কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের পরই বসে গিয়েছিল গাড়ি ব্যবসার চাকা। গাড়ি বিক্রিতে ধস নামার ফলে বিপাকে যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিও। গাড়ির বিক্রি তলানিতে পৌঁছনোয় ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন ৩ লক্ষ কর্মী। কাজ কমেছে হরিয়ানার গুরুগ্রাম ওরফে গুড়গাঁওয়ে মারুতি, হন্ডার মতো গাড়ি-মোটরবাইকের কারখানায়। গুরুগ্রাম, মানেসর, বিনোলায় শত শত গাড়ি যন্ত্রাংশ কারখানার গাড়ি সংস্থার বরাত পায়। সেখানেও কাজ কমেছে। আর যাঁরা এখনও ছাঁটাই হননি, তাঁরা কাজ করলেও, মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা রোজগার কমে গিয়েছে তাঁদের। কারণ কাজের চাপ কম। ওভারটাইম মিলছে না।
রোজ সকালে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে কারখানার পথে রওনা হন অলোক কুমার। কারখানার সামনে এসে বসে পড়েন শামিয়ানার নীচে। আর ওভাবেই সন্ধ্যা পর্যন্ত বুকে কালো ব্যাজ বেঁধে ধর্না দেন। খাটিয়ায় শুয়ে থাকেন ‘ভুখ হরতাল’ করা রাম নিরঞ্জন। আর অলোকেরা বসে হাইওয়ের ধারে, মাটিতে শতরঞ্চি পেতে। আসলে বেতন বাড়ানোর কথা বলতে গিয়ে অলোকদের মতো অনেকে সাসপেন্ড। কাজ খুইয়ে অনেকেই নিজের গ্রামে ফিরে গেলেও বছর ১২ আগে উত্তরপ্রদেশের ফারুকাবাদ থেকে হরিয়ানায় আসা অলোক ফিরতে পারেননি। তিনি জানান, ‘দুই ছেলে, এক মেয়ে তো এখানেই স্কুলে পড়ে। তবে আর কত দিন স্কুল যেতে পারবে, জানি না। তিন জনের মোট ৩২ হাজার টাকা ফি বাকি পড়েছে। স্কুল থেকে জানিয়েছে, দু’মাসের মধ্যে ফি জমা দিতে হবে।’
অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশের কনৌজে সুধীর যাদব, যিনি কাজ চলে যাওয়ায় মাসখানেক আগেই গুরুগ্রাম থেকে রাজপুর গ্রামে ফিরেছেন, তিনি বলেন, ‘অন্য সময় ছুটিতে গ্রামে এলে সঙ্গে টাকাপয়সা থাকে। সংসারে খরচা করি। এখন তো হাতে পয়সা নেই। তাই একশো দিনের কাজ জোগাড়ের চেষ্টা করছি।’ আবার হরিয়ানার সিটু নেতা সতবীর সিংহ বলেন, ‘বুঝতে পারছেন তো, গ্রামের বাজারে কেন বিক্রিবাটা নেই! গ্রাম থেকে শহরে আসা শ্রমিকেরা রোজগার হারিয়ে গ্রামে ফিরছেন। যেমনটা নোটবন্দীর পরে হয়েছিল।’ আসলে গুরুগ্রাম-মানেসরের বাকি সব গাড়ির যন্ত্রাংশ কারখানায় কোথাও কোনও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ নেই। কেবল বিনোলায় অলোকদের কারখানা ব্যতিক্রম।
এ প্রসঙ্গে সতবীর বলেন, ‘কারা প্রতিবাদ করবে? কাজ হারানো অস্থায়ী শ্রমিকেরা তো গ্রামে ফিরেছে। ম্যানেজমেন্ট বলেছে, গাড়ি বিক্রি, কাজের বরাত বাড়লেই ফের ডেকে পাঠানো হবে। সবাই সেই ভরসায় রয়েছে। কিন্তু কবে?’ আবার হরিয়ানার মারুতি উদ্যোগ কামগার ইউনিয়নের সভাপতি রাগেশ কুমার জানান, ‘খুব কঠিন সময় চলছে। তিনটি কারখানায় প্রায় ১২ হাজার অস্থায়ী কর্মী ছিলেন। তার মধ্যে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারের কাজ গিয়েছে। গাড়ি বিক্রি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। ম্যানেজমেন্ট বলেছে, উৎসবের মরসুমে গাড়ি বিক্রি বাড়তে পারে। মার্কেটিং, সেলস বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। খরচ কমানোর চেষ্টা হচ্ছে।’ সতবীর, রাগেশরা ম্যানেজমেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকলেও শিল্পপতিরা কিন্তু আঙুল তুলছেন মোদী সরকারের দিকেই।
গুরুগ্রামের সুরি অটো প্রাইভেট লিমিটেড গাড়ি-বাইকের কারখানায় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর অতুল সুরি বলেন, ‘গত বছর দীপাবলির পর থেকেই বিক্রি পড়তির দিকে। সরকারই মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে ইলেকট্রিক গাড়ি, বাইক চালুর কথা বলে। লোকের ভয় হয়েছে, পেট্রল-ডিজেলের গাড়ি-বাইক আর চলবে না। অনেকে আবার জিএসটি কমার অপেক্ষা করছেন। দুইয়ে মিলিয়ে শতকরা ৪০ ভাগ বিক্রি কমেছে। তার খেসারত আমাদেরও দিতে হচ্ছে।’ উল্লেখ্য, যত দিন যাচ্ছে, ততই নাভিশ্বাস উঠছে গাড়ি শিল্পের। গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির সংগঠন সিয়ামের প্রকাশ করা জুলাইয়ের বিক্রির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জুলাইতে গত ১৯ বছরের সব থেকে কম বিক্রি দেখেছে ভারতের গাড়ি শিল্প ক্ষেত্র।