কাল মধ্যরাত থেকেই নিজের দেশ, নিজের পাড়ায় বিদেশী হয়ে যাবে অসমের বহু মানুষ। মূলত বাঙালি। আমরা যারা এই এনআরসির আঁচ পাইনি তারা ভাবছি বটেই তো। বাঙাল, বাংলাদেশী আমাদের চাকরি খাবে কেন বাবা।
বাঙালির ভাগ্যে এটা লেখা ছিলোই। আজ না হয় কাল গলা ধাক্কা খেতোই বাঙালি। আমরা কিউবা, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া, টলস্টয়, নেরুদা নিয়ে ভারতে যতটা চর্চা করেছি, তার শিকে ভাগ ও যদি খরচা করতাম ৭১ পরবর্তী বাঙালির ইতিহাস বোঝাতে হিন্দুস্তানকে, আজ লড়াইটা অনেক সহজ হতো৷
আমরা খুব ভালো ভাবে জানি ৭১ এর পরে ও আমার আত্মীয় এসেছে এপাড়ে। আমি জানি যুদ্ধতে পর্যবসিত কোন বিপ্লবীর প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে আসার গল্প। আমি জানি কেমন লাগে ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসার স্বাদ। কিন্তু আমরা এই গল্প বললাম কই জাতীয় দর্শককে। সাবটাইটেলে ঋত্বিক ঘটক আর মননে মোহনবাগান। আমরা ভাবলাম গোবলয় হেব্বি বুঝেছে।
পূর্ব ভারত থেকে একবার বাইরে বেরোলে, বাঙাল আর ঘটির পার্থক্য বোঝে না হিন্দুস্তান। দেশভাগের সাথে সাথে আরো অনেক স্বপ্নভাগ, হৃদয়ভাগের গল্প বোঝেনা হিন্দুস্তান৷ গরম ভাতের গন্ধের জন্য অনেকটা পালিয়ে আসা বোঝেনা হিন্দুস্তান৷ ওদের ভারত এক খোঁজের গল্প শোনাতে হয়। যেটা ওদের নাপসন্দ। আর আমাদের লড়াই হিন্দি শিখে ভারতে সাফল্যলাভে।
পশ্চিম বঙ্গীয় বাঙালি বা উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত প্রবাসী বাঙালি যারা তাদের এক অদ্ভুত উন্নাসিকতা দেখেছি নিম্নবিত্ত, অল্পশিক্ষিত, লুঙ্গি পরা, ইসলাম ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের নিয়ে। এরা হাওড়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুরের আদী বাসিন্দা হলেও এদের দেগে দেওয়া হয় অবৈধ বাংলাদেশী বলে। কারণ এদের শুক্কুরবারের ফেজটুপি আর জলকে পানি বলার বাতিক। আমরা অবশ্য গোবলয়ে হিন্দি বাতচিতে পানি খাতা হু তেই আছি এখনো৷
আমরা যারা দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোরের হোমসিক বাঙালি তারা অদ্ভুত এক দূরত্ব বজায় রাখি ওখানে চায়ের দোকানের, সব্জি বাজারের, দিনমজুরির মাথার ঘাম পায়ে ফেলা সাকিবুল, ওয়াশিকুর, রেহানাদের থেকে৷ পাছে আমাদের ও দেগে দেয় বাংলাদেশী বলে৷ পাছে আমাদের ও খেদিয়ে দেয় হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান।
তাই আমরা ও আর বোঝাতে যাইনা ৪৭ এ আসা, ৭১ এ আসা বা ৭৫ এ আসার মানে। ওদের কাছে ৪৭ এর পরে সব্বাই দুশমন৷ জোর সে বলো ভারত মাতা কি জয়য়য়য়য়!
রবি ঠাকুর হতভাগ্য।যে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ভারত জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি দিলো, সেদেশেই বাঙালি গণশত্রু এখন। বাংলায় কথা বলা মানে বাংলাদেশী ও হতে পারে। অসমের বাঙালিদের সমর্থন মানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সমর্থন নাকি৷ বাঙালিকে এটাও দেখতে হলো।
আবার মনে করিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। ভারতকে যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল দিয়েছে সেই রবীন্দ্রনাথ বাঙালি। যে সিনেমায় অস্কার দিয়েছে সেই সত্যজিৎ বাঙালি। যে ভারতের জাতীয় সংগীত লিখেছে সেই রবীন্দ্রনাথ বাঙালি। যে রাষ্ট্রগান লিখেছে সেই বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি। যে গান্ধীবাদের বাইরে এসে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়েছে সেই সুভাষ বাঙালি। যে গোটা পৃথিবীতে হিন্দুধর্মের প্রচার ও অপার সৌন্দর্যের ভাষ্যকার হলেন সেই স্বামী বিবেকানন্দ বাঙালি।যে বিপ্লব ছেড়ে আধ্যাত্মিকতার সমুদ্রে বিলুপ্ত সেই ঋষি অরবিন্দ ও বাঙালি৷ তা ভায়া জাতীয়তাবাদী যেকোন কিছুই তো বাঙালির উচ্ছিষ্ট। তাতেই কি রাগ নাথুরাম গোডসের বংশজদের?
ভূ-ভারতের বাঙালিদের মনে করিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে বাঙালি অস্মিতা নিয়ে কেয়ার করুন। নয়তো ইতিহাস থোড়াই কেয়ার করবে আপনাকে।
বর্তমানে বলিউডে সবচেয়ে সফল যে কলাকূশলী ও শিল্পী তারা বাঙালি। গায়ক যারা তারা বাঙালি। সুরকার বাঙালি। দিল্লিতে বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশী পরিমান সাংবাদিক বাঙালি। ব্যাঙ্গালোর আর পুনেতে সবচেয়ে বেশী কর্মরত আইটি বিশেষজ্ঞ বাঙালি। এমনকি মুটে মজদুর, দিনমজুর ও প্রবাসে বাঙালি৷ ঈর্ষা অনুভব হবে না কেন হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের?
আমাদের আছে রামপ্রসাদী গান, চৈতন্যদেবের নাচ, রশিদ খানের মুখরা। চাইলে জ্যোতি বসুর ব্রিগেড ও।
এসব নিয়েই ৭৩ বছর ধরে একসাথে আছি। বাঙাল ঘটি, মুসলিম হিন্দু, এপাড় ওপাড় নিয়ে অনেকদিন ধরে আমার শান্তিতে আছি৷ কারোর কোন অসুবিধা না করে।
অনুপ্রবেশকারীদের খেদিয়ে দেশে পাঠাও কিন্তু তা করতে গিয়ে গরীব বাঙালিদের খেদাতে এলে, তারে ঋত্বিকের ভাষায় শুয়ারের বাচ্চা ছাড়া কি আখ্যা দিমু?
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত