বছরই দাদা নরেন্দ্রনাথ যাতায়াত শুরু করেছেন কেশব সেনের নববিধান ব্রাহ্মসমাজে! পরে ভূপেনও একই পথ ধরবেন! ততদিনে দাদা বিশ্বের মানুষের হৃদয় কেড়ে হয়ে গিয়েছেন আধুনিক ভারতের মুখ, পাশ্চাত্য পৃথিবীতে ভারতের সফল উপস্থাপক!
ভূপেন তখন সদ্য তরুণ! মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে এনট্রান্স পাশ এক যুবক। ব্রাহ্মসমাজে সান্নিধ্যলাভ করেছেন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর। সালটা ১৯০০ কি ১৯০২, সঠিক জানা যায় না! শিবনাথ শাস্ত্রীর ইচ্ছা ছিল, ভূপেন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই নতুন একটা প্রচারকমণ্ডলীর সৃষ্টি করা, কিন্তু ভূপেন্দ্রনাথ নিজে কখনও কট্টর ব্রাহ্মসমাজী বা সমাজের ধর্মপ্রচারে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। বরং ততদিনে তিনি ইতালীয় বিপ্লবী গিউসেপ্পে মাৎসিনির লেখা পড়ে ফেলেছেন, দাদার লেখা ‘কলম্বো থেকে আলমোরা’ পড়ে ফেলেছেন। ধারণা হয়েছে – “রাজনীতিক সংস্কার না হইলে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার হয় না”। দাদার জীবনপ্রদীপ তখন নিভে এসেছে, ভাই শুরু করছেন জীবন, নতুন স্বপ্ন নিয়ে!
১৯০২-০৩ সালেই যুক্ত হলেন বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতিতে। গুপ্ত সমিতির সভাপতি তখন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র বা পি. মিত্র। আর সংগঠক ও মুখ্য নেতা বলতে গেলে অরবিন্দ ঘোষ। এছাড়াও ছিলেন অবিনাশ চক্রবর্তী, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ (অরবিন্দের ভাইও বটে), অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, দেবব্রত বসু, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস প্রমুখ। ব্রাহ্মসমাজকে তিনি ত্যাগ করলেও এই ব্রাহ্মসমাজেই তিনি মুক্তচিন্তা করতে শিখেছিলেন। এছাড়া বাড়ির আবহাওয়াও তাঁর চরিত্রগঠনে সহায়তা করে। গুপ্ত সমিতিতে দীক্ষাদানের বেশ কিছু নিয়মাবলী ছিল। হিন্দুশাস্ত্র, তলোয়ার ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হত, দীক্ষাদাতার নাম বলার শাস্তি ছিল প্রাণদণ্ড। ভূপেন্দ্রনাথের উদারপন্থী চিন্তা শুধু হিন্দুশাস্ত্র ছুঁতে অস্বীকার করায় তাঁর বেলায় বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র ছুঁয়ে দীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। ভূপেন্দ্রনাথ কখনও এই নিয়মের বিরুদ্ধ কাজ করেননি, কখনও প্রকাশ করেননি তাঁর দীক্ষাদাতার নাম! তবে তাঁর বিভিন্ন লেখায় আকারে ইঙ্গিতে তিনি যা বুঝিয়েছেন, তাতে সবথেকে বেশি মনে হয়েছে, শ্রীঅরবিন্দই ছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু!
গুপ্ত সমিতিতে থাকাকালীনই ১৯শে জুলাই, ১৯০৫-এর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা। ভাইসরয় অ্যান্ড গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া জর্জ নাথানিয়েল কার্জন ওরফে লর্ড কার্জন অফ কেডেলস্টন। পশ্চিমপ্রদেশ একদিকে, পূর্ববাংলা আর অসম আরেকদিকে। আগুন! বাংলার সকল বিপ্লবীরাই যে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তা কিন্তু নয়! এমনকি ভূপেন্দ্রনাথও সেই উত্তাপ তখন পুরোপুরি বোঝেননি। ‘ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বইতে তিনি লিখেছিলেন,
“দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া সমগ্র বাঙ্গলা ভ্রমণ করিয়া এই উপলব্ধি করিলাম, স্বদেশী যুগে ধনীদের স্বাধীনতাস্পৃহা বলিয়া যাহা প্রতীত হইয়াছিল তাহা মরুভূমির মরীচিকা মাত্র। ইতিহাসের দ্বন্দ্বভাব জনিত বস্তুতন্ত্রবাদ (অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ) বলে, ইহার পশ্চাতে ছিল-শ্রেণীস্বার্থ”।
আসলে সেইসময়, ইংরেজদের তোষামোদ করে বেশ সুখেই দিন কাটানো নেটিভ স্টেটের রাজারা এবং জমিদাররা ভয় পেয়েছিল, যে সরকার হয়ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তুলে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রজা-শোষণকারীদের সমূহ বিপদ। তাই হঠাৎ করেই এই জেগে ওঠা ইংরেজ-বিদ্বেষ, দেশপ্রেমের হুজুগ।
মৈমনসিংহের মহারাজা সূর্য্যকান্ত আচার্য চৌধুরী বিপ্লবী সমিতির নেতাকে বোমা তৈরির জন্য এক হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন! ভূপেন্দ্রনাথের মত তরুণ বিপ্লবীরা এই সুযোগে বিপ্লববাদ প্রচার ও স্বদেশী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“স্বদেশী আন্দোলন কেবল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল ও কংগ্রেসওয়ালাদের বক্তৃতার গরমে কৃতকার্য্য হয় নাই; বরং প্রত্যেক জায়গায় বিপ্লববাদীরা কেন্দ্রস্বরূপ হইয়া স্বদেশী আন্দোলনকে পরিচালিত করিতেন ও তাহাকে কৃতকার্য্য করিবার যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন”।
গুপ্ত সমিতির পক্ষ থেকে ‘স্বদেশী রামায়ণ’ রচিত হয়। গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কাব্যতীর্থ, যিনি কিনা ছিলেন কালীমন্দিরের পুরোহিত, তিনি এই আখ্যান রচনা করেন। তখনকার বিশিষ্ট অভিজাত বাড়িতে এই গান কথকতা হত, যেমন মৈমনসিংহের জমিদার জগৎকিশোর আচার্য্য চৌধুরির বাড়িতে হয়েছিল, এবং ভূপেন্দ্রনাথের লেখাতেই পাওয়া যায়, ‘সিংহের দাপটে প্রাণ যায় মা’ গান শুনে জগৎকিশোর হেসে ফেলেন! তবে এইসময়েই বিপ্লববাদ শুধুমাত্র গুপ্ত সমিতির অভ্যন্তরীণ গোপনীয়তায় আবদ্ধ হয়ে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার নানা প্রান্তে, গ্রামগঞ্জ-মফস্সল সর্বত্রই। সৌজন্যে এই মানুষটি।
বই ফেরি করার অছিলায় তাঁর সাথে যোগাযোগ হয় নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খাঁ-র সঙ্গে। পটলডাঙার বনেদি বাড়ির ছেলে, বিলেত ফেরত সুবোধচন্দ্র মল্লিক বিপ্লবীদের অর্থ এবং রাজনৈতিক সাহায্য করছিলেন, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশন স্থাপিত হল! ১৯০৬ সালের ২৫শে জুলাই, দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে পথচলা শুরু হল সম্পূর্ণ ভারতীয় শিক্ষাবিদদের হাতে তৈরি বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট বা বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের (পরবর্তীকালে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি)। ইংরেজ-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে রংপুর, পাবনা, দিনাজপুর, জলপাইগুড়িতে, থমকে থাকা কাজ আবার শুরু হচ্ছে কটকে, বিংশ শতকের শুরুটাই হচ্ছে এমন ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে! বাংলায় প্রকাশিত হচ্ছে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সন্ধ্যা’ এবং ইংরাজিতে অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দে মাতরম’ (যেখানে নিয়মিত অর্থসাহায্য করতেন সুবোধ মল্লিক)! এরপর আসবে ‘যুগান্তর’। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ আর অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনা! দাম মাত্র এক পয়সা। কয়েকদিনেই পাঠক সংখ্যা ছুঁল কুড়ি হাজার।
১৯০৭! ‘ভয় ভাঙ্গা’ আর ‘লাঠৌষধি’। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। ভূপেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা! কৌঁসুলি ছিলেন আশুতোষ চৌধুরী, চিত্তরঞ্জন দাস, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি! আত্মপক্ষ সমর্থন করতে রাজি হননি ভূপেন। বয়ানে লিখেছিলেন,
“সবাই যা সত্য বলে জানে এবং আমার সকল দেশবাসীর মনে যা আছে তা-ই আমি লিখেছি, কিন্তু আমি জানতুম যে সে কাজ করে ব্রিটিশ আদালতে কোনো ন্যায়বিচারের সুযোগ আমি পাব না। আমি সর্বদাই যে মত প্রচার করেছি তার সঙ্গে তাদের (ব্রিটিশ আদালতের) সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করাকে আমি সঙ্গত বলে মনে করি না”।
শান্ত ভাষায় উদ্ধত চাবুক!
কৌঁসুলিরা অবশ্য এই বয়ান পড়েননি, ভূপেনের শাস্তির কথা মাথায় রেখেই, মূল ভাষা দুর্বল করে আদালতে বয়ান দেন! ভূপেনের এই পদক্ষেপ ছিল, পরাধীন ভারতে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম অসহযোগ প্রদর্শন! তারিখটা ২২শে জুলাই, ১৯০৭। জামিনের ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এলেন অনেকেই! সঞ্জীবনী-সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, এমনকি নিবেদিতাও (নিবেদিতাকে ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা এই কারণে জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়েছিল)!
একবছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঙ্গলি কাগজে শিরোনাম হল, “রিসিভড সেন্টেন্স উইথ সিরিন ডিগনিটি!”
অরবিন্দ ঘোষ ‘বন্দে মাতরম’ কাগজে লিখলেন “ওয়ান মোর ফোর দ্য অলটার” আর “শ্রীযুত ভূপেন্দ্রনাথ”।
হ্যারিসন রোডে ডা. নীলরতন সরকারের বাড়িতে কৃষ্ণকুমার মিত্রের স্ত্রী লীলাবতী দেবীর সভাপতিত্বে মহিলাদের তরফ থেকে ভুবনেশ্বরী দেবীকে দেওয়া হল সংবর্ধনা (পরে এই প্রসঙ্গে জেল থেকে বেরিয়ে তিনি মাকে কৌতুক করে বলেছিলেন, “বিবেকানন্দের মা হয়ে তো তুমি কোন স্বীকৃতি পেলে না, কিন্তু আমার মা হয়ে তুমি জন-সম্বর্ধনা লাভ করেছ”।)! আরও নানা পত্রিকা ‘বসুমতী’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘নবশক্তি’, ‘হিতবাদী’, ‘সঞ্জীবনী’তেও তখন নিয়মিত খবর! ভূপেন্দ্রনাথের গ্রেপ্তার, অসহযোগ যেন নতুন করে প্রাণ এনে দিল স্বদেশী আন্দোলনে!
১৯০৮ সালে জুন মাসে ভূপেন্দ্রনাথ জেল থেকে ছাড়া পেলেন! এরপর শুরু হবে তাঁর সংগ্রামী জীবনের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বের শুরুতে অনেকটাই জুড়ে থাকবেন তাঁর মাতৃসমা ভগিনী নিবেদিতা, যিনি ভূপেনকে ডাকতেন ‘ভূ’ বলে! জেলে থাকাকালীনই নিবেদিতা তাঁকে উপহার দিয়ে এলেন পিটার ক্রপ্টোকিনের ‘মেময়ার্স অফ আ রেভোলিউশনিস্ট’ আর ‘ইন রাশিয়ান অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ প্রিজনস’, সাথে মাৎসিনির রচনাগুচ্ছ। তাঁর স্বদেশপ্রেম দেখে এই নিবেদিতাই একদিন তাঁকে বলেছিলেন,
‘“ভূপেন, আই কনসিডার ইউ কনসিক্রেটেড। ডোন্ট ম্যারি”।
ভূপেন বিয়ে করতে চান না শুনে দাদা নরেন্দ্রও ছোটভাইয়ের সম্পর্কে বলেছিলেন ‘ভেরি ভেরি গ্রেট ম্যান!’
যাহোক, ভূপেন কিন্তু সেকথা রেখেছিলেন! জেল থেকে বেরিয়ে বেলুড় মঠে আত্মগোপন করলেন বসন্তকুমার ব্রহ্মচারী নামে, কারণ সেই বছরেরই ১১ ডিসেম্বর ১৮১৮-র ৩য় রেগুলেশন অনুযায়ী সুবোধ মল্লিক, কৃষ্ণকুমার মিত্র, অশ্বিনীকুমার দত্ত-সহ যে দশজনের নামে আন্দামানে দ্বীপান্তরে পাঠানোর হুলিয়া বেরোল, সেই তালিকায় ভূপেন্দ্রনাথের নামও ছিল!
এরপর ১৯০৮ সালে ভগিনী ক্রিস্টিনের (প্রকৃত নাম ক্রিস্টিনা গ্রিনস্টিডেল; মার্কিন অনুরাগিনী) পরামর্শে ইংরেজ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে ছদ্মবেশে ভূপেন্দ্রনাথ পাড়ি জমালেন মার্কিন প্রবাসে। নিউইয়র্ক। সবদিক দিয়েই সাহায্য পেলেন নিবেদিতার। স্বামীজীর বিশেষ বান্ধবী (স্বামীজী স্বয়ং তাঁকে এই সম্বোধন করতেন) জোসেফিন ম্যাকলেওডকে নিবেদিতা চিঠিতে জানিয়ে দিচ্ছেন, বইপত্র, জামাকাপড়, ট্রাম-ভাড়া এসমস্তের ব্যবস্থা যেন তিনি অনুগ্রহ করে করে দেন। এমনকি ভূপেন্দ্রনাথ কী বিষয়ে পড়াশোনা করবেন, সে বিষয়েও মিস ম্যাকলেওডের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে একটা পাঠক্রম আছে। এটি ইতিহাস বা সমাজ (তত্ত্ব) বা এই সবেরই কিছু কিছু-ভূপেন্দ্রনাথের পক্ষে ঠিক বিষয় হবে। নিবেদিতা চাইতেন, তাঁর ‘ভূ’ মন দিয়ে পড়াশোনা করুন, তাই পড়াশোনায় অমনযোগী হলেই চিন্তিত হয়ে পড়তেন।
১৯১০ সালে নিবেদিতা আমেরিকায় গিয়ে ভূপেনের সাথে দেখা করেন, নানা বিষয়ে তাঁদের আলোচনাও হয়। নিবেদিতা বলেছিলেন, “আই এম কনভিন্সড হাউএভার দ্যাট ‘ভূ’ ইজ অফ গ্রেট পোটেনশিয়ালিটি – অ্যান্ড অফ কোর্স হি ইজ অ্যাবসলিউটলি ডিয়ার”। পরেরবছর আবারও একবার নিবেদিতা গিয়েছিলেন, তখনও দেখা করেন ভূপেন্দ্রনাথ। সারাজীবন এই মহীয়সী রমণীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অটুট ছিল! এমনকি নিবেদিতার সম্পর্কে অতিপ্রচারের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন! তাঁর মতে, এতে নিবেদিতাকে অসম্মানই করা হয়েছে!
১৯১২ সালে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিবেদিতার কথামতই ইতিহাসবিজ্ঞান শাখায় স্নাতক হলেন। পরের বছর রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (এ. এম.) হলেন, স্পেশাল পেপারে ছিল সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব।
এরপর ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভূপেন্দ্রনাথ পাড়ি দিলেন জার্মানি! আমেরিকাতে থাকাকালীনই তিনি সান ফ্রান্সিসকোর গদর পার্টির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, সেসময় থেকেই কমিউজিম পড়া শুরু করেছেন। জার্মানিতে এসেই শুরু করে দিলেন তাঁর স্বাধীনতা-সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব। জার্মানিতে ভারতীয় ছাত্ররা যে কমিটি গঠন করেছিল, সেই ‘বার্লিন কমিটি’র সেক্রেটারি হলেন ১৯১৫ সালে। বার্লিন কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অবিনাশ ভট্টাচার্য, সি. পদ্মনাভন পিল্লাই, তাঁর ভাই চম্পকরমণ পিল্লাই, ড. ধীরেন সরকার, এন. এস. মারাঠে, ড. জে এন দাশগুপ্ত প্রমুখ। পরে এই কমিটির নাম রাখা হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটি।
হিন্দু-জার্মান কন্সপিরেশির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই কমিটির সদস্যরাই (বাঘা যতীন ও তাঁর দলকে অস্ত্রসাহায্য করার কথা থাকলেও তা ব্যর্থ হওয়ার ইতিহাস)। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, এইসময় ভারতে সার্বিক বৈপ্লবিক আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত। একমাত্র বাংলা ও পঞ্জাবের মানুষ ছাড়া আর কেউই বিপ্লবে আগ্রহী ছিলেন না। ১৯১৭ তে বার্লিন কমিটি বুঝতে পারল যে আর বিপ্লবের কোনও আশা নেই। আসলে তাঁরা বিপ্লবের কথা বলে গেলেও দেশের জনগণের একটা বড় অংশের কাছে পৌঁছতে পারেননি। সেই বছরেরই মে মাসে সুইডেনের রাজধানী স্টকহল্মে বার্লিন কমিটির একটি শাখা খোলা হল। বীরেন্দ্রনাথ সেখানে গিয়ে লেনিনের খোঁজ করলেন, কিন্তু লেনিন তখন পেত্রোগ্রাদ চলে গেছেন। বীরেন্দ্রনাথ তখন পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতকে একটি চিঠিতে প্রকাশ করলেন তাঁদের বক্তব্য ও সোভিয়েতের সাথে তাঁদের কাজ করার আগ্রহ। ভূপেন্দ্রনাথও এলেন কিছুদিন পরে। কিরিল ট্রয়ানোভস্কির সাথে তাঁর আলাপ হয়। রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের আগেই বার্লিন কমিটির ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে রুশদের কিন্তু যোগাযোগ স্থাপন হয়ে গেছে! অর্থাৎ এমনটা নয় যে, রুশ বিপ্লবের পরেই ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে কমিউনিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠল!
ভূপেন্দ্রনাথ কিন্তু রুশ বিপ্লবের আগে থেকেই মার্কসবাদ লেনিনবাদের সম্পর্কে পড়াশোনা করছেন! কিন্তু তার সাথে জাতীয়তাবাদকেও তিনি মিলিয়ে দিচ্ছেন তাঁর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এই তিনকালের অখণ্ড ইতিহাসবোধের পারিপাট্যে! তাঁর বিপ্লববাদে এসে মিলছে মহারাজা নন্দকুমার, মঙ্গল পাণ্ডে, আজিমুল্লা খাঁ, তাঁতিয়া টোপি, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, হজরৎ মহল, বাহাদুর শাহ থেকে হো নেতা বিরসা ভগবান, রাজা রামমোহন রায়, ইয়ং বেঙ্গল থেকে পি. মিত্র, অরবিন্দ ঘোষ! যে কারণে পরবর্তীকালে আরেক বিশিষ্ট প্রবাসী বাঙালি কমিউনিস্ট মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সাথে তাঁর বিরোধ হয়ে উঠবে অবশ্যম্ভাবী!
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আসল নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। অনুশীলন সমিতির সদস্য, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন) সাথে যুগান্তর দলের হয়ে কাজ করেছেন, হাওড়া-শিবপুর মামলায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন! জার্মান সরকারের সাথে অস্ত্রসাহায্যের ব্যাপারে বাটাভিয়া যান কনসাল জেনারেলের সাথে দেখা করতে, নাম নিয়েছিলেন চার্লস মার্টিন! সব ব্যবস্থা করে যতীনকে নিয়ে যান বালেশ্বরে, সেখানেই লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন! তারপর আবার বাটাভিয়া। এবার হরি সিং ছদ্মনামে! গিয়ে দেখলেন, জার্মানরা আদৌ সহযোগিতা করতে রাজি নন! অস্ত্র না নিয়ে দেশে ফিরবেন না, এই ভেবে এবার মিস্টার হোয়াইট নাম নিয়ে জাপানে যান রাসবিহারী বসুর কাছে! সেখানে থেকে চিনের পিকিং (বর্তমান বেজিং) শহরে জার্মান কনসুলেটের সাথে অস্ত্রের ব্যাপারে ব্যবস্থা করে ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে পালালেন সান ফ্রান্সিসকো!
১৪ই জুন, ১৯১৬ তে এলেন সান ফ্রান্সিসকোয়। ব্রিটিশ অথরিটির সন্দেহ কিন্তু তাঁর পিছু ছাড়েনি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর, “আ ডেঞ্জারাস হিন্দু রেভোলিউশনারি, জার্মান স্পাই, ল্যান্ডস ইন ইউএসএ”। বিপদ আসন্ন বুঝে হোটেল ছেড়ে দিলেন পরদিনই! স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ বাঙালি অধ্যাপক প্রফেসর ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করলেন! ধনগোপাল ছিলেন আরেক যুগান্তরী বিপ্লবী যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ভাই। ধনগোপালই তাঁর নাম বদলে দেন মানবেন্দ্রনাথ রায়ে (বোধহয় ‘নর’ অর্থে ‘মানব’, সেই ধারণা থেকেই)। ধনগোপালের সাহায্যেই অধ্যাপক ডেভিড জর্ডনের সাথে তাঁর দেখা হয়। জর্ডনের বাড়িতেই মার্কিন তরুণী এভেলিন ট্রেন্টের সাথে তাঁর আলাপ হয়, তাঁর ভবিষ্যৎ স্ত্রী। ১৯১৭ তে নিউইয়র্কে লালা লাজপত রাইয়ের বাড়িতে সস্ত্রীক আশ্রয় নেয় মানবেন্দ্র। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে মার্কসবাদের বই পড়ে মার্কসবাদ সম্পর্কে আগ্রহ জন্মেছিল! সেই বছরই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করল আমেরিকা! ফলে আবারও বিপদ। এবার জর্ডনের সাহায্যে এভেলিনকে নিয়ে পালালেন মেক্সিকো! এখানেই বলশেভিক নেতা মিখাইল বরোদিনের সাথে আলাপ, ১৯১৯-এ! বরোদিন তখন কপর্দকশূন্য অবস্থায়! মানবেন্দ্রই মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট ভেনুস্তিয়ানো কারাঞ্জার সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেবছরেরই এপ্রিলে! বরোদিনের কাছে তাঁর কথা শুনে লেনিন তাঁকে তৃতীয় কমিন্টার্নের (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল) দ্বিতীয় অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানালেন।
১৯১৯-এর ডিসেম্বরে মস্কো যাওয়ার পথে বার্লিনে তাঁর সাথে আলাপ হল ভূপেন্দ্রনাথের। বরোদিনও সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু প্রথম আলাপ থেকেই দুজনের মতাদর্শগত বিরোধ প্রকাশ পেয়েছে! অধিবেশনের পরে বরোদিন বার্লিনে ফিরে এলেও মানবেন্দ্র মস্কোতেই থেকে যান! বরোদিন ভূপেনকে বার্লিনে একটি কমিটি গঠন করে ভারতের সঙ্গে কমিন্টার্নের সম্পর্ক স্থাপনের কাজ শুরু করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। ১৯২০-র নভেম্বরে বীরেন্দ্রনাথ তৃতীয় কমিন্টার্নের নেতাদের সাথে আলোচনা করতে মস্কো গেলেন। তার কয়েক মাস বাদেই ১৯২১-এর এপ্রিল বা মে মাসে বার্লিনের ভারতীয় বিপ্লবীরা মস্কো রওনা হলেন। ভূপ্রেন্দ্রনাথও গিয়েছিলেন। তৃতীয় অধিবেশন চলল জুন থেকে জুলাই। কিন্তু রাজনৈতিক ও সাংগাঠনিক প্রশ্নে সকলে সহমত হতে পারেননি। তার আগেই ১৯ই জুলাই, ১৯২০, তুর্কেস্তান অটোনমাস সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের রাজধানী (বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী) তাশখন্দে সূচনা হয়েছে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির। ১৯২১-এর এই মস্কো আলোচনায় এই পার্টির আন্দোলনের কর্মসূচি কী কী হবে, এইসব বিষয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা হয়েছিল। এই আলোচনার সময়েই মানবেন্দ্র, বীরেন্দ্র ও ভূপেন্দ্র, তিনজনে তিনটি আলাদা থিসিস উত্থাপন করলেন। তিনটি থিসিস সম্পূর্ণ তিনটি আলাদা মতের ঊপর দাঁড়িয়ে। এই গোলমালের কারণে কমিন্টার্ন একটি ভারত-সম্পর্কিত কমিশন বসায়, যার সেক্রেটারি ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান নেতা মাতিয়াস রাকোসি। ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর থিসিস জমা দেন এই কমিশনে, আর তারই একটি সংশোধিত রূপ রাকোসি মারফত পাঠিয়ে দেন লেনিনের কাছে ২৩শে আগস্ট, ১৯২১। ‘কমিউনিস্ট রেভোলিউশন-ফাইনাল সলিউশন অফ দ্য প্রবলেম’। সঙ্গে একটি চিঠিও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লেনিনকে। সেই চিঠিটি পরে পাওয়া গেলেও থিসিসটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি! এই থিসিস পড়েই উপরিউল্লিখিত চিঠিটি লেনিন লিখলেন ভূপেন্দ্রনাথকে, তিনদিন বাদে, ২৬শে আগস্ট, ১৯২১। অনেকে বলে থাকেন, লেনিনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল, আলোচনা হয়েছিল, এবং লেনিন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোরও প্রস্তাব দেন! কিন্তু এসবই মনগড়া তথ্য! কারণ আজ পর্যন্ত এসবের কোনও প্রমান ইতিহাস পায় নি।
তৃতীয় অধিবেশনের পর বার্লিনের বিপ্লবীরা ১৯২১-এর সেপ্টেম্বরে আবার বার্লিনেই ফিরলেন! মানবেন্দ্র মস্কোতেই থেকে যান! মানবেন্দ্রনাথের সাথে তাঁর মতপার্থক্য কী, এবিষয়ে বরোদিন তাঁর কাছে জানতে চাইলে ভূপেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, রায় জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কাজ করতে চান না, কিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলনে ভারতে জাতীয়তাবাদী ছাড়া আর পাবেই বা কাকে! ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদী অতীতকে অত্যন্ত সযত্নে ও সগৌরবে রক্ষা করেছিলেন! মার্কসবাদে উত্তরণ হলেও জাতীয়তাবাদকে কখনওই সম্পূর্ণ ত্যাগ করেননি, কিন্তু মানবেন্দ্রর ক্ষেত্রে এই উত্তরণের ব্যাপারটা ছিল তাঁরই ভাষায় “ইট’স আ মিরাকিউলস ট্রান্সফর্মেশন”! ফলে সেখানে বিরোধিতা আসাটা একপ্রকার ছিল বাধ্যতামূলক!
মস্কো থেকে ফিরে ভূপেন্দ্রনাথ আবার গবেষণায় মনোনিবেশ করলেন। ১৯২২ সালে হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে পিএইচডি লাভ করলেন। ব্রিটিশ সরকার এরপর থেকেই তাঁর ও এম. এন. রায়ের দলের কাজকর্মের ওপর নজরদারি করা শুরু করেছে। সমগ্র ভারতে তখন তলে তলে বলশেভিক কাজকর্ম হয়ে চলেছে, এই সন্দেহ ব্রিটিশ সরকারের হয়েছিল। নিজেদের মধ্যেও আর মতের মিল হচ্ছিল না তখন! ১৯২৪-এর সেপ্টেম্বরে ভূপেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ রাজনীতিক আর্থার পনসনবিকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, আর নয়, এবার তিনি নৃতত্ত্বের অধ্যাপনায় নিজেকে নিয়োগ করতে চান, তাঁর ধারণা অনেকই বদলে গেছে আগের থেকে! ১৯২৫-এর এপ্রিলে, দেশছাড়ার সতেরো বছর পরে তিনি ভারতে ফিরে এসে শুরু করলেন তাঁর কাজ। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান নিউজ অ্যান্ড ইনফরমেশন ব্যুরো। ফিরে এসে কলকাতাতেই উঠলেন। ভেবেছিলেন অধ্যাপনার চাকরি নেবেন, কিন্তু বিপ্লবী-ট্যাগ লাগানো ব্যক্তিকে অধ্যাপক হিসাবে নিতে ভরসা করলেন না রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী বা শ্যামাপ্রসাদের কলকাতাও!
১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে স্থাপন করলেন বেশ কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়ন, ১৯৩৩ সালে লেনিনের কথামত স্থাপন করলেন ডিস্ট্রিক্ট কিষাণসভা। ১৯২৬-এ কলকাতা ট্রাম-ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, ১৯২৯-এ বাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা করলেন, দুটি সংগঠনেই সভাপতি ছিলেন! সভাপতি ছিলেন ১৯৩০-৩১-এ জুট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ও প্রেস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নেও। ১৯২৭-২৮-এ অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি হলেন, তারপর সেখান থেকে ভেঙে যখন ১৯৩২-এ তৈরি হল রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, তারও কোষাধ্যক্ষ হলেন! অল ইন্ডিয়া কিষাণসভার অফিস-বেয়ারার ছিলেন বেশ কিছুদিন। অর্থাৎ এখান থেকেই কিন্তু এটা পরিষ্কার, তাঁর ওপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল মার্কস-লেনিনের বাণী যে তিনি ফিরেই একদম শ্রমিক-কৃষকস্তরের মানুষদের নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন! দেশে ফিরে ভূপেন্দ্রনাথ শুধু সারা বাংলাই নয়, ভারতেরও বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেছেন, মার্কসবাদের তত্ত্ব প্রচার করেছেন। ততদিনে তৈরি হয়েছে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সি. পি. আই.-এর প্রতিষ্ঠা ২৬শে ডিসেম্বর, ১৯২৫)। ১৯২৬-এ গৌহাটির কংগ্রেস অধিবেশন, একইসাথে বসল ‘রাজনৈতিক নির্যাতিতদের সম্মেলন’-ও। সেখানে ভূপেন্দ্রনাথের অভিভাষণ ছিল শ্রমিক-আন্দোলনের সংগঠক শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়ের মতে “ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রথম প্রকাশ্য সোশ্যালিজমের প্রচার”! তাঁর মুখ্য বিরোধী মানবেন্দ্রনাথ রায়ও ‘দ্য ম্যাসেস অফ ইন্ডিয়া’-র ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭-এর সংখ্যায় প্রশংসা করেছিলেন এই বক্তৃতার! যুবসম্মেলন, কর্মীসম্মেলন ইত্যাদিতে তিনি সভাপতিত্ব করতেন এবং সেখানে তিনি ক্রমাগতই মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে প্রচার করেছেন! ফলত, যেটা হল, ‘যুগান্তর’ দলের কাছে তিনি ক্রমশই হয়ে উঠলেন অপ্রিয়। একসময়কার নেতা, হঠাৎ বিদেশ থেকে ফিরে এলেন সোশ্যালিস্ট হয়ে, এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি! কারণ তিনি যদি কমিউনিজম প্রচার করতে থাকেন, তবে ক্রমশই নতুন ছেলেরা ‘বিপথগামী’ হবে। এই বিষয়ে লিখে গেছেন নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়!
কিন্তু ভূপেন্দ্রনাথের প্রভাবকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, কারণ তিরিশের দশকেই জেল থেকে বেরিয়ে বহু তরুণ বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। ভূপেন্দ্রনাথকে ভুল বুঝেছিলেন আসলে দু’দিকের স্বদেশীরাই। তিনি কিন্তু আজীবন ন্যাশনালিস্ট এবং কমিউনিস্টদের মধ্যেকার সেতুবন্ধন করে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছেন! কখনও কোনও পার্টিতেই ঢোকেননি, না কমিউনিস্ট পার্টি না অন্য কোনও পার্টি! অথচ কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির নেতৃত্বগণ যেমন, বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ লাহিড়ী, ভবানী সেন (ভবানীশঙ্কর সেনগুপ্ত), সরোজ মুখোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর চৌধুরি, বিনয় চৌধুরিদের সাথে তাঁর চিরকাল শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। সরোজ আর রামেন্দ্রসুন্দরকে ১৯২৯ সালে ভূপেন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
“যদি খাঁটি কমিউনিস্ট হতে চাস, যদি কমিউনিস্ট পার্টি করতে চাস তো ৮১ নং জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের তেতলায় একটা ঘরে আব্দুল হালিমের (ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস’ পার্টির সদস্য; মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন; গণশক্তি প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা) সঙ্গে যোগাযোগ কর।”
আবার এই আব্দুল হালিমেরই গুরুস্থানীয় মুজফফর আহমেদ বরাবর ভূপেনের প্রতি চূড়ান্ত অশ্রদ্ধা দেখিয়ে এসেছেন! আমেরিকা-ইউরোপ থেকে উচ্চশিক্ষিত মানুষটি, যিনি কিনা কখনও নিজের সোশ্যাল স্ট্যাটাসকে আগে না বসিয়ে লেনিনের ঋষিবাক্যকে শিরোধার্য করে সেই অনুন্নত যাতায়াতের যুগে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম, হয়ে উঠেছেন কৃষকদের বন্ধু, তাঁর সম্বন্ধে কিনা মুজফফর বলছেন – “এক দিক থেকে তিনি নীতিহীন ব্যক্তি। তিনি চির অসন্তুষ্ট ব্যক্তি। অসন্তুষ্ট ব্যক্তিরা অসুখী হবেনই”। অথচ, পার্টির বিপদের সময়ে এই মানুষটাই কিন্তু বরাবর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ১৯২৯-এর ৪ই জুলাই জওহরলালের পক্ষ থেকে ভূপেন্দ্রনাথকে লেখা চিঠি থেকে জানা গিয়েছিল, যে জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস মিরাট মামলার দায়িত্ব নিতে পারবে না! ভূপেন্দ্রনাথই কিন্তু নিজে উদ্যোগ নিয়ে অভিযুক্তদের আইনগত সহায়তা দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আক্ষেপ করে বলেছেন, তখন তো এই ‘নীতিহীন’তার কথা কেউ ভাবেন নি।
আসলে ভূপেন্দ্রনাথ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বরাবরই বলে এসেছেন যে, এই দুই পার্টিই ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনে প্রকৃত অর্থে সাহায্য কিছুই করেনি। লেনিন আর স্ট্যালিনের সম্পর্কে শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু ট্রটস্কি বা রাডেকের প্রতি ছিল বিরাগ! ভারতে এসে তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রাম আর শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন একসূত্রে বাঁধা থাকুক, কারণ স্বাধীনতা বা বিপ্লব মানে শুধু ইংরেজ মেরে ইংরেজ তাড়ানো নয়, স্বাধীনতা মানে একটা সার্বিক পরিবর্তন! দুঃখের বিষয়, কমিউনিস্ট পার্টির তখনকার নেতাদের মধ্যে এতখানি প্রসারিত চিন্তাভাবনার মানুষ ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বোধ আর প্র্যাক্টিকেবলিটির দারুণ অভাব ছিল! বরং তিনি জার্মানদের সম্পর্কে বলেছেন,
“ভারতের স্বাধীনতা-স্পৃহার সহিত তাহাদের সহানুভূতি আছে বলিয়া অনেকবারই জার্মান গভর্নমেন্ট প্রকাশ্যে স্বীকার করিয়াছেন।”
এমনকি, সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের মানসিকতার পেছনেও বার্লিন কমিটির কর্মনীতি কাজ করেছিল বলে মনে করেন, এই ঘটনার প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল! জাতীয় কংগ্রেসের ডাকেও বিভিন্ন আন্দোলনে ভূপেন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছেন, জেলও খেটেছেন, কিন্তু বরাবর গান্ধি-নেহরু মতাদর্শের সমালোচনা করেছেন। জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে বলেছেন,
“জাতীয় কংগ্রেস ভারতের অভাব জানাইবার পক্ষে একটি বাষ্পযন্ত্রের (safety valve) কার্য করে বটে; কিন্তু ইহা স্বাধীনতার প্রকৃত ক্ষুধা মিটাইতে পারে নাই!”
অপ্রিয় শোনালেও কথাটা কিন্তু সত্যি! বারেবারেই কিন্তু সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রয়োজন পড়েছে। বিপ্লব করতে এসেও সেখানে শ্রেণিবৈষম্য, এর বিরুদ্ধেও ভূপেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এটা বুর্জোয়া দর্শনশাস্ত্র, যেখানে বুর্জোয়া বিপ্লবীরা ভেবেছিল, নিম্নশ্রেণীর মানুষ আসলে কুকুর, যাদের ডাকলেই কুকুরের মতো আসবে আর যা বলা হবে, করবে! পুরনো দলের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ এনে তাদের সমালোচনা করেছেন,
“ভারতীয় বিপ্লবপন্থীরা বা কংগ্রেসওয়ালারা কোনো দলই নিজেদের মতানুযায়ী দর্শনশাস্ত্র এখনও গড়িয়া তুলেন নাই।”
ভূপেন্দ্রনাথ আসলে এই দলীয় রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। গান্ধিবাদের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, এটা এককথায় ইউরোপের utopian socialism, গান্ধীবাদ নামে চলছে। তাঁর আসলে বক্তব্য ছিল, এই মতবাদ নতুন কিছু নয়, বরং এটা অনেকটাই পাশ্চাত্য পৃথিবী থেকে এসেছে! তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষে যে সকল রাজারা নিজেদের অহিংস বলেছেন, তাঁরাই কিন্তু পরবর্তীকালে নিজেদের নিয়ম জোর করে প্রজাদের ওপর চাপিয় দিয়েছেন, না মানলে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে আর অহিংসা থাকল কোথায়? শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে অহিংসবাদ কোথায়? এতদসত্ত্বেও ভূপেন্দ্রনাথ কিন্তু স্বীকার করেছেন, যে গান্ধিবাদী অহিংস আন্দোলন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল এবং একটা অহিংস ধারার সূত্রপাত হয়েছিল জাতীয় আন্দোলনে। শেষমেশ তিনি এটা বলেছেন কিন্তু যে, “যাইহোক, অহিংসবাদ ও হিংসাবাদ উভয় প্রণালীই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এইজন্য এক পন্থাকে উচ্চাসন দেওয়া ও অন্য পন্থাকে নিন্দা বা ঘৃণা করা, এতে কেবল শ্রেণিগত পক্ষপাতদুষ্টতা প্রকাশ পায়।”
ভূপেন্দ্রনাথ আসলে যেখানে নিঃস্বার্থ বিপ্লব, সর্বস্ব ত্যাগ করে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া তরুণদেরকেই বরাবর স্বাগত জানিয়েছেন। যারা কোনও মার্কা-মারা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কাজ করে না, কাজ করে বিবেকের তাড়নায়। সুভাষচন্দ্রকে স্নেহ করতেন, গান্ধিবাদীদের সাথে চূড়ান্ত বিরোধিতায় যেতেও বারণ করেছিলেন সুভাষকে!
“শ্রমিক নিজের আদর্শ, নিজের কর্মপন্থা অনুসরণ করিয়া জেলবরণ করিয়াছে। কৃষকও ভীষণ অত্যাচার সহ্য করিয়াছে। আবার এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নিবার জন্যও মেদিনীপুরে যেমন অনেকে শহিদ হইয়াছেন, তেমনি বিদ্যুৎ বাহিনী, ঝটিকা বাহিনী প্রভৃতির উদয় হইয়া অত্যাচার প্রতিরোধ করিয়াছে। যেমন ক্ষুদিরাম, বিনয় বসু ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে বাংলা ভুলিবে না, তেমনি মাতঙ্গিনী হাজরাকেও ভুলিবে না। সর্বত্রই এক মনস্তত্ত্ব-আদর্শে নিষ্ঠা ও নির্ভীক চিত্তে কর্মযোগের সাধনা। ইঁহারা কেউ লাভ বা অলাভের চিন্তা করেন নাই। আদর্শের বেদীতে নিজেদের বলিদান করিয়াছেন।”
এনাদের কথা ভেবেই হয়ত ভূপেন্দ্রনাথ ১৯৪৭-এর আজাদিকে ঝুটা বলতে রাজি নন! দেশভাগ তাঁকে মর্মাহত করেছিল, তাও বরাবর আশাবাদে বিশ্বাসী মানুষটি ভাবতেন, আবারও হয়ত অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তায় পুনঃসংযোজিত হবে তাঁর দেশ! ‘বিবেকানন্দের ভাই’ বলে পরিচয় দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হতেন, কিন্তু এমন মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়ার পেছনে একটু হলেও কি দাদার অবদান নেই?
বিখ্যাত মহাপুরুষের সাথে রক্তের সম্পর্ক থাকলে যা হয়, ভূপেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন! হয়ত দাদার কর্ম, চিন্তা-এসবকিছুরই প্রভাব তাঁর ওপর পড়েছিল, দাদার মত তিনিও কখনও নিজের জন্য চিন্তা করেননি, সংসারত্যাগী দেশপ্রেমিক হয়েছিলেন, কিন্তু তাও তাঁরও তো নিজস্ব পরিচয় ছিল! ইংরেজের আইনকক্ষে দাঁড়িয়ে প্রথম অসহযোগ প্রদর্শনকারী মানুষটি, কোনোদিন কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিলেন না! বিরোধিতা করলে প্রকাশ্যে করেছেন, সমর্থন জানালেও প্রকাশ্যেই! এমনকি একসময় যার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন, সেই অরবিন্দ ঘোষ যখন আধ্যাত্মিক পথ বেছে নিলেন, তখন দুঃখ পেয়েছিলেন, সমালোচনাও করেছিলেন, কিন্তু বরাবর তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘মহান’ বা ‘গ্রেট’ শব্দই আগে এনেছেন! এতখানি স্পষ্টবাদীতার জন্যেই কি তাবড় নেতাদের কাছে বিরাগভাজন হলেন? সেই কারণেই কি এত কম পরিচিতি তাঁর? তার উপর দেশে ফেরার পর থেকে তিনি সব পার্টির মুখোশ এমনভাবে খুলেছেন চাঁচাছোলা ভাষায়, যে সকলের কাছেই হয়ে গিয়েছিলেন চক্ষুশূল! এতে কিন্তু প্রকৃত অর্থে ক্ষতিটা আমাদেরই হয়েছে, আমাদের ব্যবহারিক বুদ্ধির অভাব থাকায় আমরা এমন খাঁটি ইস্পাতের তরবারিকে ঠিকমত ব্যবহার করতে না পেরে নিজেদের হাত রক্তাক্ত করেছি! তাঁর লেখা বইগুলি যেমন ‘যুগ সমস্যা’ (১৯২৬), ‘জাতি সংগঠন’ (১৯২৮), ‘বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব’ (১৯৪৫), ‘Dialectics of Hindu Ritualism’ (১৯৫০), ‘Dialectics of Land Economics of India’ (১৯৫২), ‘অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস’ (১৯৫৩), ‘ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি’ (১৯৫৩), ‘Swami Vivekananda Patriot-Prophet’ (১৯৫৪),‘Hindu Law of Inheritance’ (১৯৫৭) এসবই তাঁর দীর্ঘ গবেষণা ও কর্মজীবনের দলিল! তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি নিজের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বরাবর প্রথম পুরুষ ব্যবহার করতেন, “এখানে লেখক বোঝাতে চাইছেন…” এইভাবে! এটা বোধ হয় গবেষণাপত্রের ফর্ম্যালিটিকে বজায় রাখার জন্য, যেহেতু বরাবর গবেষণামূলক লেখাই তিনি লিখেছেন! প্রচুর পড়াশোনা করা, মানুষের কাজে নামা মানুষটিকে আমরা প্রকৃত সম্মান দিতে পারিনি! ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেনও আক্ষেপ করেছেন,
“দেশ ভূপেন্দ্রবাবুকে তাঁর মণীষা ও পাণ্ডিত্যের উপযুক্ত মর্যাদা দেয়নি।”
ভূপেন্দ্রনাথের বিপ্লবী চিন্তা ও বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডের পরিচয় কমিউনিস্ট নেতা ডাক্তার রণেন সেনের লেখায় উঠে এসেছে এ ভাবে, “ড. দত্ত ত্রিবেণীর মতো তিনটি বিপ্লবী ধারার সঙ্গমস্থল ছিলেন জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন, কংগ্রেস ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গমস্থল।”
আর মনীষী বিনয় সরকারের ভাষায়, “সকলেই জানে যে, ভূপেন দত্ত সেকালের রামকৃষ্ণপন্থিও নন আর একালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের পথও মাড়ান না।
লোকে জানে তাকে স্বদেশী যুগের অন্যতম যুগান্তর সাধক ও বিপ্লবী প্রবর্তক বলে। ভূপেন দত্ত একদিকে কট্টর মাৎসিনিপন্থি, অপরদিকে কট্টর মার্কসপন্থি। অধিকন্তু তিনি আবার নৃতত্ত্ব-শাস্ত্রী এবং সমাজ-সেবকও বটে।”
এশিয়াটিক সোসাইটির একটি ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মেমোরিয়াল লেকচার ছাড়া আর সেই অর্থে তাঁকে স্মরণ করতে ভুলেই গিয়েছি আমরা। তাঁর পরিচয় দিতে গেলেই অবধারিত ভাবে ওই ‘বিবেকানন্দের ভাই’ কথাটিই আগে মাথায় আসে! অবশ্য একথা বলাটা খুব ভুল কিন্তু নয়, আরেকটি অর্থেও, কারণ বিবেকানন্দের আদর্শই তো সারাজীবন মেনে গেলেন ভূপেন্দ্র, অন্যান্য বিপ্লবীদের মত তিনিও তো মনে করতেন, ভারতের প্রকৃত বিপ্লবী স্বামীজিই! স্বাধীনতার পরে ভারত সরকারের তরফ থেকে কোনোরকম ভাতা নিতে অস্বীকার করেন! একলা মানুষ, থাকতেন ১৩এ, গৌরমোহন স্ট্রিটের গলিতে। দু’বেলা পাইস হোটেলে খেতেন, হোটেলটির নাম ছিল ‘অমিয় হোটেল’। বাঁধা আসন ছিল ১০ নম্বর। মৃত্যুর পরও ওই আসনটি কাউকে দেওয়া হয়নি, তাঁর জন্যেই রেখে দেওয়া হয়েছিল! সেই মৃত্যুর দিনটা ছিল ২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৬১, কাকতালীয় ভাবে তার পরদিনই ছিল সি. পি. আই.-এর ৩৬তম প্রতিষ্ঠাদিবস!
(তথ্যসূত্র:
১- ইতিহাসবোধ ও রাষ্ট্রচিন্তা (পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ), রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অনুষ্টুপ (২০১৩)।
২- Bhupendranath Dutta (1885-1961): From National Revolutionary to Marxist. Academia, R. Bhattacharya.
৩- Swami Vivekananda Patriot-Prophet, Bhupendranath Datta, Nababharat Publishers (১৯৫৪)।
৪- Margot: Sister Nivedita of Swami Vivekananda, Reba Som, Penguin Random House India Private Limited (২০১৭)।
৫- উইকিপিডিয়া।
৬- https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/vivekananda-s-brother-bhupen-dutta
৭- http://www.nibirh.com/2018/09/bhupendranath-dutta.html?m=1)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত