তখন তিনি ঢাকায় ছাত্র।
পড়েন জগন্নাথ কলেজে।
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস খুব স্নেহ করতেন ক্ষুরধার বুদ্ধিমান কিশোরকে। তাঁর জন্মদিনে বাঘা বাঘা বৈজ্ঞানিক বন্ধুরা যখন বাড়িতে আসতেন, ডাক পড়ত ছেলেটির। সে একের পর এক কৌতুক নকশা বলে অমন সব জ্ঞানী-গুণী অধ্যাপককে বসিয়ে রাখতে পারতেন অন্তত ঘণ্টাখানেক! আমৃত্যু অধ্যাপক বোসের এই স্নেহ অটুট ছিল। ছাত্র যখন নামকরা চিত্রতারকা, তখনও নাকি মাঝেমধ্যেই মাস্টারমশাইয়ের স্নেহের ডাক পেতেন,
“ওরে ভানু, মাথা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আমার, আয় একটু রস ঢেলে দিয়ে যা!”
সারা জীবনে অন্য কোনও বিষয়ে অহঙ্কার ছিল না, কিন্তু কবি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিন, ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারদের মতো দিকপাল মাস্টারমশাইদের এই স্নেহ-ভালোবাসা নিয়ে খুব গর্ব করতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজকাল প্রায়শই শোরগোল ওঠে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদের শালীনতার সীমা কতটা, তা নিয়ে। বাংলায় নিজে একাই স্ট্যান্ড আপ কমেডিকে তুঙ্গ জনপ্রিয়তা দিয়েছিলেন, সেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বসে একের পর এক স্কিট লিখতেন। তাঁর সঙ্গে কখনও কখনও সে সব কৌতুকাভিনয়ে গলা মিলিয়েছেন কন্যা বাসবী ঘটকও। লেখার পর প্রথমেই বাড়ির সবাইকে শোনাতেন তাঁর নকশা। একদা তাঁর কন্যা হাসতে হাসতে জানিয়েছিলেন,
‘‘আমাদের পরিবারে চালু একটা ধারণা ছিল, যে সব কৌতুক নকশা শুনে আমরা খুব একটা খুশি হতাম না, সেগুলোই নাকি দারুণ হিট হত!’’
যে সব জলসা বা বিচিত্রানুষ্ঠানের আসর বসত পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে, সেখানে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত ভানুকে নিয়ে। জনপ্রিয়তায় তিনি সমানে সমানে টেক্কা দিতেন উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। তাঁকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়ে আসত সাধারণ মানুষ।
তাঁর কন্যা বাসবী বাবার কাছ থেকে তাঁর ছেলেবেলার অনেক গল্প শুনেছেন। কনভেন্ট স্কুলে আজীবন লেখাপড়া করে এলেও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ভানু স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অবলীলায় মেলামেশা করতেন ঢাকার গাড়োয়ানদের সঙ্গে। তাঁদের বিচিত্র রসবোধ তাঁর বিবিধ নকশার খোরাক জোগাত। তবে তখনও অভিনয়কেই পেশা করবেন বলে ভাবেননি, সেটা এসেছে অনেক পরে। পাড়ায় প্রথম অভিনয় করেন ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে। কলকাতায় চলে আসেন ১৯৪১ সালে, চাকরিতে ঢোকেন। তখন কৌতুক নকশার টুকটাক শো-ও করতেন। ১৯৪৬ সালে প্রথম অভিনয় করেন ‘জাগরণ’ ছবিতে, অপেশাদার নাট্যমঞ্চে প্রথম কাজ ১৯৪৮ সালে ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে, পেশাগতভাবে প্রথম মঞ্চাভিনয় ১৯৫০ সালে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকে। তার পরেও বহুদিন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’তে চাকরির পাশাপাশি অভিনয় করেছেন ১৫ বছর। একটা সময় অভিনয়ে আরও বেশি সময় দেওয়ার জন্য চাকরিও ছাড়েন।
বাঙালি নাকি ‘স্ত্রী লিঙ্গ’! তা হলে শব্দটির লিঙ্গান্তর করলে কী হবে? কেন ‘বাঙাল’! ‘জনপ্রিয়’ এই ব্যাখ্যাটি বঙ্গ জীবনে হাস্যরসের মোড়কে যিনি পেশ করেছিলেন তাঁর নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু কী বাঙালি-বাঙাল! ‘মাসীমা মালপো খামু’, ‘টিনের বাক্সে বারো টাকা’, ‘নাগো মিনু আমাগো থার্মোমিটারও নাই, বার্নলও নাই’, ‘দ্রিমু য্রখন ত্রখন স্রব ত্রাইতেই দ্রিমু’… এমন হাজারো সংলাপ বাঙালির মুখে মুখে ফিরত তখন! ফিরত কেন, এখনও তো নানা হাস্য-আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে এই সব সংলাপ। ভাবছেন, এ সবের স্রষ্টা হিসেবে খ্যাত মানুষটির নাম তো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! ঠিকই, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পোশাকি নাম ছিল সাম্যময়। তাঁর পরিবার কমিউনিজমে বিশ্বাসী ছিল। তাই, মাতামহ যোগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া ‘সাম্যময়’ নাম নিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রসিকতা’ ছিল,
… “that I am communist, I bear it in my name.”
তিনি হয়ে যেতে পারতেন কট্টর স্বদেশী। হতে পারতেন পার্টির হোলটাইমার, হয়ে গেলেন ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়!
আট-দশ বছর বয়েস থেকে ‘গুরু’ বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। তাঁরই সাইকেলে চেপে ঘুরতেন। বুকের আড়ালে নিষিদ্ধ বই, টিফিন বক্সে রিভলভার। চলত পাচার করা।
দীনেশ গুপ্ত মারা যাওয়ার পর জড়িয়ে পড়েন ঢাকায় ‘অনুশীলন সমিতি’র কাজে।
’৪১ সালে, যখন বিএ পড়ছেন, কোনও এক ব্রিটিশ ইনফর্মার খুন হল অনুশীলন সমিতির হাতে। সে দলের পাণ্ডা ছিলেন উনি। ফলে হুলিয়া জারি। পালিয়ে আসতে হল পুব বাংলা ছেড়ে।
তা’ও আবার কীসে? না, বন্ধু গোপাল মিঞার গাড়িতে, সিটের নীচে পাটাতনে লুকিয়ে।
তত দিনে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপক বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর প্রিয়পাত্র। রমেশ মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিনের প্রিয় ছাত্র। ক্লাসের বাইরে সত্যেন বসুর আবদারে তাঁকে প্রায়ই ঢাকাই কুট্টিদের নিয়ে কমিক শোনাতে বসেন।
বলতেন, ‘‘ছিলাম ‘বাঁড়ুজ্জে’, হয়ে গেলাম ‘ভাঁড়ুজ্জে’!’’
বিক্রমপুরের বিখ্যাত মাস্টার জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতিদেবী। সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাকুরে। তাঁরও নামজাদা বংশ। সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া।
তাঁদেরই ছেলে সাম্যময়। ডাকনাম ভানু। তার মঞ্চে নামাটা কিন্তু এক্কেবারেই আকস্মিক। পাড়ার নাটক দেখছিল ছোট্ট ভানু। স্টেজের নীচে দাঁড়িয়ে। ওপর থেকে কোনও এক খুদে অভিনেতা দুষ্টুমি করে লাথি কষায় মাথায়।
‘‘হালায় ওই লাথখা’ন কুনওদিন ভুলি নাই, ওই দিনই ঠিক কইরা ছিলাম, অগো দ্যাখাইয়া ছাড়ুম।’’
ওয়াড়ি ক্লাবের ‘বনবীর’ নাটকে সুযোগ এসে গেল। তখন সবে ক্লাস সিক্স। উদয়সিংহ হলেন ভানু। তাঁর অভিনয়ে চমকে গেল সবাই। কলকাতায় এসেও পাড়ার নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’য় চাণক্য হলেন। সে অভিনয় এতই সাড়া ফেলল যে পল্লিরই এক ডাক্তার তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখনকার নামকরা পরিচালক সুশীল মজুমদারের দরবারে।
৪২ নম্বর চারুচন্দ্র অ্যাভিনিউ। দো’তলা বাড়ি। ওপর তলার সাদা রংটা মাঝে মাঝে ধূসর। নীচের অ্যালা রঙের পোঁচের ওপরে কালো ছোপ ছোপ। দেওয়াল জুড়ে মাটি রঙের বর্ডার।
জানলা, দরজা সেই সাবেক কালের মতো। সবুজ। রেলিং ঘেরা বারান্দার পাশে ক’ধাপ সিঁড়ি চড়লেই দরজা। যার মাথায় পাথরের ওপর খোদাই করা ‘সঙ্গীতশ্রী’।
দরজা ঠেলে ঢুকলেই কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝের ছোট্ট করিডর। এগোলেই ডান ধারে বসার ঘর। বাঁ দিকে এক ফালি উঠোনের উল্টো পারে উপরে ওঠার চওড়া সিঁড়ি। কাঠের রেলিং।
দো’তলায় উঠে ডান দিকে এক চিলতে বসার ঘরের লাগোয়া বিশাল শোওয়ার ঘরটি আজও আছে। এখানেই বিশ্রাম নিতেন তিনি।
সব আগের মতোই আছে। তবে বাসিন্দা বলতে কয়েক বছর আগেও ছিলেন সাকুল্যে দুই জন। এখন মাত্র একজন। এই দুইজনের একজন ছিলেন তাঁর স্ত্রী নীলিমা। এক কালের নামী গায়িকা। যিনি সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। দ্বিতীয় জন তাঁর বড় ছেলে গৌতম। প্রযোজক। অকৃতদার। তাঁর ছোট পুত্র পিনাকী বর্তমানে বিদেশে। এনভারয়নমেন্টালে গবেষণা করে শিকাগোর চাকুরে। তাঁর কন্যা বাসবী কলকাতার এক নামী স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা। বিয়ে হওয়ার পর থেকে থাকেন নিউ আলিপুরে।
শেষ বারের মতো এ বাড়ির কর্তা তাঁর ভিটে ছেড়ে চলে গেছেন ’৮৩-র ৪ মার্চ। তার আগে? এ কুঠি যখন তখন গমগম করত।
বিকাশ রায় এলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও তাঁর পাশে বসতেন না। বসতেন পায়ের নীচে, মাটিতে। অতিথি অস্বস্তি পেলেও শোনে কে! ছবি বিশ্বাস দেখা দিতেন এবেলা-ওবেলা। তাঁর ‘ভেনো’-কে যেন তিনি চোখে হারাতেন। জহর রায়, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে অনুপকুমার— বাদ যেতেন না কেউই।
শুধু সিনেমারই নয়, খেলার জগতের লোকজনও আসতেন। খেলা বলতে ফুটবল। ভানু ছিলেন ইস্টবেঙ্গল অন্তপ্রাণ। ক্লাইভ রো-তে যখন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল’-এ চাকরি করতেন তিনি। আর ইস্টবেঙ্গলের খেলা মানেই অফিস ‘কাট’! মেম্বরশিপ গেটে দাঁড়িয়ে গেটও ম্যানেজ করেছেন তিনি। মাঝে মাঝে শচীনদেব বর্মন আর হিমাংশু দত্ত আসতেন মাঠে। শচীনকর্তা ছিলেন তাঁর প্রাণ! হাফটাইমে ভানু নিয়ম করে তাঁর হাতে তুলে দিতেন একটা সিগারেট, এক খিলি পান আর এক প্যাকেট চিনে বাদাম।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভানুর ঘরের মেয়ে। বাড়িরই কুটুম। সেই কুটুমকে অবশ্য কলকাতায় এসে নতুন করে আবিষ্কার করেন উনি।
সাবিত্রী তখন ফ্রক পরা মেয়ে। স্কুল ছুটির পর খালি পায়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলেছে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে বলতে।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে সময় নাটকের দলের অভিনেত্রী চাই। রাস্তায় মেয়েটিকে মনে ধরল। কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘অভিনয় করবে?’’ মেয়েটি কটমট করে তাকাল। তারপর বলল, ‘‘আমায় বলছেন কেন, বাবাকে বলুন।’’ এর পরই ট্রামে উঠে ধাঁ।
এ বার হন্যে হয়ে বাড়ি খুঁজে হাজির হয়ে দেখেন, মেয়েটির বাবা তাঁর সম্পর্কের মামা! তখনই সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মঞ্চে নামা। সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে। এই সেই ‘নতুন ইহুদী’, যা কি না মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ভানুর জীবনেরও।
চল্লিশের দশকের শেষ। পুববাংলা থেকে তখন দলে দলে উদ্বাস্তু আসছে। মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ‘ইস্টবেঙ্গল রিলিফ কমিটি’ তাঁদের সাহায্য করতে সীমান্তে, স্টেশনে শিবির গড়ছে। শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত এক করে কাজ করছেন। সেই দলে ছিলেন ভানুও। তখন একটি অপেশাদার নাটকের দলও গড়েছিলেন। তারই এক সদস্য সলিল সেন উদ্বাস্তুদের নিয়ে লেখেন ‘নতুন ইহুদী’। সেই নাটকে ভানুর অভিনয় অভিভূত করে দেয় তখনকার তাবড় শিল্পীদের। লোকে বলে, এই সাফল্যই ওঁকে পুরোদস্তুর অভিনয়ে ফিরিয়ে দেয়।
‘‘ছবি জ্যাঠামশাই-এর শেষ দশ-বারো বছরে ফিল্ম লাইনে একমাত্র নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া বাবার মতো আপনার কেউ ছিল না। অথচ ওঁর সঙ্গে বাবার আলাপটা কিন্তু অত সহজে হয়নি,’’ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ভানুপুত্র গৌতমবাবু।
কী রকম? গৌতম জানিয়েছিলেন, ‘‘সে ’৪৭ সাল-টাল হবে। ‘অভিযোগ’ ছবির কাজ চলছে। বাবার খুব ইচ্ছে, ওঁর সঙ্গে আলাপ করার। জেঠু পাত্তা দিতেন না। ভেবেছিলেন, ফিল্মে চান্স পাওয়ার জন্য বাবা বুঝি তোষামোদি করেছে। আসলে তখন জহরকাকা-বাবা-প্রদীপকুমারদের মতো নতুনদের একটা দল ছিল, যাঁরা সত্যিই কাজের জন্য স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরঘুর করতেন। শেষে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে বাবার অভিনয় দেখে উনি নিজেই ডেকে পাঠান।’’
“এর পর থেকে ছবি বিশ্বাস বলতে গেলে ওঁর অভিভাবকের মতো হয়ে যান। বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থ সাহায্য করা থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি প্রযোজনা করলেন, তখন নামমাত্র টাকায় কাজ করে দেওয়া। আর কী উৎসাহ সে কাজে! দুপুর দুটোয় শ্যুট। উনি এসে বসে থাকতেন ঘণ্টা দুই আগে। প্যাকআপের পরেও আড্ডা দিতেন। কাজ না থাকলেও সেটে ঘুরে যেতেন।”
এমন এক শ্রদ্ধার সম্পর্কে দুষ্টুমি-খুনসুটি যে ছিল না, তা নয়। একবারের ঘটনা যেমন।
‘ডাকবাংলো’ নাটক। ছবি বিশ্বাসের বরাবরের অভ্যেস, মঞ্চে সংলাপ বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে অন্যকে জেরবার করা। সে দিন ভানু ঠিক করলেন, আজ উনি ওঁকে বেকায়দায় ফেলবেন! সে কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন সুখেন দাস। এর পর মঞ্চে ওঠার পর প্রায় পালাতে পথ পাননি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর শ্রী নীলিমাদেবীর বক্তব্যে, ‘‘নাটকে ওঁর নাম ছিল কৃতান্ত বিশ্বাস। ছবিদা নাম জিজ্ঞেস করলে, উনি বললেন। এ বার ছবিদা শুরু করলেন। ‘কী বললেন, বিশ্বাস?’ ‘আজ্ঞে।’ ‘কাউকে বিশ্বাস করবেন না।’ ‘আজ্ঞে।’ ‘আবার অবিশ্বাসও করবেন না।’ ‘আজ্ঞে।’ বলেই চলে যেতে চাইছিলেন। উনি বুঝে গিয়েছিলেন, আজ ছবিদা সহজে ছাড়বেন না। ছবিদা ততক্ষণে বলতে শুরু করেছেন, ‘আরে মশাই, চলে যাচ্ছেন কেন? বিশ্বাসও করবেন না, আবার অবিশ্বাসও করবেন না, তবে করবেনটা কী? বলুন,’ তখন উনি ওঁর কাছে এসে প্রায় হাত জড়ো করে বিড় বিড় করতে লাগলেন, ‘খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আর কোনও দিন করব না।’ ছবিদা বললেন, ‘ব্যাটা চালাকি আমার সঙ্গে! বল্, ‘বাড়ি গিয়ে ভাবব।’ শেষ কালে তা-ই বলে সে দিনের মতো উদ্ধার।’’
ছবি বিশ্বাস যে দিন জাগুলিয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, সে দিন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরও যাওয়ার কথা ছিল।
হঠাৎ রেডিয়ো নাটক পড়ে যাওয়াতে শেষপর্যন্ত যেতে পারেননি। তাতে আজীবন আপশোস বয়ে বেড়িয়েছেন। কেবলই তাঁর মনে হত, যদি সঙ্গে থাকতেন, কিছুতেই অমন হত না।
ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে যদি অভিভাবকের সম্পর্ক হয়ে থাকে, জহর রায় ছিলেন যেন সহোদর।
গৌতমবাবু এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘‘বাইরের লোকে ভাবত বুঝি ওঁদের মধ্যে খুব রেষারেষি। কিন্তু একদম উল্টো। ’৫৫ সালে বাবা যখন গাড়ি কিনল, জহরকাকার সে কী কাণ্ড! স্টুডিয়োয় সবাইকে ডেকে বক্তৃতা দিল, ‘শোনো ভেনো আজ রেকর্ড করেছে। বাংলাদেশের ও সর্বপ্রথম লোক, যে কমেডি করে গাড়ি কিনেছে। এ গাড়ি ওর একার নয়, সবার। বাবাকে বলেছিল, এই শোন, এ বার থেকে প্রত্যেক শনিবার সকালে আমায় গাড়ি পাঠাবি। বাবা তাই-ই করত। তেল পুরে শনিবার করে গাড়ি পাঠিয়ে দিত উত্তর কলকাতায় জহরকাকার বাড়ি। আর নিজে দরকার পড়লে ট্যাক্সি করে ঘুরত।’’
একবার তৃপ্তি মিত্র এত জোরে ভানুর হাতটা চেপে ধরেছিলেন যে, কালশিটে মতো হয়ে গিয়েছিল!
ছবির নাম ছিল ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। নির্দেশক সাধন সরকার প্রথমে চেয়েছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় রাজি হননি। ভানু ধরে নিয়েছিল, তা হলে ছবি বোধহয় আর হলই না। হঠাৎ শ্যুটিং-এ ডাক পেয়ে ফ্লোরে গিয়ে দেখেন, তৃপ্তি মিত্র!
তিনিও বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু শটে অদ্ভুত কাণ্ড! ক্লোজ শট। তৃপ্তি মিত্রও নির্ঘাত টেনশন করছিলেন। ক্যামেরা চালু হতে ভয়ে খামচে ধরেছিলেন তাঁর হাত।
‘বসু পরিবার’ ছবির আগে থেকেই মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গেও খুব ভাল সম্পর্ক ছিল তাঁর। গৌতমবাবু জানিয়েছিলেন, ‘‘উত্তমকাকু বাবাকে ডাকতেন ভানুদা, তুই। বাবাও ওঁকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখত। ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি করার সময় বাবাকে যাঁরা অর্থ সাহায্য করেছিলেন, উত্তমকাকু তাঁদের একজন, সে কথা বুড়োকাকাও (তরুণকুমার) জানত কিনা সন্দেহ। ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ছবি করার সময় বাবাকে সোনার গিনি দিয়ে অ্যাডভান্স করেছিল কাকু। ছোটিসি মুলাকাৎ-এর পর উত্তমকাকুর যখন হার্ট অ্যাটাক হল, বাইরের কারও সঙ্গে দেখা করা বারণ। বাবা এত ছটফট করছিল! সোজা চলে গিয়েছিল দেখা করতে। কেউ ঠেকাতে পারেনি’’।
সেই সম্পর্কে কোথাও যেন একটু হলেও ফাটল ধরেছিল ‘অভিনেতৃ সংঘ’-য় চিড় ধরার সময়।
ষাটের দশকের শেষাশেষি। সংঘ ভেঙে ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হল। উত্তমকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়রা চলে গেলেন ও দিকে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়ে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা। ওঁরা ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ হলেন। ওঁদের কাজকম্ম বন্ধ। ‘‘এর পরেই ‘গুপীগায়েন বাঘাবায়েন’ রিলিজ করবে। তাকেও আটকানো হতে পারে জেনে বিজলী সিনেমার সামনে বাবা, সৌমিত্রকাকু, অনুপকাকু, অজিত লাহিড়ী, সৌমেন্দু রায়দের নিয়ে ঠায় আট ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এই সময়ই প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। উত্তমকাকুর সঙ্গে বিভেদ হওয়াটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। পরে অবশ্য সব স্বাভাবিক হয়ে যায়,’’ পুরনো এই সময়ের খানিক দ্বিধায় সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন গৌতমবাবু।
হাতে কাজ নেই। কিন্তু মনে জেদ। কিছুতেই মাথা নোওয়াবেন না, আর নোওয়ান নি। যাত্রা দল গড়লেন। নীলিমাদেবীর বক্তব্যে, ‘‘যে মানুষ নরম বিছানা ছাড়া শুতেন না, তিনিই কিনা তখন গ্রামগঞ্জে গিয়ে শতরঞ্চি পেতে গাছের তলায় ঘুমোতেন। দিনের পর দিন ফুলুরি, মুড়ি, জিলিপি খেয়ে কাটাতেন। একটা আধভাঙা বাড়িতে একবার বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, বুকের ওপর সিলিং-এর চাঙড় খুলে পড়ল।’’
তবু নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে কিছুতেই আপস নয়। যা ভাল বুঝতেন করতেন। সে অবস্থা যাই হোক না কেন। নইলে দ্বিরাগমনে গিয়ে অমন কাণ্ড কেউ বাধাতে পারে!
নীলিমাদেবী নিজের মুখে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন সে কথা,
… ‘‘৪৬-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি বিয়ে হল। ২৬ তারিখ গেছি জোড়ে। তখন উনি আয়রন অ্যান্ড স্টিল কনট্রোলে কাজ করেন। অফিস থেকে ফিরে আমায় নিয়ে বেরলেন। বাপের বাড়ির দরজায় ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো থেকে আসছি। কাজ আছে।’ আমরা স্টুডিয়ো পাড়াতেই থাকতাম। আমাদের বাড়ির এক দিকে রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো। যেটা প্রথম দিকে ছিল দূরদর্শন অফিস। অন্য দিকে ভারত লক্ষ্মী স্টুডিয়ো। যেটা এখনকার ‘নবীনা’ সিনেমা। আমাদের বাড়িটা একেবারে মানিক বন্দ্যোপাধায়ের পাশের বাড়ি। ও চলে গেল। আর আসে না। এ দিকে সন্ধে গড়িয়ে রাত। সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ছে। বাড়ির জামাই আর ফেরে না। শেষে বাবা বেরোলেন খুঁজতে। স্টুডিয়োয় গিয়ে খোঁজ করতে, দারোয়ান একটা লোকের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। গায়ে কালিঝুলি মাখা। ছেঁড়া চট চাদরের মতো জড়ানো। ভাল করে নজর করে দেখলেন, এই লোকটাই তাঁর জামাই। কী একটা নাকি ফিল্মের শ্যুটিং হচ্ছে, তাতে অভিনয় করছে সে। কাজ শেষ হতে তখনও আরও দেরি। বাবা ফিরে এসে গোঁজ হয়ে বসে রইলেন। আমার ঘুম এসে গিয়েছিল। গভীর রাতে কারও গলার আওয়াজ শুনে দেখলাম, মা তাঁর জামাইকে আদর করে খাওয়াচ্ছেন। তখন রাত দুটো কী আড়াইটে।’’
সে-ছবির নাম ছিল ‘জাগরণ’। নির্দেশক বিভূতি চক্রবর্তী। উনিই ডাক পাঠিয়েছিলেন স্টুডিয়োয়। যেতেই বলেন, ‘‘দুর্ভিক্ষপীড়িত এক চিমসে চেহারার চরিত্র আছে। করবে?’’ রাজি হতেই শ্যুটিং শুরু। সেই প্রথমবার।
সেই যে ছবিঘরে ঢুকলেন, তারপর থেকে মঞ্চ আর সিনেমা, সিনেমা আর মঞ্চ। আর সে ভালবাসার যে কী টান! তাঁর নিজের পিতা গত হয়েছেন, তাঁকে দাহ করে ধরাচুড়ো পরে ভানু সেদিনও স্টারে অভিনয় করতে গেছেন!
এমনও হয়েছে, সবে হার্ট অ্যাটাক থেকে উঠেছেন। ডাক্তার বলেছেন একদম বিশ্রাম। এ দিকে শো। নাছো়ড়, যাবেনই যাবেন। কোনও কথা শুনবেন না। শেষে বেগতিক দেখে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করেছিলেন নীলিমাদেবী, ‘‘ফোন পেয়ে পুলু বাড়ি চলে এল। ওর কথা একমাত্র শুনত। ও বারণ করল। ফোন করে প্রডিউসারের সঙ্গেও কথা বলল। তবে যাওয়া আটকালো।’’
বাড়ির কাজকম্ম করতেন কোনও দিন? শুনে হেসে নীলিমাদেবী জানিয়েছিলেন, ‘‘জীবনেও না। বাড়িতে ঠাকুর ছিল যজ্ঞেশ্বর। সেই-ই সব করে দিত। একবার আমার শাশুড়ি বললেন, কী সব বাজার আনে, তুই যদি করতি, কত ভাল হইত ক’তো!’ মাকে তখনকার মতো আশ্বাস দিয়ে সরে পড়ল। পর দিন থেকে ঠাকুরকে নিয়ে থলে হাতে বেরত, সবাই ভাবত ও-ই সব করে। মা কী খুশি! একদিন ধরা পড়ে গেল সব। বাজারটা যথারীতি ঠাকুরই করছে। থলে হাতে বেরনোটা ওর বাহানা।’’
তবে খেতে নাকি খুব ভালবাসতেন। গৌতমবাবু জানিয়েছিলেন, ‘‘ইলিশ মাছ পেলে বাবা কিচ্ছু চাইত না। ভাজা ইলিশ হলে ভাতের ওপর মাছটা রাখত। কিছুক্ষণ বাদে সেখান থেকে সরিয়ে তার তলার তেল-ভাতটা খেত। আবার ও পাশ থেকে সরিয়ে এ পাশে ভাতের ওপর নিয়ে আসত মাছটা। এমনি করে… আর ভালবাসত কই, ট্যাংরা। রবিবার হলে পাঁঠার মাংস চাই-ই।’’
ভালবাসতেন গান। নজরুল গীতি। নীলিমাদেবীর গলায় প্রায়ই শুনতে চাইতেন, ‘বাঁশি বাজাবে কবে আবার বাঁশুরিয়া’। আর শচীনকর্তার পল্লিগীতি হলে তো কথাই নেই।
‘কর্তা’র গান যেমন ভালবাসতেন, তেমন উনি কলকাতায় থাকলে আর ইস্টবেঙ্গলের খেলা পড়লে, লাইফ মেম্বর ভানু মাঠে যেতেনই যেতেন। হাফটাইমে শচীন কর্তার সিগারেট, পান, চিনেবাদামের জিম্মাদারও হতেন উনিই।
বাড়িতে কুটোটি নাড়তেন না, কিন্তু বাইরে সেই মানুষটাই ‘দ্য গ্রেট ম্যানেজ মাস্টার’।
‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’র শ্যুটিং। এলাহাবাদে। আউটডোর। প্রবাসী বাঙালিরা হামলে পড়েছেন। ওঁরা শুনেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন লোকেশনে। এ দিকে তিনি তখন কাজ নেই বলে ‘যাত্রিক’ হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
এ দিকে লোকের ঢল এত বাড়ছে যে কিছুতেই ক্যামেরা নিতে পারছেন না অভিনেতা দিলীপ রায়। কাজ ভেস্তে যায় প্রায়। বিপদ বুঝে হোটেলে গাড়ি পাঠালেন কর্তারা। ভানু এলেন। আর দূরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখ করে নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলে বলে দর্শক সামলে দিলেন, ‘‘আমারে দ্যাখনের কী আছে কন তো! দ্যাখেন, তবে জোড় হাত কইর্যা কইতাছি, গোলমাল কইরেন না।’’
দিব্যি কাজ হয়ে গেল তাতে। লোকে বলতেন, এমন মুখ করে এত হাসির কথা বলা কী করে সম্ভব? বার বার কেটে কেটে একটাই উত্তর দিতেন, ‘‘মন্ত্রগুপ্তি ফাঁসে মানা আছে।’’
আড্ডায় বসে প্রায়ই বলতেন, ‘‘আমার দশা ক্যামনে শুনেন। মা মারা গ্যাছে। শ্মশানে গেছি। চোখে জল। একটা লোক কাছে আইয়া কইল, আরে ভানুদা কী হইসে? কোনওক্রমে কইলাম, ভাই মা মারা গ্যাসেন। শুইন্যা হাসতে হাসতে চইল্যা যাইতে যাইতে কইল, ‘দ্যাখ, ভানুরে কাঁদলে কেমন লাগে!’ বুঝেন একবার! হালা, নিজে যখন শ্মশান যামু লোকে দেইখ্যা বলবে, ওই দ্যাখ, ভানুর মাথাটা কেমন নড়তাসে!’’
এই মানুষই কিন্তু বাড়িতে এলে অন্যরকম হয়ে যেতেন। গম্ভীর। বিশেষ কথা বলতেন না। ‘‘বাড়িতে থাকতই বা কতটুকু। চাকরি ছাড়ার পর তো আরওই। সক্কালে বেরত, রাত করে ফিরত। চুনী গোস্বামীর এক দাদা, ফুটবলার মানিক গোস্বামী এক বার বলেছিলেন, লোকে আড়াইশো বছরে যে কাজ করে, ভানু সেটা এক জীবনে করেছে,’’ জানিয়েছিলেন গৌতমবাবু।
সংসারে তেমন সময় দিতে পারেননি, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, কেরিয়ার নিয়ে কোনও দিন ভাবতে পারেননি, পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাওয়াও হয়ে ওঠেনি এর বারও। কিন্তু মুম্বই-এ অফার নিতে কী যে কুণ্ঠা ছিল! তার একমাত্র কারণ এই শহর কলকাতা, আর তাঁর পরিবার।
গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’র অফার ছেড়েছেন। কোনওক্রমে পরিচালক সত্যেন বসুর ‘বন্দিস’ বা হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’ করেছেন, তা’ও বন্ধুর আব্দারে।
এর পর একে একে ফিরিয়েছেন বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তীর মতো পরিচালকদের অনুরোধ।
অথচ তাঁরই ‘পাশের বাড়ি’ নিয়ে যখন ‘পড়োশন’ হবে, তাতে অভিনয় করার আগে মেহমুদ কলকাতায় তাঁর পরামর্শ নিতে আসেন। ‘সাগিনা মাহাতো’র শ্যুটিং করতে এসে কেষ্ট মুখোপাধ্যায় জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘‘দাদা, কী করেছেন সাড়ে চুয়াত্তর-এ! ওটাই আপনার বেস্ট।’’ এত প্রশংসাও তাঁকে শহরের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি।
গৌতমবাবুর বক্তব্যে, ‘‘বাবার বাইরের ইমেজটার জন্য লোকে ভুল বুঝত। এ জন্য আমাদেরও ভুগতে হয়েছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন শুনতাম। আমার বোন তো একবার সোজা এসে বলল, স্কুলে ওকে বন্ধুরা খালি বলে, ‘হ্যাঁরে, তোর বাবা সম সময় খুব হাসায় না?’’ বারবার অমন শুনতে শুনতে ওর বিরক্ত লাগছিল। বাবা শুনে বলল, ‘আইজ তরে যে কইসে তার বাবা কী করে?’ ও বলল, ‘সার্জেন। ডাক্তার।’ ‘অ, তাইলে ওরে কইবি, শুন, তর বাপ কি তরে দ্যাইখ্যা সব সময় ছুরি-কাঁচি লইয়্যা প্যাট কাটতে আসে? এই ছিল আমার বাবা।’’’
এই একই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, যখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবী অনন্ত সিংহ জেলে, বাড়ি থেকে প্রায়ই খাবার নিয়ে যেতেন। অন্যায় দেখলে বেপাড়ায় গিয়ে গুন্ডাও শায়েস্তাও করেছেন।
বসুশ্রী সিনেমার মন্টু বসুর ঘর বা রাসবিহারী মোড়ে ‘অমৃতায়ণ’ রেস্তোরাঁ ছাড়া লেকমার্কেটে ‘রাধুর চায়ের দোকান’-এ ওঁর এক আড্ডা ছিল। ও পাড়াতেই থাকতেন গায়ক সুধীরলাল চক্রবর্তী। শচীনদেব বম্বে চলে যাওয়ার পর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয় সুধীরলালের। সুধীরলালের তখনই খুব নাম। বোধহয় ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ও বেরিয়ে গেছে। লেক মার্কটের মস্তানরা সুধীরলালের ওপর জুলুম করতে শুরু করল। দলবল নিয়ে তার বিহিত করেছিলেন উনিই।
তাঁর পুত্রের ভাষ্যে জানা যায়, একদা হাতিবাগান পাড়ায় ভানু রীতিমতন মারামারি তে জড়িয়ে পড়েছিলেন! গাড়ি নিয়ে তিনি একদিন হাতিবাগানের স্টারে ‘পরিণীতা’র শো করতে গিয়ে দেখেন অবাক কাণ্ড! একদল চ্যাংড়া ছেলে তুলসী চক্রবর্তীকে রাস্তায় ঘিরে ধরেছে। ধুতির কোঁচা ধরে, জামা ধরে টানছে। চাঁটিও মারছে। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল তাঁর। গাড়ির দরজা খুলে সোজা গিয়ে এক-একজনকে রামধোলাই। কিল, ঘুষি, লাথি। নিমেষে সবাই হাওয়া। সে তো হল, এর পর তুলসী চক্রবর্তী কী বলেছিলেন সেটি মনে রাখার মতন, ‘‘আহা, অত রাগিস কেন, একটু মজা করে যদি ওরা আনন্দ পায়, পাক না। খামোকা মারলি!’’
ভয়ডর বলে সত্যিই কিছু ছিল না তাঁর। জোরজলুম কখনওই বরদাস্ত করেননি। ’৫২-’৫৩ সালের কথা। বামনেতা রাম চ্যাটার্জির তখন খুব দাপট। তিনি তাঁর ভগ্নিপতি আর জনা চারপাঁচ লোক নিয়ে জিপে করে এলেন চন্দননগর থেকে। ঘটনার বর্ণনা করে এক সাক্ষাৎকারে গৌতমবাবু জানিয়েছিলেন, ‘‘বাবাকে বললেন, আমার ফাংশানে যেতে হবে। বাবা বলল, পারব না। কাজ আছে। তাতে উনি বললেন, ‘তোমায় যদি জোর করে নিয়ে যাই, আটকাতে পারবে?’ ওপরে গাড়ি বারান্দায় কয়েকটা মার্বেলের টব ছিল, সেটা দেখিয়ে বাবা বলল, ‘তোমার মাথায় কি মাসল্ আছে, ওগুলো মাথায় যদি মারি কী করবে?’ ব্যাপারটা আমায় বলেন খোদ রাম চ্যাটার্জিই। আমি যখন ওঁর কাছে গভর্নর হাউসে গিয়েছিলাম, বাবার শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন করতে। আসলে বাবার এই সাহসটা অনেকটা বাড়ি, বিশেষ করে ঠাকুমার কাছ থেকে পাওয়া,’’।
এক সাক্ষাৎকারে ১৯০৫ সালের একটা গল্প শুনিয়েছিলেন গৌতমবাবু, ‘‘আমার ঠাকুমা বেঙ্গল বোর্ডের প্রথম ভারতীয় ইন্সপেক্ট্রেস্ অব স্কুলস্। দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। তাড়াহুড়োয় ইংলিশ লেডিদের কামরায় উঠে পড়েন। মেমরা নেমে যেতে বললে, ঠাকুমা বলেন, পরের স্টেশনেই নেমে যাবেন। ওঁরা কোনও কথা শুনতে নারাজ। ওঁদেরই একজন টান মেরে ঠাকুমার বাক্স-প্যাঁটরা ফেলে দিলেন বাইরে। তাতে ঠাকুমা সেই মেমের চুলের মুঠি ধরে এমন প্রহার দেন, মেম অজ্ঞান হয়ে যান। ট্রেনের গার্ড তখন ওঁকে অ্যারেস্ট করবেই। শেষে ঠাকুমার এক ভাই জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ওঁকে বাঁচান। এই ঘটনাটা বাবা মারা যাবার দু’দিন আগেও বলতেন। ’’
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাপও অনেকটা এরকমই এক ঘটনায়।
ঢাকায় কলেজ হস্টেলের ছেলেরা সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করে ডাকল। খুব হইচই। দালান জুড়ে বড় পাত করে এলাহি খাওয়াদাওয়া। কোথা থেকে একজন পঙ্গু ভিখারি খুব কাকুতিমিনতি করে খাবার চাইতে এল। ছাত্ররা তাকে ‘দূর দূর’ করে কম্পাউন্ডের বাইরে তাড়িয়ে দিল। ব্যাপারটা খেয়াল করে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় দূরে গিয়ে বসে রইলেন অন্যদের মধ্যে। এ দিকে আমোদআহ্লাদ ক্রমে সপ্তমে। খাবার নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়িও শুরু হল। এ বার আর থাকতে না পেরে সটান হেঁশেলে চলে গেলেন ভানু। টান মেরে বাগানে খাবার ফেলতে লাগলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘‘আমিও খাব না, কাউকে খেতেও দেব না।’’ সবাই মিলে বাধা দিতে এলে এক-আধজনকে দু-ঘা দিলেনও।
এই ঘটনা নিয়ে তখন খুব হট্টগোল পড়ে যায়। সবাই প্রায় ওঁর বিরুদ্ধে। পাশে দাঁড়ান সত্যেন বসু। সেই শুরু। তারপর তো ছাত্র ভানুর ঢাকাই নকশায় মজে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় কোনও এক যাত্রা সম্মিলনী থেকে আমন্ত্রণ এলে বলেন, ‘‘আরে আমাকে কেন, ভানুকে নিয়ে যাও।’’ তাতেও তারা নাছোড় হলে তাদের রসগোল্লা খাইয়ে বিদায় দেবার সময় বললেন, ‘‘আমার কাছে শুধু গোল্লা পেলে, ভানুর কাছে গেলে রসটা পাবে।’’
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিকস-এ নাকি উচ্ছ্বসিত ছিলেন মুজতবা আলীও। নাট্যকার মনোজ বসুর বাড়িতে ভানু প্রথম সাক্ষাতে আলী সাহেবকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার সাহিত্যের আমি খুব ভক্ত।’’ তাতে তাঁকে চমকে দিয়ে আলীসাহেব ভানুরই ‘ঢাকাই কুট্টি’-দের কমিক গড়গড়িয়ে বলে যান।
’৭৯ থেকে তাঁর শরীরটা খুব ভাঙছিল। বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই অবস্থাতেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ করলেন।
’৮৩-র ফেব্রুয়ারি। এত অসুস্থ হলেন যে, সিএমআরআই-এ ভর্তি করতে হল। সে বারের মতন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। মার্চের ৪। আবার অসুস্থ। বুকে অসহ্য ব্যথা। এ বারও ভর্তি না করে উপায় নেই। তবে বাইরে থেকে দেখে বোঝে কার সাধ্যি! সোজা হেঁটে হেঁটে গাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। শেষ বারের জন্য গাড়িতে চড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে।
এনালার্জড হার্ট ছিল। তিন চার বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ায় শেষ দিকে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তার মধ্যে রেনাল ফেলিওর। ‘‘চলে যাওয়ার এক মাস আগে নার্সিংহোমে ভর্তি হল। ডাক্তার বলল, তিন মাস রেস্ট। তার মধ্যেও এক বার উত্তরবঙ্গে গিয়ে যাত্রা করে এল। রোগা হয়ে যাচ্ছিল। সে দিন সকাল থেকে কী বমি! কী বমি! ভর্তি করা হল। উডল্যান্ডস্। দোতলায়। আইসিসিইউ। আমার ভাই ঠিক সাত দিন আগে ন’বছর বাদে তখনই দেশে ফিরেছে। ভগ্নিপতির সঙ্গে ও-ই রাত জাগতে হাসপাতালে ছিল। সে রাত আর গড়াল না। বারোটা নাগাদ খবর এল, ‘বাবা আর নেই,’’ সাক্ষাৎকারে প্রায় বুজে যাওয়া গলায় কথাগুলো জানিয়েছিলেন গৌতমবাবু।
অভিনয় ভানুর পেশা তো বটেই, নেশাও ছিল। সাফল্য করায়ত্ত হওয়ার পরেও অনুশীলনে ফাঁকি দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতেন না। রেডিয়োয় যখন কাজ করা শুরু করেছিলেন, তখন লাইভ টেলিকাস্টের ব্যবস্থা ছিল। মূল অনুষ্ঠানের আগে অন্তত বার চারেক রিহার্সাল দেওয়ার অভ্যেস ছিল তাঁর। লাইভ অনুষ্ঠান যখন উঠে গেল, রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে সব ভুল-ত্রুটি সারিয়ে নেওয়াটা হয়ে গেল অনেক সহজ, তখনও নাকি ওই চারদিনই রিহার্সাল দিতে ছুটতেন! নিজেই স্বীকার করেছেন, রেডিয়ো থেকে প্রাপ্ত টাকায় তাঁর গাড়ির তেল খরচাটুকুও উঠত না, বেশিরভাগ সময়ে সহ অভিনেতারাও কেউ আসতেন না, কিন্তু তিনি ঠিক যেতেন। নাটক-যাত্রার মতো মাধ্যম ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। কারণ তৎক্ষণাৎ বোঝা যেত দর্শকের পছন্দ-অপছন্দ। খুব সময়ানুবর্তী ছিলেন। আর বাঙাল বলে গর্ব ছিল সাঙ্ঘাতিক! কন্যা বাসবী জানিয়েছিলেন, ‘‘বাবা প্রতিটি অনুষ্ঠান নাটক বা যাত্রার জন্য মঞ্চে ওঠার আগে খুব ছটফট করতেন, টেনশন হত ওঁর। প্রতিবার মঞ্চে উঠতেন প্রথম দিনের অস্থিরতা নিয়ে। নিজেই বলতেন,
“যেদিন এটুকু থাকবে না, সেদিন শিল্পী হিসেবে আমি শেষ হয়ে যাব!’’
পি জি উডহাউসের লেখা আর চার্লি চ্যাপলিনের ছবির খুব বড়ো ভক্ত ছিলেন। যখন নাটক বা সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তখনও ভরসা রেখেছেন চার্লির বোধের উপরেই। তিনি নিজেই লিখেছিলেন,
“আমি বিশ্বাস করি, পরিবেশন ঠিকমতো হলে সাধারণ মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, চার্লি চ্যাপলিনের কোনও ছবিই সাধারণ মানুষের দুর্বোধ্য নয়।”
তিনি মনে করতেন সমাজের সমস্যাগুলো তুলে ধরার একটা নৈতিক দায়িত্ব থেকে যায় প্রতিটি শিল্পীর, তিনি তাঁর কৌতুক নকশা বা নাটকের মাধ্যমেও সে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন আজীবন।
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সাল।
২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই এপ্রিল ২০১৭ সাল।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১শে আগস্ট ২০১২ সাল।
৪- https://m.femina.in/bengali/celebrity/tolly/looking-back-bhanu-bandyopadhyay-1074.html)