বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে মোদী সরকারের বাজেটে যেমন তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ঠিক তেমনই চাহিদার মানোন্নয়নেও কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি কেন্দ্র। আর এই দুই কারণেই একদিকে যেমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে ভারতের শিল্প সংস্থাগুলোকে, তেমনি এই অবস্থায় কার্যত তলানিতে পৌঁছেছে পরিকাঠামো বৃদ্ধিও। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঞ্চিত তহবিল প্রায় উজাড় করে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে নিয়ে যেতে উঠেপড়ে লেগেছে মোদী সরকার। এই অভিযোগে সরব বিরোধীরা। শুধু তাই নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সঞ্চয় ভাণ্ডার দুর্বল করে মন্দার সময়ে আরো বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে বলে মত অর্থনীতি মহলেরও।
প্রসঙ্গত, অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিনই আসছে কোনও না কোনও দুঃসংবাদ। গাড়ি শিল্প থেকে শুরু করে বিস্কুট পর্যন্ত সর্বত্র বাজারে চাহিদা বাড়ন্ত। বিক্রি না হওয়ায় বন্ধ করতে হচ্ছে উৎপাদন। যার জেরে চলছে ছাঁটাই কাজ। গাড়ি শিল্পে ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ শ্রমিক। ছাঁটাই হতে পারেন আরও ১০ লক্ষ। বস্ত্র শিল্পের অবস্থাও তথৈবচ। এভাবে একটার পর একটা শিল্প যখন মন্দার কবলে, তখন কৃষিতেও গত ৩ বছর ধরে টানা সঙ্কট। কৃষকের আয় তলানিতে। চাষ করেও লাভের অঙ্ক মেলে না। আবার কর্মসংস্থানের অভাবে দেশে বেকারত্বের হারও গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই অবস্থায় সরকারের বাঁচার রাস্তা বলতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বিক্রি করে টাকা জোগাড় করা। কিন্তু তাতেও সব ঘাটতি পূরণ হবার নয়। তাই অগতির গতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মজুত তহবিলে হাত দেওয়া।
যদিও, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে উদ্বৃত্ত সরকারকে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এই পরিমাণ অর্থ কোনোদিনই দেওয়া হয়নি। ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে উদ্বৃত্ত দেওয়া হয়েছিল ৩৩০১০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ সালে ৫২৬৭৯ কোটি, ২০১৫-১৬-তে ৬৫৮৯৬ কোটি, ২০১৬-১৭-তে ৬৫৮৭৬কোটি,২০১৭-১৮-তে ৩০৬৫৯ কোটি, ২০১৮-১৯-এ ৫০০০০ কোটি টাকা আরবিআই দিয়েছিল সরকারকে। এবার ২০১৯-এ তা হলো ১৭৬০৫১ কোটি টাকা। সরকারি সূত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়নি এই বিরাট পরিমাণ টাকা কোন কাজে ব্যবহার করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মূলধন জোগান, কয়েকটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ-বরাদ্দের জন্য সরকার এই অর্থ ব্যবহার করবে। এই টাকা ঘুরে ফের বেসরকারি ক্ষেত্রেই চলে যাবে।
উল্লেখ্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত তহবিল সরকারি কোষাগারে তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরেই। তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর উর্জিত প্যাটেল, ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য সহ অনেকে এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দেশের আর্থিক টানাপোড়েনের নানা ধকল সামলাতে হয়। এ কারণে অতিরিক্ত অর্থ তাদের মজুত থাকা উচিত। তবে শেষ পর্যন্ত কার্যত মোদী সরকারের চাপে বাধ্য হয়েই ইস্তফা দিতে বাধ্য হন প্যাটেল ও আচার্য। এবং অনুগত আমলা শক্তিপদ দাস রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নয়া গভর্নর হন। তিনি ক্ষমতায় এসেই এই উদ্বৃত্ত মজুত তহবিল সরকারি কোষাগারে পাঠানোর প্রক্রিয়া তৈরিতে বিমল জালানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিই সঞ্চিত উদ্বৃত্ত তহবিলের সব অর্থ ধাপে ধাপে সরকারি কোষাগারে পাঠানোর সুপারিশ করে।
সুপারিশ মতো সোমবার বিপুল পরিমাণ টাকা সরকারি কোষাগারে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু যেভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সঞ্চয় সরিয়ে নেওয়া হলো তার অন্য তাৎপর্যও দেখছেন অনেকে। সংশয় প্রকাশ করেছেন সামনের সারির অর্থনীতিবিদরাও। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন যেমন বলছেন, এই বাড়তি ভাঁড়ার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে গেলে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্রেডিট রেটিং বা মূল্যায়ন কমতে পারে। আর রেটিং ‘এএএ’ থেকে কমলে, ধার নেওয়ার খরচ বাড়বে। যা পুরো অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। একই কথা বলছে, অল ইন্ডিয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনও।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সমীর ঘোষ বলেন, আমাদের আশঙ্কা, এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেটিং কমে যাবে। তিনি জানান, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিজস্ব থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ফাইনান্সিয়াল রিসার্চ অ্যান্ড লার্নিং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪৭টি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে নিয়ে যে সমীক্ষা করেছে, তাতেও উঠে এসেছে যে, অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তুলনায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কেন্দ্রস্থিত মূলধন পর্যাপ্ত নয়। অথচ তার ওপরও আঘাত হানা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তাই পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই অভিমত, অর্থনীতির ওঠাপড়ায় ভারসাম্য রক্ষার যে কাজ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক করে থাকে, এবার তার সুযোগ হ্রাস পাবে। এমনকী রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে ‘গৌরী সেন’ ভেবে যেভাবে তার ভাঁড়ার ফাঁকা করছে সরকার, তাতে শেষমেশ ‘নিধিরাম সর্দারে’ পরিণত হবে তা।