নয়াদিল্লীতে ১৪ই আগস্ট তখন বিজেপির সর্বভারতীয় সদর দফতরে পৌঁছে গিয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক সেরে বিজেপিতে যোগ দেবেন শোভন-বৈশাখী, সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁদের দলে স্বাগত জানানো হবে— এই আনুষ্ঠানিকতাটাই শুধু বাকি তখন। ঠিক সেই সময়েই উঠেছিল ‘ঝড়’। শোভন এবং বৈশাখী যখন জানতে পারেন যে রায়দীঘির তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়ও বিজেপিতে যোগ দেবেন বলে হাজির হয়েছেন বিজেপি সদর দফতরে, সেইসময়ই বেঁকে বসেছিলেন তাঁরা। যার ফলে সেদিন আর বিজেপিতে যোগ দেওয়া হয়নি দেবশ্রীর। কিন্তু এবার দেখা গেল, ফের উজ্জ্বল হয়ে উঠছে পদ্মশিবিরে দেবশ্রী রায়ের যোগদানের সম্ভাবনা।
প্রসঙ্গত, নয়াদিল্লীতে বিজেপিতে তাঁদের আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগদানের দিন শোভনই পুরোপুরি ভেস্তে দিয়েছিলেন দেবশ্রী রায়ের যোগদানের কর্মসূচী। এক সময়ে শোভনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন দেবশ্রী রায়। রায়দীঘির মতো দুর্ভেদ্য বাম ঘাঁটি থেকে পর পর দু’বার অভিনেত্রী দেবশ্রীকে জিতিয়ে আনার মূল কৃতিত্বও যে শোভনেরই ছিল, সে কথা অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করে নেন। কিন্তু পরবর্তী কালে সে সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছয়। এবং ক্রমশই তা আরও তিক্ত হয়ে ওঠে। তাই বিজেপি দফতরে সেদিন দেবশ্রী রায়কে দেখেই বেঁকে বসেন শোভন।
বিজেপি নেতৃত্বকে তিনি সে দিন সাফ জানিয়ে দেন যে, দেবশ্রী রায়কে দলে নেওয়া হলে তিনি ও বৈশাখী যোগদান করবেন না। শুধু তাই নয়, অদূর ভবিষ্যতেও যদি দেবশ্রীকে দলে নেওয়া হয়, তা হলেও তিনি দল ছেড়ে দেবেন। তবে সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই কিন্তু বদলে গেল পরিস্থিতি। দেবশ্রী রায়কে বিজেপিতে স্বাগত জানানোর বিষয়ে আপত্তি করলে চলবে না— এই বার্তা শোভন চট্টোপাধ্যায়কে মঙ্গলবারই দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। এবং শোভনও ‘বাধ্য ছেলের’ মতল সেই বার্তার বিরোধীতা করেননি বলে খবর।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার যে শোভন চট্টোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা দেওয়া হবে রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে, সে কথা সোমবার রাতেই এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল। বিবৃতিতে যে হেতু শুধু শোভনের নাম ছিল, সে হেতু বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বিজেপি দফতরে যেতে রাজি ছিলেন না। তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘অপমান’ সহ্য করে রাজনীতি করবেন না। এরপরই তড়িঘড়ি মঙ্গলবার সকালে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় এবং তাতে বৈশাখীর নাম লেখা হয়। রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থেকে বৈশাখীকে ফোন করেও দুঃখপ্রকাশ করা হয় এবং জানানো হয় যে, শোভনের সঙ্গে তাঁকেও সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
সকাল থেকে টানাপড়েন চললেও অবশেষে মঙ্গলবার দুপুরে বৈশাখী সিদ্ধান্ত নেন যে, শোভনের সঙ্গে তিনি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির হবেন। বিজেপি দফতরে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন যে, ‘আমি গোঁসা করে ঘরে বসে থাকলে শোভনদার সংবর্ধনা ম্লান হয়ে যেত। তাই এসেছি।’ আর সেই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ার পরেই দেবশ্রীর ব্যাপারে নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা শোভনকে শুনিয়ে দেন দিলীপ ঘোষ। সংবর্ধনা এবং সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ার পরে শোভনকে নিয়ে একটি বৈঠকে ঢুকে যান রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ।
বিধায়কদের নিয়ে তিনি যে বৈঠকে বসবেন, সে কথা দিলীপ ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই জানিয়েছিলেন। তাই মিডিয়ার সঙ্গে আলাপচারিতা কিছুটা তড়িঘড়িই শেষও করে দেন তিনি। বাকি বিধায়করা আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলন শেষে শোভনকে নিয়ে সেই বৈঠকে ঢুকে যান দিলীপ ঘোষ এবং জয়প্রকাশ মজুমদার। বৈঠকে বৈশাখীকে ঢুকতে বারণ করেছিলেন দিলীপই। এবং দেবশ্রী রায়কে দলে স্বাগত জানাতে যে রাজ্য বিজেপি প্রস্তুত, সে কথাটাও দিলীপই শোভনকে বলেন বলে জানা গিয়েছে। পাশাপাশি, দেবশ্রীর বিষয়ে শোভন যেন আপত্তি না করেন, এই বার্তাও দিয়ে দেওয়া হয়।
তবে জানা গেছে শোভনের আপত্তিতেও আর আটকাবেন দেবশ্রীর যোগদান পর্ব। তাঁকে খুব তাড়াতাড়িই বিজেপিতে শামিল করা হবে এবং সেই যোগদানটা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতেই হবে— বিজেপির একটি অংশে গুঞ্জন এই রকমই। শুধু তাই নয়। খুব শীঘ্রই রাজ্য বিজেপির এক সহ-সভাপতির উপস্থিতিতে শোভন ও দেবশ্রীর বৈঠক হতে চলেছে বলেও জল্পনা জোরদার। অন্যদিকে, বৈশাখীর ঘনিষ্ঠ বৃত্ত সূত্রে খবর, সংবর্ধনা ঘিরে মঙ্গলবার যা ঘটেছে, তার প্রেক্ষিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, রাজনীতি থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে নেবেন নিজেকে। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি ত্যাগ না করলেও, তিনি যে ক্রমশই অন্তরালে চলে যাবেন, বুধবার বৈশাখী বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।