দিদিকে বলতেই হল না। তাঁকে বলার আগে খোদ দিদিই এসে হাজির দুয়ারে। তিনি নিজে থেকেই শুনে নিলেন সকলের অভাব-অভিযোগের কথা। না দিবাস্বপ্ন নয়। প্রকৃতপক্ষে এমনটাই ঘটল সোমবার। এর আগে হাওড়ার বস্তিতে এবং দীঘার কাছে একটি তফসিলি গ্রামে গিয়ে নজির গড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর গতকাল ফের ‘দিদিকে বলো’র ফলিত রূপই দেখল রাজ্যবাসী।
টানা তিন ঘণ্টার প্রশাসনিক বৈঠকের পর সোমবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ লোকসংস্কৃতি ভবন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়। গন্তব্য তখনও অজানা প্রশাসনিক কর্তাদের। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী দুই সহকর্মী ফিরহাদ হাকিম এবং স্বপন দেবনাথ। প্রথমেই মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় থামে ইছলাবাদ বিবেকানন্দ বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
প্রধান শিক্ষিকা ভাস্বতী লাহিড়ী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী এসেই জানতে চাইলেন আমাদের কোনও সমস্যা বা অসুবিধা আছে কি না। আমাদের স্কুলের সামনে মাঠটির কথা বললাম। এই মাঠটি নিয়ে সমস্যা রয়েছে। মাঠে গাছ লাগালেও বাঁচাতে পারছি না। আসলে মাঠের পুরোপুরি অধিকার বিদ্যালয়ের নেই। তাই উনি আশ্বাস দিয়ে গেলেন যে বিদ্যালয়কে এই মাঠটি দিয়ে দেওয়া হবে। পরবর্তী পদ্ধতি সরকারিভাবে নেওয়া হবে।’
ভাস্বতী দেবী জানান, মাঠটির অর্ধেক মালিকানা স্কুলের এবং বাকি অর্ধেকটি বর্ধমান পুরসভার। এর আগে বর্ধমান পুরসভা ও জেলাশাসকের কাছেও এই মাঠটি নিয়ে আমরা আবেদন করেছিলাম। বলেছিলাম, মাঠটি যদি আমাদের দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে স্কুলটিকে আরও ভাল করে চালাতে পারব। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের মৌখিকভাবে আশ্বাস দিয়েছেন। আসলে ছাত্রছাত্রীদের খেলার জায়গার খুব অভাব। তারা খেলতে পারে না। তাই ছাত্রছাত্রীরাও মুখ্যমন্ত্রী কাছে এই মাঠটির জন্য আবদার করেছে।
শুধু তাই নয়। পরে ছাত্রছাত্রীদের গানও করতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর তাঁকে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা গানটি শোনায় ছাত্রীরা। এতে ভীষণ খুশি হন মমতা। এবং এই স্কুলের উন্নতির জন্য ১০ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কন্যাশ্রী, সবুজসাথীর সুবিধা কতটা মিলছে, পড়াশোনা চলছে কেমন, সবকিছু খুঁটিয়ে জানার পির ছাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেই ফের চলা শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী।
এরপর বর্ধমান শহর ছেড়ে তাঁর কনভয় পৌঁছয় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে। শহরের উপকণ্ঠে উল্লাস মোড় যাওয়ার পথে বাঁহাতে একটা সঙ্কীর্ণ পথ, ঢাল বেয়ে নেমেছে। কনভয় থামালেন মুখ্যমন্ত্রী। রাস্তাটি সোজা গিয়েছে বর্ধমান-২ নম্বর ব্লকের বৈকুন্ঠপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের আলিসা গ্রামে, যা আদিবাসী অধ্যুষিত। দিদি এসেছেন গ্রামে, মুহূর্তে কথাটি চাউর হয়ে যেতেই উপচে পড়ে ভিড়। মাটির বাড়ির দাওয়ায় হাতের নাগালে তখন মুখ্যমন্ত্রী। তাই মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় সেই মুহূর্তটুকু বন্দী করতে উৎসাহীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
থিকথিকে ভিড়ের সামনের সারিতে কল্পনা কোটাল, সুচিত্রা বাউরি, নিয়তি কর্মকার, সরস্বতী সেন, পাতুর পালের মতো মহিলারা। ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দেওয়া হল মমতার দিকে। পরম তৃপ্তিতে চুমুক দিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, দু’টাকা কেজি চাল, স্বাস্থ্যের সুবিধা সবাই ঠিকঠাক পাচ্ছেন তো? সমস্বরে জবাব, হ্যাঁ পাচ্ছি। তবে আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। বলুন, কার কী সমস্যা? এবার কে আগে জানাবেন সমস্যার কথা, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি। এক এক করে বলুন, আমি সবটা শুনব—অভয় দেন মমতা।
এক আদিবাসী বৃদ্ধা জানান গ্রাসাচ্ছাদনের সমস্যা, একজন জানালেন মাথার ছাদের সঙ্কটের কথা, কেউ জানালেন পানীয় জলের অপ্রতুলতা, আবার কারও মুখে গ্রামের রাস্তা আরও চওড়া করার আর্জি। পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক বিজয় ভারতীকে কাছে ডেকে নিয়ে সবটা নোট করতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। আদিবাসী মহিলাদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য মন্ত্রীসভার সহকর্মী স্বপন দেবনাথকে নির্দেশ দেন ছাগল, হাঁস-মুরগি বিতরণ করতে। এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে এই কাজে যুক্ত করার নিদানও দেন তিনি।
বাংলা আবাস যোজনায় কারা কারা মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার উপযুক্ত, তা নির্ধারণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন জেলাশাসককে। বাংলা আবাস যোজনায় এই জেলা এবার পাচ্ছে ৫৬ হাজার বাড়ি তৈরির এক্তিয়ার। সেই তালিকায় আলিসা গ্রামের বাসিন্দাদের অন্তর্ভুক্ত করতে গতকাল থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এদিন, মঙ্গলবার বিকেলে মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ আলিসা গ্রামে গিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন।
গ্রাম থেকে বের হওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। অভাব-অভিযোগ শুনলাম। যতটা পারা যাবে করা হবে। প্রাণীপালন, পানীয় জল সরবরাহ, বাড়ি তৈরি আর রাস্তা সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এভাবে চা খেতে খেতেই সকলের সঙ্গে আড্ডার ছলে মুখ্যমন্ত্রী জেনে নেন তাঁদের অভাব-অভিযোগ। ঘরের দাওয়ায় মমতাকে নিজেদের পরিবারের একজন ভেবেই মনের কথা জানান মহিলারা। তৎক্ষণাৎ সমস্যা সমাধানের নির্দেশও দেন মুখ্যমন্ত্রী।