তৃণমূল আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমার্থক। তৃণমূলের সভায় এখনও ‘ক্রাউডপুলার’ দলনেত্রী। তাঁর এক ডাকেই বাংলার সব প্রান্ত ছুটে আসেন কর্মী-সমর্থকরা। শুধু আজ নয়, নয়ের দশকে যুব কংগ্রেস নেত্রী থাকাকালীনও একার দমে ব্রিগেড ভরাতে পারতেন মমতা। তবে শুধু তাই নয়। ফেসবুক এবং টুইটারেও সমান ভাবে সক্রিয় তিনি। সোশ্যাল মিডিয়াকে খুব সুচারু ভাবে কাজে লাগানোর নিরিখে যে রাজনীতিকরা এ দেশে প্রথম সারিতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম।
‘টিম প্রশান্ত কিশোর’ (টিম পিকে) তৃণমূলের সহযোগী হয়ে ওঠার পর এই ব্র্যান্ড মমতাকে ঘষামাজা করেই ‘মেক ওভার’-এর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যার ছাপ সোশ্যাল মিডিয়াতেও স্পষ্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বা হ্যান্ডলগুলো যেমন চলছিল, তেমনই চলছে। কিন্তু সেগুলোর পাশাপাশিই দ্রুত মাথা তুলছে আর একটা ফেসবুক পেজ— ‘আমার গর্ব মমতা’। তৃণমূলের আইটি সেল কিন্তু এই ফেসবুক পেজ চালাচ্ছে না। চালাচ্ছে টিম পিকে। কী কাজ এই ফেসবুক পেজের? এখানে মূলত সেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মানুষের কেন ভাল লাগে সে কথা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরতে পারবেন সাধারণ মানুষ।
শুধু তাই নয়। এই পেজের মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানা বার্তা ও পদক্ষেপের কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া, রাজ্য সরকারের সমস্ত প্রকল্প ও কাজকে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরা, ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচীর সাফল্য প্রচার করা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিভিন্ন ‘সাফল্যের’ আখ্যান নিত্য নতুন কার্টুনের মাধ্যমে নিয়মিত তুলে ধরার কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন পিকের টিমের সদস্যরা। মাঝে মধ্যেই কার্টুনের মাধ্যমে বৃহত্তর কোনও রাজনৈতিক বার্তাও দেওয়া হচ্ছে। সে রকম বেশ কয়েকটি কার্টুন ইতিমধ্যেই বেশ চোখ টেনেছে সোশ্যাল মিডিয়ার। রাজনৈতিক পরিসরে চর্চাও হয়েছে জোরদার।
কলকাতার বেশ কিছু বিগ বাজেট দুর্গাপুজো কমিটির কাছে আয়-ব্যয়ের হিসেব চেয়েছে আয়কর বিভাগ। তা নিয়ে বিজেপি-তৃণমূল তথা কেন্দ্র-রাজ্য সঙ্ঘাত বেশ স্পষ্ট। খোদ মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে, এ রাজ্যের সবচেয়ে বড় উৎসব তথা এ রাজ্যের সংস্কৃতির উপরে আঘাত হানতে চায় বিজেপি, তাই দুর্গাপুজোর ওপরে কর বসানো হচ্ছে। এই বক্তব্যকেই কার্টুনের মাধ্যমে প্রকাশ করে অন্য মাত্রা দিয়ে দিয়েছে ফেসবুক পেজ ‘আমার গর্ব মমতা’। সে কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, মর্ত্যে আসার আগে মা দুর্গাকে আয়কর দফতরে হাজির হতে হয়েছে। সেখানে তাঁকে আয়কর কর্তা জিজ্ঞাসা করছেন, ‘শেষ কবে আইটি রিটার্ন ফাইল করেছেন?’ যা শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেবী।
চর্চায় এসেছে প্রয়াত বিজেপি নেতা তথা দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ককে চিত্রিত করে তোলা এক কার্টুনও। অটল তখন প্রধানমন্ত্রী। মমতা তখন বিজেপির শরিক এবং অটলবিহারী-ক্যাবিনেটের রেলমন্ত্রী। কলকাতা সফরে এসে মমতার বাড়িতে গিয়েছিলেন বাজপেয়ী। সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে কার্টুনটি পোস্ট করা হয় চলতি মাসের ১৬ তারিখে, অর্থাৎ বাজপেয়ীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে। কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে, মমতার বাড়ির মেঝেতে বসে রয়েছেন বাজপেয়ী। সামনে বসে রয়েছেন মমতাও। আর মমতার মা গায়ত্রীদেবী মালপোয়া দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
মৃত্যুবার্ষিকীতে বাজপেয়ীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই ওই কার্টুনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঠিকই, কিন্তু এর পাশাপাশি এখনকার এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তখনকার এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পার্থক্যও দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। আবার, সবুজসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী-সহ যে সব সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালাচ্ছে সরকার, সে সবের প্রচারও কার্টুনের মাধ্যমেই হচ্ছে। ২০১১-র আগে বাংলার মানুষ কী ধরনের সমস্যার মুখে পড়তেন, ২০১১-র পর থেকে কীভাবে সে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে— কার্টুন আর সংলাপের মাধ্যমে সেসবই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
কেমন সাড়া মিলছে এই নয়া ধাঁচের প্রচারে? এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে না চাওয়ায় টিম পিকের সদস্যরা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতা কিছুটা এড়িয়েই চলছেন ঠিকই, তবে এই নতুন ফেসবুক পেজটিকে নিয়ে আগ্রহ যে ভাবে বেড়েছে, তাতে টিম পিকে আশান্বিত বলেই তৃণমূল সূত্রের খবর। তৃণমূল নেতাদেরও অনেকেই বেশ উচ্ছ্বসিত। এক রাজ্যসভা সদস্যের কথায়, “একদম নতুন ধরনের স্ট্র্যাটেজি এই কার্টুন-প্রচারটা। আমাদের আইটি সেল বরাবরই জোরদার কাজ করেছে। কিন্তু ‘আমার গর্ব মমতা’য় যে কার্টুনগুলো শেয়ার হচ্ছে, সেগুলো খুব নজরকাড়া। খুব সহজে মন ছুঁয়ে যায়।”