একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী কোনও রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে মুখ খুললে রাতারাতি তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেত না বা গ্রেফতার করা হত। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এমন ঘটনা বিরল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এ ঘটনা এখন হামেশাই ঘটছে যোগী রাজ্য উত্তরপ্রদেশে। কারণ যোগীর আপন দেশে ‘আইন-কানুন’ সবই সর্বনেশে! দু’বছর আগে যে আইন-কানুনের গেঁড়োয় পড়তে হয়েছিল ডাক্তার কাফিল খানকে। আর এবার পড়লেন সাংবাদিক পবন জয়সওয়াল। যা নিয়ে নেটিজেনদের কটাক্ষের মুখে পড়তে হচ্ছে যোগী সরকারকে।
প্রসঙ্গত, গত ২২ অগস্ট উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের সিউর গ্রামের একটি সরকারি স্কুলের ভিডিও প্রকাশ্যে আসে। যাতে দেখা যায়, স্কুলের করিডরে পা মুড়ে বসে রুটি খাচ্ছে পড়ুয়ারা, সঙ্গে শুধু নুন। যেখানে উত্তরপ্রদেশের মিড-ডে মিল কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট বলছে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলে ভাত, ডাল, রুটি ও সব্জি এবং মাঝেমধ্যে দুধ আর ফল পাওয়ার কথা। স্কুলের এক পড়ুয়ার অভিভাবকও জানান, অধিকাংশ দিনই পড়ুয়াদের নুন-রুটি বা নুন-ভাত দেওয়া হয়। দুধ-কলা এলেও তা পড়ুয়াদের পাতে পৌঁছয় না।
এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেই, স্কুলে মিড-ডে মিলে নুন-রুটি খাওয়ানোর ওই ভিডিওটি যিনি প্রকাশ্যে এনেছিলেন যে সাংবাদিক, সেই পবন জয়সওয়ালের বিরুদ্ধেই অভিযোগ দায়ের করে যোগী সরকার। গ্রাম প্রধানের যে প্রতিনিধি সাংবাদিকের সঙ্গে সে দিন স্কুলে গিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করেছেন ব্লক শিক্ষা আধিকারিক। অভিযোগ, তাঁরা নাকি দু’জনেই উত্তরপ্রদেশ সরকারকে বেইজ্জত করার চেষ্টা করেছেন!
অভিযোগ দায়ের হওয়ার ঘটনায় বিস্মিত পবন বলেন, ‘যে কেউ ভিডিয়োর সত্যতা খতিয়ে দেখতে পারেন। ওই স্কুলে মিড-ডে মিলে দুর্নীতির কথা আগেই শুনেছিলাম। ২২ অগস্ট একজনের ফোন পেয়ে আমি স্কুলে যাই, যাওয়ার আগে সহকারী শিক্ষা আধিকারিক ব্রজেশ কুমার সিংকে ডেকে নিই। দুপুর ১২টায় ভিডিয়ো তোলার পর স্থানীয় সাংবাদিকদের জানাই। তাঁরা বিষয়টি জেলাশাসককে জানালে তিনি তদন্ত করে অভিযুক্তদের সাসপেন্ড করেন। অথচ, এখন আমার বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের হল। এটা সাংবাদিকতার উপর আঘাত।’
উল্লেখ্য, এর আগেও মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর’ পোস্টের অভিযোগে সাংবাদিক গ্রেফতারের মতো ঘটনা ঘটেছিল উত্তরপ্রদেশে। সেসময় নেশান লাইভ চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এক মহিলা নিজেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রেমিকা বলে দাবি করেন। সেই সাক্ষাত্কারের ভিডিও নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে গ্রেফতার হন দিল্লীর সাংবাদিক প্রশান্ত কানোজিয়া। গ্রেফতার করা হয়েছিল নেশান লাইভ চ্যানেলের প্রধান ইশিকা সিং, সম্পাদক অনশুল কৌশিক এবং অনুজ শুক্লকে। এভাবে ‘নির্দোষ’ হয়েও সাজা পেতে হয়েছিল ডাক্তার কাফিল খানকেও।
এক-দু’জন নয়। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে এনে বহু শিশুর প্রাণ বাঁচিয়ে সকলের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন হাসপাতালের এই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। রোগীদের পরিজন থেকে জাতীয় সংবাদমাধ্যম— তাঁর ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন সকলেই। কিন্তু অক্সিজেনের অভাবে একাধিক শিশুমৃত্যুর ঘটনায় ‘দোষীদের কঠোরতম সাজার’ আশ্বাস দেওয়ার অল্প পরেই কাফিলকে রাতারাতি বাবা রাঘবদাস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এনসেফ্যালাইটিস ওয়ার্ডের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় যোগী সরকার। শুধু তাই নয়। গ্রেফতারও করা হয় তাঁকে। যার ফলে ৭ মাস জেলে ছিলেন তিনি।
অবশেষে তাঁকে জামিন দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট। আদালত রায়ে জানায়, গোরক্ষপুর শিশুমৃত্যুতে ধৃত বিআরডি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক কাফিল খানের বিরুদ্ধে কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। সাংবাদিক পবন জয়সওয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরই ফের উঠে এসেছে কাফিলের কথা। যোগী সরকারকে বিঁধতে এই দুটি ঘটনার উল্লেখ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা পোস্টও করছেন নেটিজেনরা। একটি পোস্টে যেমন দুদিকে কাফিল এবং পবনের ছবি-সহ তাঁদের ‘অপরাধের’ কথা লিখে নীচে দেওয়া হয়েছে যোগীর ছবি। এবং তারই সঙ্গে লেখা ‘ওয়েলকাম টু উত্তরপ্রদেশ’। ভাবখানা এমন যে, আপনিও যোগীর আপন দেশে আসুন। যেখানে আইন-কানুন সবই সর্বনেশে।