দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরেই, আসামে ফের এনআরসি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে মোদী সরকার। সম্প্রতি এনআরসিতে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল কংগ্রেস সাংসদের মাকে। বাদ যাননি কার্গিল যোদ্ধা প্রাক্তন সেনাকর্মী মহম্মদ সানাউল্লাহ ও তাঁর পরিবারও। তাঁকে ‘বিদেশি’ তকমা দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। বাদ যাননি আসামের বিজেপি নেতা শান্তনু নাইকও। তাঁর গায়েও লাগতে পারে ‘বিদেশি’ তকমা। এবার তাই এনআরসির বিরোধীতায় পথে নেমে বিক্ষোভ শুরু করল গেরুয়া শিবিরও। গোটা আসাম জুড়েই শুরু হয়েছে বিজেপি ও তাদের শাখা সংগঠনগুলির সক্রিয় বিরোধিতা।
এ হেন ঘটনা দেখে শুক্রবার তড়িঘড়ি গুয়াহাটিতে জেলাশাসক ও পুলিশ অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। বৈঠকে তিনি বলেন, এনআরসিতে নাম না থাকলেই তাঁকে বিদেশি বলা যাবেনা। বিদেশি বলার অধিকার শুধু ফরেনার্স ট্রাইবুনালের। যদিও বিজেপিরই এক বিধায়ক শিলাদিত্য দেব দিন দিন সুর চড়িয়ে এনআরসি নিয়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়ে চলেছেন। থানায় অভিযোগ করেও সুরাহা মিলছে না। বিজেপি নেতারাও সযত্নে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন শিলাদিত্যকে। তাই বিজেপির বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। আসামের ভাষীক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা, এই দ্বিচারিতার পিছনে বিজেপির বড় কোনও অভিসন্ধি রয়েছে।
উল্লেখ্য, আগামী ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হবে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা। এর আগেই ৪২ লাখ মানুষের নাম বাদ দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে খসড়া তালিকা। খসড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের ২৯ শতাংশের তথ্য ফের যাচাই হয়েছে। উগ্র বাঙালি বিদ্বেষী বলে পরিচিত সারা আসাম ছাত্র সংস্থা বা আসু অন্তত ৫ লাখ বাসিন্দার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। প্রায় কয়েক লাখ মানুষকে বাদ দিয়ে প্রকাশ হতে চলেছে চূড়ান্ত তালিকা। আপত্তি জানানোর সময়ে বিজেপি বা তাঁদের সমর্থকরা একজনের বিরুদ্ধেও আপত্তি জানায়নি। এখন তারা দাবি তুলেছে, ফের তথ্য যাচাই করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করলেও রাজনৈতিক ফায়দা নিতে মরিয়া বিজেপি ও তাদের শাখা সংগঠনগুলি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
বিজেপির এই দাবির সবচেয়ে বড় সমালোচক এখন আসু। আসামে ‘বঙাল খেদা’ আন্দোলনের হোতা এই ছাত্র সংগঠনটি চাইছে এনআরসি প্রকাশ হোক। বিজেপি এটা চাইছে না। তারা বিদেশি সমস্যা জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে চাইছে বলে মনে করেন আসুর উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য। কংগ্রেসও এনআরসি প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়ার দাবি, বৈধ নাগরিকদের নাম বাদ দেওয়া চলবে না। ভারতীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হয়রানিরও বিরোধিতা করেন তিনি। বিজেপির বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ করে সঠিক এনআরসি চালুরও দাবি তোলেন এই কংগ্রেস নেতা।
এদিকে, বহু বিদেশি মুসলিমের নাম এনআরসিতে থাকবে। এই অভিযোগ তুলে পথে নেমেছে বিজেপি ও তাদের লেজুড় সংগঠনগুলি। বিভিন্ন জায়গায় এনআরসি কেন্দ্রের সামনে ধর্না দিতে শুরু করেছে বিভিন্ন গেরুয়া সংগঠন। বিক্ষোভকারীদের পান্ডা শিলাদিত্য দেব বলে চলেছেন, ‘বাংলাদেশি মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে মরিয়া এনআরসি। তাই এর বিরোধীতা চলবে।’ মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, এনআরসি পছন্দ না হলে বিধানসভায় বিল এনে তাঁরা বাতিল করে দেবেন গোটা প্রক্রিয়া। সেইসঙ্গে জানান বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে তাঁদের সরকার।
এতেই উদ্বিগ্ন আসামের সাধারণ মানুষ। আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতি (সিআরপিসিসি)–র চেয়ারম্যান তপোধীর ভট্টাচার্য বিজেপির আচরণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চোরকে চুরি করতে বলছে। আর গৃহস্থকে সাবধান করছে। ওদের গেমপ্ল্যান অন্য। বাঙালি জাতিকেই ধ্বংস করতে চাইছে।’ তাঁর অভিযোগ, আসাম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা রূপায়ণে গঠিত শর্মা কমিটি আসলে কেড়ে নিচ্ছে অসমে বাঙালিদের বেঁচে থাকার অধিকার। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘অমিত শাহের বুদ্ধিতে সর্বানন্দ এখন আধা-সেনাকে সঙ্গে নিয়ে তেড়ে মেরে ডান্ডা, করে দেব ঠান্ডা নীতি নিয়ে মানুষের অধিকার হরণ করতে চাইছেন। এর প্রতিবাদ করা জরুরি।’
উল্লেখ্য, এর আগে তালিকায় নাম না থাকা আরএসএসের দীর্ঘদিনের কর্মী তথা বর্তমানে আসাম বিজেপির অন্যতম নেতা শান্তনু নাইকও এনআরসির বিরোধীতায় বলেছিলেন, এনআরসির মাধ্যমে আসলে হিন্দুদেরই হেনস্থা করা হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে এসে হাজার হাজার মানুষ যুগ যুগ ধরে আসামের মাটিতে বাস করছেন। এখন আচমকা তাঁদের বিদেশি তকমা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করা হচ্ছে। আমিও চাই আসামে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী মুক্ত হোক। কিন্তু আমি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত, যে পদ্ধতিতে এনআরসি করা হচ্ছে, তা ষোলো আনা ভুলে ভরা।