‘শুন গো ভারত ভূমি
কত নিদ্রা যাবে তুমি
উঠ ত্যাজ্য ঘুমঘোর
হইল হইল ভোর
দিনকর প্রাচীতে উদয় ।’ উৎপল দত্ত (টিনের তলোয়ার)
টিনের তলোয়ার হাতে এক মহান অভিনেতা। যিনি জাগিয়ে গেছেন ভারতকে। তাঁর নাটকের সংলাপে ঘুমন্ত চেতনা জেগে ওঠে। মনের সঙ্গে মনের, আত্মার সঙ্গে আত্মায় শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। মনে হয়, কেবল মনে হয়, আমরা যে পচা সমাজে বাস করছি, সেটা আমাদের নয়। আমাদের আরও উন্নত হতে হবে। দাঁড়াতে হবে উর্দ্ধগগনে মুখ তুলে।
উৎপল দত্ত (টিনের তলোয়ার)
টিনের তলোয়ার হাতে এক মহান অভিনেতা। যিনি জাগিয়ে গেছেন ভারতকে। তাঁর নাটকের সংলাপে ঘুমন্ত চেতনা জেগে ওঠে। মনের সঙ্গে মনের, আত্মার সঙ্গে আত্মায় শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। মনে হয়, কেবল মনে হয়, আমরা যে পচা সমাজে বাস করছি, সেটা আমাদের নয়। আমাদের আরও উন্নত হতে হবে। দাঁড়াতে হবে উর্দ্ধগগনে মুখ তুলে।
বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে যেমন ছিলেন অপরিহার্য, তেমনি তিনি ছিলেন মঞ্চের শক্তিমান অভিনেতা, নির্দেশক ও নাট্যকার। একটা সময় গেছে, যখন শক্তিশালী এ অভিনেতা শাসন করতেন বাংলা চলচ্চিত্রকে। যে মানুষটি হয়েছিলেন ‘হীরক রাজার দেশে’র রাজা, তিনিই আবার হলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়া। এমন কত বিখ্যাত চরিত্র তাঁর জীবনে—‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর মেঘরাজ, ‘আগন্তুক’-এর মনোমোহন মিত্র, ‘অমানুষ’-এর মহিম ঘোষাল, ‘জন অরণ্য’–এর বিশুদা—এমন কত চরিত্রেই না অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ‘হীরক রাজার দেশে’র তাঁর সংলাপগুলো রীতিমতো চর্চার বিষয় হয়ে গেছে।
অথচ এই মানুষটিই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যেকোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রোপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।’ শুধু কি তা-ই, পদ্মভূষণ উপাধি ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করার মতো ঘটনাও তাঁর জীবনে আছে।
রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী এবং মার্কসবাদী। আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাসে অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবে তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট। ১৯৭১ সালে ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক তাঁর একটি বড় পদক্ষেপ। উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটকের মধ্যে শ্রেনী চেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনার পরিশীলিত মিশেল তাঁকে অন্যভাবে চেনায়। এরই পাশাপাশি কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তাঁর পারদর্শিতা ছিল প্রশ্নাতীত। গুড্ডি, গোলমাল, শৌখিন প্রভৃতিতে তাঁর কৌতুকাভিনয় আজও মানুষকে আনন্দ দেয়। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিশ্লেষক উৎপল দত্তের কথায়, মানুষ সম্পর্কে তাঁর গভীরতম ধারণা তাঁর নাটকগুলোকে সফল করছে। উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁস সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণও স্মরণীয়। উনিশ শতকের বঙ্গীয় সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে মধুসূদনের বিদ্রোহকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মধুসূদন শেষ পর্যন্ত উনিশ শতকের ঘুণধরা বিকলাঙ্গ সমাজের বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ।‘ যাত্রাপালার নবজাগরণ আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সমান সক্রিয়।
বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন উৎপল দত্ত। তারমধ্যে ‘ঝড়’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘ইনকেলাব কি বাদ’, ‘ঘুম ভাঙার গান’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৩ সালে আজকের দিনে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। উৎপল দত্ত উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের এবং মঞ্চের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে। উৎপল দত্তের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিশ্বাসী সংলাপ জনগণের হৃদয়ে আজীবন ঢেউ তুলবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত