দেবব্রত বিশ্বাস বিখ্যাত গায়ক ছিলেন – এ কথা বলা বাহুল্য, প্রায় অর্থহীন। তিনি রবীন্দ্রনাথের শত শত গান গেয়েছিলেন এবং সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই জনপ্রিয়তা দান করেছিলেন – এটুকু বললেও তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট বলা হয় না। শিল্পী হিসেবে তাঁর স্বকীয়তা এবং বাংলা গানে তাঁর অবদান খুঁজতে গেলে আরও গভীরে ডুব দিতে হয়। কারণ বাংলা গানের ভিত্তিভূমি ধরেই তিনি নাড়া দিয়েছিলেন। সজ্ঞানে দিয়েছিলেন কিনা, সঠিক জানি না, কিন্তু দিয়েছিলেন।
বাংলা গানের সঙ্গে হিন্দুস্থানি সঙ্গীত অর্থাৎ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এ পার্থক্য বোঝানোর জন্যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হচ্ছি। তিনি হিন্দুস্থানি ধ্রুপদ ও খেয়ালের উল্লেখ করে বলেছেন যে, সেগুলোর বেশির ভাগই ‘কেবলমাত্র গান, একেবারেই কাব্য নহে। কথাকে সামান্য উপলক্ষ মাত্র করিয়া সুর শুনানোই হিন্দিগানের প্রধান উদ্দেশ্য।’ কিন্তু বাংলা গানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আদৌ সেরকম নয়। তাঁর মতে, ‘বাংলায় সুরের সাহায্য লইয়া কথায় ভাবে শ্রোতাদিগকে মুগ্ধ করাই কবির উদ্দেশ্য।’ এ কেবল তত্ত্বকথা নয়। তিনি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, ‘কবির গান, কীর্তন, রামপ্রসাদী গান, বাউলের গান প্রভৃতি দেখিলেই ইহার প্রমাণ হইবে।’ রবীন্দ্রনাথ এ কথা যখন (১৮৯২) লিখেছেন, তখনও পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়নি। নয়তো তাঁর দৃষ্টান্তের ফর্দে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, সারি গান, জারি গান ইত্যাদিও জুড়ে দিতে পারতেন।
তিনি লিখেছেন, “অতএব কাব্যরচনাই বাংলা গানের মুখ্য উদ্দেশ্য, সুরসংযোগ গৌণ।”
এখানে তিনি যা বলেছেন, তাকে তাঁর প্রথম দিকের চিন্তা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ তাঁর পরিণত বয়সেও তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, বাংলা গানে সুরের থেকে কথার প্রাধান্য বেশি। কিন্তু এ ধারণা তিনি কোথায় পেলেন? আমার বিশ্বাস, সতেরো/আঠারো বছর বয়সে তাঁর বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, গানে কথা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নাকি সুর – এ সম্পর্কে তাঁর চিন্তাকে উসকে দিয়েছিল। বিলেতে থাকাকালে তিনি যেসব ইংরেজি, আইরিশ এবং স্কটিশ গানের প্রেমে পড়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ফোক সং, এক কথায় যাকে বলা যেতে পারে কথাপ্রধান গান। অপেরার গানও তাঁর ভাল লেগেছিল। কিন্তু তাতে অভিনয়ের বদলে সুরের প্রাধান্য দেখে তিনি পিছিয়ে এসেছিলেন। দেশে ফিরে তাই তিনি বাল্মীকি-প্রতিভা রচনা করে তার মধ্যে দিয়ে অপেরার পরিবর্তে তাঁর নিজের আদর্শকে তুলে ধরেন। বাল্মীকি-প্রতিভায় সুর কথার অনুসারী, কথা সুরের অনুসারী নয়।
বস্তুত, বাংলা গানে কথার গুরুত্বের কথা তিনি কেবল বলেনইনি, নিজের গানে বারবার তার প্রমাণও দিয়েছেন। বয়স যত বৃদ্ধি পেয়েছে, তাঁর গানে সুর ততই সাদামাঠা হয়েছে, ততই বেড়েছে কথার প্রাধান্য। এক কথায়, তাঁর স্বল্পসংখ্যক গান বাদ দিলে বাকি গানগুলো কথাপ্রধান। এবং তাঁর মতে, কেবল তাঁর গানই নয়, সাধারণভাবে তাবৎ বাংলা গানই কথাপ্রধান। কথা বাংলা গানের প্রাণ; তার চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
উনিশ শতকের শুরুতে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলা গানের যেসব কথাপ্রধান ধারা প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে নিধুবাবু একটা ভিন্ন ধরনের ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি তাঁর গানে কথাকে গুরুত্ব দেননি। বরং তাকে গৌণ করে সুরকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি যে-শতাধিক গান রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে বহু গানই দু-তিন পঙ্ক্তির। তবে তিনি বাংলা গানে সাফল্যের সঙ্গে টপ্পা নামে একটা নতুন ঐশ্বর্যমণ্ডিত ধারার পত্তন করতে সমর্থ হলেও, বাংলা গানের চরিত্রকে তিনি বদলে দিতে পারেননি। কীর্তন, কবিগান, বাউল গান, রামপ্রসাদি গান ইত্যাদি যেমন ছিল, তেমনই থেকে যায়। তা ছাড়া, তিনি বিগত হওয়ার পর, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে ব্রহ্মসঙ্গীত এবং থিয়েটারের গানকে কেন্দ্র করে আমরা আবার কথাপ্রধান গানই পাই।
বিশেষ করে ১৮৮০-এর দিকে যখন এই কথাপ্রধান ধারার নেতৃত্ব দিতে তরুণ রবীন্দ্রনাথ মঞ্চে প্রবেশ করেন, সুর-সৈনিকরা তখন পালিয়ে বাঁচেন। বাংলা গান কথাপ্রধান গান হিসেবেই টিকে যায়। কেবল টিকে যায় বললে ভুল হবে, রাবীন্দ্রিক কাব্যগুণ তার অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হল। অতঃপর দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল ইসলামই কাব্যপ্রধান গান রচনা করলেন, তাই নয়, বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের গীতিকারেরাও একই আদর্শ অনুসরণ করেন। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত সলিল চৌধুরি, গৌরীপ্রসন্ন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ যেসব গান রচনা করেন, সেসব গান কাব্যিক গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে প্রমুখের কণ্ঠে এঁদের লেখা যেসব গান হিট গান হিসেবে পরিচিত হয়েছিল, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেসব গান সুরের থেকেও বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তাঁদের কথার জন্যে।
তাবৎ বাংলা গানের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত যে মনকে সবচেয়ে বেশি টানে, তার কারণ তাঁর মতো কাব্যিক গান বাংলা ভাষায় আর কেউ লেখেননি। তাই সুরের বিচারে তুলনামূলকভাবে হালকা হলেও, কথার জোরে এ গান সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় (তাঁর গানের আর-একটা আকর্ষণ ঈশ্বরের প্রতি তাঁর আন্তরিক নিবেদন)।
যে-গানে কথাই গুরুত্বপূর্ণ, সে গানে তাই শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করতে হবে কথা দিয়েই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বেশির ভাগ গায়ক-গায়িকারা কথার অর্থকে ফুটিয়ে তোলেন না। ইচ্ছে করে তোলেন না, এমন নয়। আসলে পুরোটা গানের অথবা গানের পদগুলোর অর্থ সম্পর্কে অনেক গায়ক-গায়িকা আদৌ সচেতন নন। মনে হয় না, এই শিল্পীরা গানের কথাগুলো সম্পর্কেও খুব যত্নবান – এমনকী, উচ্চারণ সম্পর্কেও। এর ফলে সুর থাকলেও গানের কথাগুলো মারা পড়ে।
মৃত্যুর এত বছর পরে আজও দেবব্রত বিশ্বাস খুব জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁর গান সম্পর্কে কথা উঠলে, অনেকে নাক কুঞ্চিত করেন – যেন জনপ্রিয়তা গানকে সস্তা করে দেয়।
আমরা সচরাচর যে কথা বলি, সে কথার অর্থ প্রকাশ করি কী করে? এর উত্তরে বলতে হয়, কথার অর্থ সব সময়ে সুনির্দিষ্ট নয় – অনেক কথারই একাধিক অর্থ আছে। ‘আমি যাব।’ ‘আমি যাব?’ ‘আমি যাব!’ এই তিনটে বাক্যই আমি এবং যাব – এই দুটো শব্দ দিয়ে গঠিত। কিন্তু তিনটে বাক্যের অর্থ আলাদা। কেবল তিনটে নয়, সত্যি বলতে কী, বলার ভঙ্গি দিয়ে ‘আমি যাব’ কথাটার হয়তো এক ডজন অথবা তার থেকেও বেশি অর্থ করা যাবে। তদুপরি, একটা কথার শুধু সরাসরি অর্থ নয়, সেই সঙ্গে থাকে তার ভাব, গূঢ় অর্থ, ব্যঞ্জনা। বলার ভঙ্গি এবং প্রসঙ্গ দিয়েও একটা কথার বিশেষ অর্থ বোঝা যায়। একজন গায়ক কোনও একটা গানের কথাগুলোর যে-অর্থ বুঝতে পেরেছেন, সেই অর্থ, গূঢ় অর্থ, ভাব এবং ব্যঞ্জনা প্রকাশ করেন কী কৌশলে? সে কি কেবল কথাগুলো সুর সহযোগে আবৃত্তি করে গেলেই সম্ভব? মোটেই সম্ভব নয়।
অর্থ প্রকাশ করা যায় নানা উপায়ে। তার মধ্যে একটা প্রধান কৌশল হল ছোট–বড় নানা দৈর্ঘ্যের বিরতি, ইংরেজিতে যাকে বলে পজ। অর্থ-যতি ছাড়া বাক্যের অর্থ হয় না, সঠিক অর্থ তো নয়ই। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে – ‘প্রেম এসেছিলো নিঃশব্দ চরণে।’ তার একটা জায়গায় আছে – ‘সে তখন স্বপ্ন, কায়াবিহীন নিশীথ তিমিরে বিলীন।’ আমি পাঁচজন নাম-করা গায়কের রেকর্ড থেকে এই জায়গাটা তাঁরা কেমন করে গেয়েছেন, তা পরীক্ষা করে দেখেছিলেন প্রাবন্ধিক ও জীবনিকার গোলাম মুরশিদ। তিনি লক্ষ্য করেন, দেবব্রত বিশ্বাস ছাড়া কেউই ‘স্বপ্ন’ কথাটার পরে কোনও বিরতি দেননি। ফলে অর্থ দাঁড়িয়েছে: ‘সে তখন স্বপ্নকায়াবিহীন।’ অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, প্রেমটা তখন কায়াবিহীন স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। পূর্বোক্ত পাঁচজন শিল্পীর মধ্যে দেবব্রত বিশ্বাসই এই অর্থ করেছিলেন। তাঁর গাওয়া গানে কোথাও যতি-বিভ্রাট লক্ষ্য করা যায় না। তার কারণ তিনি প্রতিটা গানের সঠিক অর্থ ধরতে চেষ্টা করতেন এবং তিনি যে-অর্থ বুঝেছেন, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেটিই প্রকাশ করেছেন। নিন্দুক যে বলেছেন ‘ট্রান্সলেশন’, আসলে তা ট্রান্সলেশন নয় মোটেই, তা হল যথার্থ ইন্টারপ্রেটেশন।
অর্থের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে ভাব। পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করতে হলে তাই ভাবও প্রকাশ করা প্রয়োজন। কিন্তু কজন ‘যূথীবনের দীর্ঘশ্বাসে’ কথাটার সঙ্গে যে-ভাবটি মিশে আছে, সেটি সঠিকভাবে প্রকাশ করেন, অথবা করতে পারেন? দেবব্রত সর্বত্র পেরেছেন কিনা জানি না, কিন্তু তিনি যখন গেয়েছেন, ‘ভাঙলো হাসির বাঁধ ওই ভাঙলো’, ততবারই ‘হাসি’ শব্দটি শুনে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, তিনি প্রতিবারই অভিনয় করে হাসির ভাবটি শ্রোতাদের মনে সঞ্চারিত করেছেন। বা তিনি যখন গেয়েছেন ‘হা হা হা হা! বালকের দল’ (চিত্রাঙ্গদা), তখন কেবল ‘হা হা হা হা’ গাইবার সময় সত্যি সত্যি হাসি ফুটিয়ে তোলেননি, বরং সেই সঙ্গে বালক দলের প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাবও ফুটিয়ে তুলেছেন।
বস্তুত, গানের ভাব প্রকাশের জন্যে সুরকার যেমন সপ্তস্বর (কড়ি ও কোমল ভেদে বারোটি স্বর) ব্যবহার করেন, তেমনি ব্যবহার করেন অন্যান্য সাঙ্গীতিক হাতিয়ার (টুল) – যেমন, বিভিন্ন ধরনের তান, মিড়, গমক, তাল, লয় ইত্যাদি। কিন্তু এতগুলো কৌশল ব্যবহার করা সত্ত্বেও গায়কের কণ্ঠে গানের সত্যিকার ভাবটি প্রকাশ নাও পেতে পারে, বরং গানটাকে শোনাতে পারে প্রাণহীন।
যাতে প্রাণহীন না-শোনায়, তার জন্যে গায়ককে অবশ্যই ব্যবহার করতে হয় যথাযথ প্রকাশ-ভঙ্গি। সেই প্রকাশ-ভঙ্গির মাধ্যমেই গানের প্রাণহীন কথাগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়, গানের অর্থ এবং ভাব যথাযথভাবে ফুটে ওঠে। বহু গায়ক-গায়িকা আছেন, যাঁরা গানে সঠিক প্রকাশ-ভঙ্গি প্রয়োগ করেন না, এমনকী, সে সম্পর্কে সচেতনও থাকেন না। ফলে তাঁদের গানকে মনে হয় স্বরলিপি আবৃত্তি করার মতো। অপরপক্ষে, দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর প্রতিটি গানে যথাযথ প্রকাশ-ভঙ্গি প্রয়োগ করতেন। কিন্তু সবাই এই প্রকাশ-ভঙ্গির প্রশংসা করতে পারেননি। যেমন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধতা রক্ষা করার দায়িত্বে নিয়োজিত বিশ্বভারতীর সঙ্গীত পর্ষদের সদস্যরা তাঁর কণ্ঠে ‘মেঘ বলেছে যাব, যাব’ শুনে চমকে উঠেছিলেন। তাঁরা তাঁর প্রকাশ-ভঙ্গিকে অতিনাটকীয় বলে সমালোচনা করেন এবং অনুমোদন না-দিয়েই গানটি রেকর্ড কোম্পানির কাছে ফেরত পাঠান।
রবীন্দ্রনাথ একাধিক জায়গায় লিখেছেন যে, তাল হল ভাব প্রকাশের একটা অন্তরায়। তাল যেমন সুরকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি গানের ভাবকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। বাল্মীকি-প্রতিভার দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেছেন যে, এই গীতিনাট্য রচনাকালে জ্যোতিদাদাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মাত্রাগুলোকে কখনও চটুল, কখনও বা মন্থর করেছেন – ইউরোপীয় সঙ্গীতের মতো। তিনি সেই সঙ্গে এ-ও উল্লেখ করেছেন যে, একই তালের মধ্যে মাত্রাগুলোকে সময়ের মাপে কখনও লম্বা অথবা কখনও খাটো করা, এবং তাদের লয়ে হেরফের করা ভারতীয় সঙ্গীতে চলে না। কিন্তু গানের ভাব প্রকাশে তার প্রয়োজন হয় বইকি! গানের গমন-ভঙ্গিতে এই স্বাধীনতা বাঞ্ছনীয় বলে রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত দিয়েছেন। বাল্মীকি-প্রতিভায় তিনি সাফল্যের সঙ্গে এই পরীক্ষা করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের এ কথা পড়ার পর দেবব্রত বিশ্বাস তালের প্রতিটি অঙ্গ অথবা পর্বের অন্তর্গত মাত্রাগুলোতে এই ফ্লুইডিটি বা তারল্য নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা আরম্ভ করেছিলেন কিনা, তিনি কোথাও লেখেননি। কিন্তু একটা অঙ্গে অথবা পর্বে যে-মাত্রা কয়টি থাকে, তিনি তার মধ্যে একটা তরলতা অথবা প্রবহমানতা এনেছিলেন। ফলে এক অঙ্গ/পর্বের, ধরা যাক, চার মাত্রায় যে-কথাগুলো আছে, তাদের একেবারে সমান সমান (১+১+১+১) বিভাজন করেননি, বরং সেই কথাগুলোকে কোথাও টেনে লম্বা করেছেন, অথবা ঠেসে খাটো করেছেন (যেমন, দেড়+আধ+দেড়+আধ = চার মাত্রা)। এ রকম বিন্যাসে তিনি অবশ্য শেষ পর্যন্ত চার মাত্রার হিসেব ঠিক রেখেছেন।
স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার সময়ে অথবা অভিনয় করার সময়ে মানুষ প্রতিটি ধ্বনি অথবা প্রতিটি সিলাবল সমান মাপে উচ্চারণ করে না। বরং ভাব এবং অর্থ অনুযায়ী একটা বাক্যের বা বাক্যাংশের কতগুলো ধ্বনিকে দ্রুত গতিতে, কতগুলোকে ধীরগতিতে উচ্চারণ করে। যেমন, আ মি কি- এ- ক থা- ক খ ন ও- ব লে- ছি-? – এই বাক্যাংশের ধ্বনি কয়টি অর্থ অনুযায়ী সময়ের মাপে নানা রকমের বিন্যাসে উচ্চারণ করা যেতে পারে। কিন্তু অর্থ যাই করতে চাই না কেন ‘আ মি কি ক খ ন ও ব লে ছি’ অক্ষর (সিলাবল) গুলোকে সমান সমান মাত্রায় উচ্চারণ করব না। কারণ তা হলে সেটা হাস্যরসের খোরাক হবে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় ছন্দ নিয়ে এবং গানে তাল নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছেন। এমনকী, নতুন নতুন ছন্দ এবং তাল তৈরিও করছেন। বিশেষ করে তাঁর নিজের কবিতার ছন্দের সঙ্গে মিল রেখে নতুন তাল উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু তালের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালবাসা ছিল না। তিনি যদি পারতেন, তা হলে তাঁর বহু গান তিনি ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’র মতো তাল-ছাড়া অথবা ‘তাল-ভাঙা তালে’ গাইতেন। তাতে সে গানের ভাব শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তার অর্থ বোঝা সহজ হত। কিন্তু তিনি সাহসী হলেও, ভারতীয় সঙ্গীতের মূল রীতি অথবা নিয়মকে ভাঙার মতো অ্যাডভেঞ্চার করতে সাহস পাননি। তবে, আমার ধারণা, তিনি সাহস পেলে তাঁর পরীক্ষা হয়তো সফলই হত, মিসঅ্যাডভেঞ্চার হত না। দেবব্রত বিশ্বাসের সবচেয়ে সাহসী পরীক্ষা–নিরীক্ষা এই মাত্রা-বিন্যাসে। শিল্পী হিসেবে বাংলা গানে একমাত্র তিনিই এই পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছিলেন। তাঁর সমালোচকরাও এটার নিন্দাতেই সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ।
বাংলা গানে তিনি আর-একটা অবদান রেখেছিলেন তাঁর কণ্ঠ দিয়ে। তবে সে কৃতিত্ব তাঁর একার নয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অন্তত আরও দুজন শিল্পী – পঙ্কজ মল্লিক আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, (সম্ভবত সায়গলও)। তাঁদের আগে পর্যন্ত বাংলা গানে হালকা গলাকেই গানের গলা বলে বিবেচনা করা হত। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, নজরুল, দিনেন্দ্রনাথ প্রমুখের গলা শুনলেই আমার কথার যথার্থতা বোঝা যাবে। ১৯২০ এবং ’৩০-এর দশকে গাওয়া যেসব শিল্পীর রেকর্ড পাওয়া যায়, তাঁদের সম্পর্কেও এ মন্তব্য প্রযোজ্য। কিন্তু তুলনামূলকভাবে ভারী গলার প্রবর্তন করলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁর কয়েক বছর পরে আসরে নামলেন পঙ্কজ মল্লিক আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁদের পর-পরই দেবব্রত বিশ্বাস। এঁরা তিনজন ছিলেন সত্যিকার ডিপ ভয়েস অথবা ভারী গলার অধিকারী। এঁরা তিনজন মিলে মোটা গলাকে কেবল গ্রহণযোগ্য করলেন না, বরং গানের গলা হিসেবে হালকা গলাকে অচল করে দিলেন এবং ভারী গলাকেই গানের জন্যে স্ট্যান্ডার্ড গলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দেবব্রত বিশ্বাস মারা গেছেন ৩৮ বছর আগে, কিন্তু তাঁর গলা, তাঁর গাইবার ভঙ্গি, তাঁর প্রকাশ-ভঙ্গি, সঠিক ও স্পষ্ট উচ্চারণ এবং গলার কুশলী ও বিচিত্র ব্যবহার তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ করছেন ঋত্বিক।
পরিচিত মহলে বলছেন, ‘‘ছবিতে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকবে। এবং জর্জদাই গাইবেন।’’
ঘনিষ্ঠরা জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কোন গান ঋত্বিকদা?’’
ঘটকবাবু তো নিজেই জানেন না, উত্তর দেবেন কী!
দিন এল রেকর্ডিংয়ের। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োর স্কোরিং থিয়েটারে জর্জ এলেন। মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। সাদা পাজামা। কাঁধে ঝোলা, মুখে পান। বাঁ দিকে হেলানো মাথা। চশমার ফ্রেমের ভিতর, গহন চাহনিতে, অদ্ভুত এক মায়ারং-আলো খেলা করে যেন প্রতিক্ষণ।
ফ্লোরে ঢুকেই ঋত্বিকের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘‘দ্যাখ ভবা, আমরা ঠিক আইস্যা পড়ছি।’’
ঋত্বিক বললেন, ‘‘সব কিছু রেডি আছে জর্জদা। একবার শোনালেই, ফাইনাল টেক হবে।’’
বিধি বাম। হঠাৎ জর্জ বললেন, ‘‘আমি তো বাবা তোরে আগেই কইসি, গলা খারাপ। আমি গামু না!’’
সে কী! কে গাইবে এ গান?
বুঝি চৌচির স্বপ্ন-সংকল্প!
জর্জের গলার ওই বিস্তার, মন্দ্র সপ্তকে স্থিতি-গাম্ভীর্য? দিল খোলা মর্জি-গায়ন?
‘‘না। আমি তো তোরে আগেই কইসি। এ বার আমারে ছাইড়া দে। আমার ছাত্র সুশীল গাইব!’’
বার বার অনুরোধ ঋত্বিকের। জর্জ শুনছেন না কিছুতেই। শেষে, ঋত্বিকের প্রায় কাকুতি মিনতি—
‘‘প্লিজ জর্জদা, প্লিজ এটা করবেন না। এ গান, ছবির যে সিচুয়েশন, আপনি না গাইলে হবে না! প্লিজ!’’
জর্জ তবুও অনড়। মেঝের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে তাঁর নির্লিপ্ত ভঙ্গি।
সে দিন স্টুডিয়োতে ছিলেন তুষার তালুকদার। পরে যিনি পুলিশ কমিশনার হবেন। ‘উন্মুক্ত ব্রাত্যজন’ তথ্যচিত্রে তাঁর সে দিনের স্মৃতি—
‘‘ঋত্বিকদা কারও কাছে কাকুতি মিনতি করার লোক নন। বরং ওনার মর্জি মতো ব্যাপারটা না ঘটলে, ভীষণ রেগে গিয়ে এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন, সেটা না বলা ভাল। কিন্তু, এই ব্যতিক্রম দেখলাম জর্জদার ক্ষেত্রে। এবং সেটা জর্জদার ক্ষেত্রেই সম্ভব। আলটিমেটলি একটা সমঝোতা হল যে, গানটা শুরু করবেন জর্জদা। ফলো করবেন সুশীল।’’
রেকর্ডিং হল। জর্জ গাইলেন। সঙ্গে তাঁর ছাত্র সুশীল মল্লিক। রবীন্দ্রনাথের পঁচিশ বছর বয়সে লেখা গান। কাফি রাগে। ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’। ছবিতে অভিমানী জর্জের গায়ন আর এলোমেলো যাপনের ঋত্বিকের ক্লোজআপ ফ্রেম মিলেমিশে হল একাকার।
বাকিটা সেলুলয়েডের কিংবদন্তি।
শ্রাবণ মেঘের আড়ালে ঢাকছে জর্জের ‘কইলকাত্তা’।
কালো হয়ে আসছে আকাশ। কালো?
মেঘ নামছে গঙ্গার জলের উপরে। গড়ের মাঠে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের নিভৃত গলিটার মাথায়।
এক সময় মেঘদূত মহল্লার হাওয়ার গায়ে ভেসে এল যেন ধৈবত বর্জিত রাগের বন্দিশ। ‘রিমি ঝিমি রিমি ঝিমি বুঁদন বরখে, তাসোই/ সোহাবন মন ভাবন শাবনকি ঋতু মোরে সজনুবাঁ’। মল্লারের খেয়ালে অনতিপর এল বৃষ্টি। ‘ঝিমুর ঝামর, আকাশ চেরা’ জলঝারিতে ভিজছে শহর।
মেঘমেদুর বাদলের দিন মানেই জর্জ বড় একটা ছাতা নিয়ে ভাগ্নিদের ডেকে বসবেন গলির মুখে।
রবিঠাকুরের বর্ষার গান যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়! ছাতার আড়ালে ভিজতে ভিজতে লিরিকের রেশ রেখে গেয়ে চলেন, ‘শ্রাবণ মেঘে আধেক দুয়ার খোলা’, ‘বহু যুগের ওপার হতে’, ‘আবার এসেছে আষাঢ়’। মেঘের পাখোয়াজ শুনতে শুনতে বিরতিবিহীন কোনও কোনও দিন বা শোনা যায়, ‘এ কী গভীর বাণী এল’, ‘নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জছায়ায়’ ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া’।
সে সব কথা এখনও তাঁর স্বজনের স্মৃতির মণিকোঠায়।
১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ঘরটিই ছিল জর্জ বিশ্বাসের সাম্রাজ্য।
ভেজানো কাঠের দরজা। ও পারে ছোট্ট গলি। গেট খুলে বারান্দা। ঘরের ভিতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছোপধরা পিকদান। অগোছালো বিছানায় ডাঁই করে রাখা গানের খাতা। ক্যাসেট, হটব্যাগ, মারফি রেডিয়ো। ছোট্ট টিভি। ইনহেলার। কাঠের সেল্ফ। সেল্ফে স্বরবিতান।
কাউকে হাত দিতে দিতেন না। সব হাতের কাছে রাখতেন। তার পর যখন অসুস্থ হলেন, ডাক্তারের কথায় ঘরের ভিতরে জানালার জাল কেটে ফেলা হল। সারাক্ষণ ইজিচেয়ারে। সেখানেই ঘুমোতেন। ঘুম? শ্বাসকষ্টের জন্য ঘুমোননি কত কাল!
সামনেই টুলের উপর রাখা হারমোনিয়ম।
এ ঘরেই গান শেখাতেন জর্জ।
তাঁর ভাগ্নি পারমিতার কথায়,
“রবিবার হলেই রাসবিহারী।
মামার কাছে গান শিখতে যেতাম। দোতলা বাড়ি। মামা থাকত নীচের তলায়। প্রথম দিকে মা-বাবা নিয়ে যেতেন। পরে একাই যেতাম।
গান করতে বসতাম যখন, মামা বলত, ‘‘আগে গানটা পড়েন।’’ সবাইকে আপনি-আজ্ঞে করত তো! বলত, ‘‘আপনারা এত খাওয়াদাওয়া করেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না কেন?’’
নিজে গেয়ে, তার পর সবাইকে গাইতে বলত। গান করতে করতে বই দেখা পচ্ছন্দ করত না। বলত, ‘‘আগেই চক্ষু খুইলা দ্যাখেন কী লেখা আছে।’’
খুব ভালবাসত রান্না করতে আর খাওয়াতে। পাবদা মাছ, তেল-কই, মাংস, তরকা…। দারুণ করত মুরগির রোস্ট। বাড়িতে কেউ এলেও মামাই রান্না করে খাওয়াত। মিষ্টি খেত খুব। চায়ে অনেক চিনি। আর রাতে যাদবের সন্দেশ মেখে ভাত।
কখনও আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যেত ওর নিজের টিউশানিতে। বাইকে করে।
কালো অ্যাম্বাসাডার কিনল পরে। বাইক চালাত জোরে। বসে থাকা যেত না। কিন্তু চার চাকার গাড়ি ড্রাইভ করত খুব আস্তে।
মামা চাইত গান শিখি। কিন্তু কোনও দিন চায়নি আমি শান্তিনিকেতনের কোনও অনুষ্ঠানে গান করি। প্রথম দিন নিয়ে গিয়েছিল বিশ্বভারতীতে। আমার ইচ্ছে ছিল, অ্যাকাডেমিক লাইন ছাড়া কিছু করব না। ওর ইচ্ছে ছিল গানটাও যেন শিখি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতীতে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর, গানের চর্চাও শুরু হল সঙ্গীতভবনে। তখন বিকেলে ক্লাস হত। আমাদের গান শেখাতেন নীলিমা সেন, বীরেনদা।
খুব মনে পড়ে আমার ভর্তির জন্য মোহরদিকে চিঠি লিখেছিল মামা। যখন ইন্টারভিউ দিই, মোহরদি ছিলেন। সিলেক্ট হয়ে যখন প্রণাম করলাম ওঁকে, বললেন, ‘‘খুব ভাল গেয়েছিস। জর্জদা চিঠিতে এত কথা লিখল, কিন্তু তুই যে এত ভাল গান করিস, সেটা লিখল না! ‘আমার ভাগ্নিটা গেল, দেখবেন যেন’। দাঁড়া, জর্জদাকে আমি লিখব।’’
বাদল দিনের এক সকালে ছাত্র অর্ঘ্য সেন এলেন গানের ক্লাসে।
মুখে পান নিয়ে তখন মন্দ্র সপ্তকে সুর ভাঁজছেন জর্জ। একটু পরে ফের চুন নিলেন জিভে। তার পর হারমোনিয়মের বেলোতেই মুছে দিলেন চুনের হাত। কখনও লুঙ্গিতেও মুছতেন। শুরু করলেন গান। বাইরে তখন আকাশভাঙা শ্রাবণ।
অর্ঘ্য কী শিখলেন প্রথম দিন? ‘কখন বাদল ছোঁয়া লেগে’।
একদিন জর্জকে সাহস করে প্রশ্ন করে বসলেন অর্ঘ্য, ‘‘জর্জদা, রেসের মাঠে যান কেন?’’
জর্জের জবাব, ‘‘তুমি বিয়া করো নাই কেন? তুমি যেমন বিয়া করো নাই, আমি তেমনই রেসের মাঠে যাই। এটা আমার চয়েস।’’
কখনও সখনও এই ঘরেই ঢুকে পড়তেন গীতা ঘটক। জর্জ তখন অন্য ছাত্রছাত্রী চলে যেতে বলেন। গীতা সবটুকু দিয়ে গান, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। এক সময় গলির প্রান্তে ছোট্ট বাড়িটায় সুরের সঙ্গ-সুধা-রেশ রেখে চলে যান গীতা।
জর্জ মজা করে তাঁর পরিচারকদের বলেন, ‘‘ম্যামসাহেবের সবই ভাল, শুধু গানটা পিছন ফিরা করলেই পারেন।’’
এ বাড়িতেই গান শিখতে আসেন আরতি, ইন্দ্রাণী, পূরবীরাও। রবিবার রবিবার ভাগ্নি পারমিতাও।
একদিনের কথা। গান শেখাতে শেখাতে বেশ রাত। সে দিন শ্রীলা সেন এসেছেন।
এত রাতে কোনও ছাত্রীকে একলা যেতে দিতেন না, মোটরবাইকে উঠিয়ে জর্জ চললেন তাঁকে বাড়ি ছাড়তে।
উড়ো হাওয়ার বাঁকে বললেন, ‘‘ভয় পাইবা না তো?’’
শ্রীলা বললেন, ‘‘উঁহু।’’
‘‘আমি জোরে চালামু।’’
জর্জের কথার ঝোঁকে যেন তেপান্তরের উড়ান। মজা লাগল শ্রীলার। একটু ভয়ও!
রাতের হাওয়ায় ঠিক শোনা যাচ্ছিল না। জর্জ ঘাড় ঘুরিয়ে বলছিলেন, ‘‘কী মনে হয় পক্ষীরাজে চড়স?’’
এক চিলতে এই ঘরের ইজিচেয়ারে শুয়ে, অভিমানী বাউল জর্জ কেবলই স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান। মাঝে মাঝে সব অর্থহীন মনে হয়। গোপনে কান্নার গায়ে যেন রক্তের ছিটে রং দেখেন।
দিন দিন শ্বাসের টান যেন বাড়ছে। রাতভর জেগে কাটে জর্জের। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে মাথার নীচে হাত দুটো রাখলে ইদানীং একটু আরাম হয়। কেউ গেলে, মোড়া দেখিয়ে বসতে বলেন। কথা বলেন খুব আস্তে। চলে যাওয়ার কথা।
এই অবেলায় পৌঁছে, তাঁর উদাস মন উড়ে যায় কাঁটাতারের ও পারে কিশোরগঞ্জে, কলকাতার প্রথম জীবনে। মনে পড়ে অকালে চলে যাওয়া ভাগ্নে খোকনকে। দুই পরিচারক শ্রীকান্ত আর অনন্তর আড়ালে, নিভৃতে চোখের পাতা ভিজে যায়।
জানালা দিয়ে যেন দেখেন গগনতলে দেশের বাড়ির ছবি। কানে বাজে বাবা দেবেন্দ্রকিশোর, মা অবলার গলা। ‘খোকা, খোকা!’
স্মৃতির ছবিতে এলোমেলো হয়ে ভেসে ওঠে বাড়িটা। বাঁশ-বাতার গেট। গেটের পাশে বকুল গাছ। দুব্বো ঘাসের উঠোন পেরিয়ে টানা বারান্দা, টিনের চাল। সামনে বাগান। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে জর্জের হাত ধরে যে-বাগানে ভিজতে ছুটত বোন ললিতা। কখনও দিদি সান্ত্বনা।
কত স্মৃতি। কত গান। প্রিয়-মানুষের স্মৃতি-তোড়ের ভাসান।
এমন বাদলের দিনে, জর্জের গানে উতলা হয়ে ভিজে উঠতেন মঞ্জুশ্রীও। কলকাতা জানে।
দু’জনের দেখা হল সেই ’৫২ সালে। মঞ্জুশ্রী চাকী তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী। এলিট সিনেমা হলের অনুষ্ঠানে জর্জ প্রথম দেখলেন তাঁকে। জর্জ গাইলেন ‘নৃত্যের তালে তালে’। শাড়িটাকে একটু তুলে, গাছকোমর করে পরলেন মঞ্জুশ্রী। নাচলেন, নিয়ম ভাঙার নাচ। প্রথম আলাপে যেন, ‘আগুন ছড়াল শুকনো খড়ে’।
মঞ্জুশ্রীর যাতায়াত বাড়ল জর্জের বাড়িতে। খোকন রেগে যেতেন, কিন্তু মঞ্জুশ্রী এলে জর্জ যেন আশ্চর্য এক উন্মাদনা টের পান। পঞ্চাশের দশকে কলকাতা শহরে একের পর এক অনুষ্ঠানে দেখা যেতে লাগল পাশাপাশি দুটো নাম। জর্জের গান আর মঞ্জুশ্রীর নৃত্য। একসঙ্গে নাম ঘোষণা হলেই, অফুরান করতালি। বাঁধ ভাঙা গান আর ঢেউয়ের নাচে একে একে কোরিওগ্রাফি হল, ‘ও চাঁদ তোমায় দোলা দেবে কে’, ‘ঝরঝর বারিধারা’।
বছর তিনেক বাদে জর্জ সমুদ্র কিনারে গেলেন মঞ্জুশ্রীর পরিবারের সঙ্গে। উঠলেন পুরীর স্বর্গদ্বারের একটি বাড়িতে।
জোর গুজব রটল কলকাতার পথের হাওয়ায়। মোটরবাইকে করে শহর চষে ফেলছেন মঞ্জুশ্রী-জর্জ। দু’জনকে নাকি দেখা যাচ্ছে অনুষ্ঠানের শেষে গঙ্গার ধারে, প্রেসিডেন্সি চত্বরে, জর্জের রাসবিহারীর ঘরে! অফিস পাড়া থেকে লেক কালীবাড়ি। তখন গসিপ আর গসিপ।
সে গসিপের ছায়া ঠিক যেন দেবব্রত বিশ্বাসের নিকটাত্মীয় বাসব দাশগুপ্তর উপন্যাস ‘জর্জ’-এও।
সেখানে ‘মধুশ্রী’ নামের ‘লম্বা, দোহারা চেহারা, ঈষৎ চাপা বর্ণ, আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘ চুল, কথা বলা চোখ’-এর মেয়েটি পরপর কয়েক দিন জর্জের কাছে না এলে, তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।— ‘‘ফোন করতে মন চায়, উপায় নেই ওর স্বামী নাকি আজকাল ঠারেঠোরে নানা কথা শোনায় ওকে। বলে কিসের এত রোজ রোজ একজনের বাড়ি যাওয়া? বাংলাদেশে আর কি কোনও গায়ক নেই? আসলে মধুশ্রীর নৃত্যভঙ্গি আর জর্জের গান এমন একটা আত্মিক বোধে যুক্ত হয় যে, সমস্ত শ্রোতা-দর্শকেরা ওদের যৌথ পরিবেশনায় প্রচণ্ড আনন্দ পায়।’’
বাইরের উড়ো কথা ঘরে এসে ঢোকে।
জর্জকে তাঁর দিদি-বোন-মা জিজ্ঞেস করেন মঞ্জুশ্রীর কথা।
জর্জ রসিকতা করে উড়িয়ে দেন। বলেন, ‘‘চিন্তার কোনও কারণ নাই।’’
বিয়ে হয়ে যায় মঞ্জুশ্রীর।
বিয়ের কিছু দিন পর বিদেশে চলে গেলেন। তার পরও…। যখনই কলকাতায় এসেছেন, দু’জনে অনুষ্ঠান করেছেন।
পরে, অনেক পরে মঞ্জুশ্রী নিজেও খুব কাছের জনদের বলেছিলেন সেই-সব রটনার দিন-রাত্রির কথা।
মেয়ে হওয়ার খবরে ’৬৩-র মার্চে জর্জ তাঁকে চিঠি লিখছেন, ‘‘তোমার মা হওয়ার খবর শ্রীকান্তের মুখে আমি পেয়েছিলাম। … আমার সাড়াশব্দ নেই কারণ আমি নিজেই নেই— যদি দেশে ফেরো, আমায় চিনতে তোমার খুব অসুবিধে হবে— হয়তো পারবে না। বেলা আমার ফুরিয়েছে— তাই খেলাও শেষ।’’
দেশে ফিরে আমৃত্যু মঞ্জুশ্রী জর্জের গানকে আশ্রয় করে বেঁচে ছিলেন। মঞ্জুশ্রীর মেয়ে রঞ্জাবতীও প্রেমে পড়ে জর্জের গানের।
জর্জকে ভোলেনি রঞ্জাও!
নিয়ত ভাঙন-প্রত্যাখ্যান সরিয়ে, রবিঠাকুরের গানই ছিল জর্জের নিজস্ব নিখিল। এই মানুষই কঠোর হয়ে যেতেন, মর্জির বিরুদ্ধে তাঁকে হাঁটতে বাধ্য করলে। সে সুরের সারিন্দা হোক বা, রাজনীতির পথ।
শরিক ছিলেন উত্তাল সময়ের। দু’বার ঘুরে এলেন লাল-চীন। ’৩৮ থেকে সেই সখ্য রইল ’৫৪ পর্যন্ত। কিন্তু কখনও পার্টির সভ্য হননি। মাঠে-বন্দরে গেয়ে বেড়াতেন গণসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের গানও গাইতেন লাল মঞ্চে বসে।
অশোক মিত্রের কথায়, জর্জ বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানে যে-আগুন, তাতে সাধারণের অধিকার আছে। অচলায়তনকে তিনি ভেঙে চূর্ণ করতে পারবেন। তাঁর রোখ চেপে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গান জর্জের গলায় হয়ে উঠল গণসঙ্গীত।
সে সময় কালিকা সিনেমা হলে ‘রক্তকরবী’ হল। পরিচালনা জর্জেরই।
বিশুপাগল চরিত্রে অভিনয় করলেন জর্জ। ’৪৭-এর শেষের দিকে শ্রীরঙ্গমেও অভিনয় হল রক্তকরবী। সেখানেও জর্জ ‘বিশু’। নেপথ্য থেকে রাজা-র ভূমিকাটি পড়লেন শম্ভু মিত্র। নন্দিনী- কণিকা মজুমদার, চন্দ্রা-তৃপ্তি মিত্র, সর্দার- কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। বহুরূপী যখন ‘ছেঁড়াতার’ করছে, জর্জ হলেন মহিম। সে-নাটকে উইংসের আড়ালে এস্রাজ বাজাতেন তুলসী লাহিড়ি। অভিনয় করতে করতে গান গাইতেন জর্জ।
ষাটের দশক থেকে জর্জ গণসঙ্গীত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন!
পার্টির ভাঙন কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি কোনও দিন। নির্ঘুম রাত জুড়ে যেন খানিকটা হতাশাও জমছিল তখন। ফ্রন্ট যে বার ভেঙে গেল, পার্টির দুঃসময়ে কষ্ট পেয়েছেন একা একা ঘরে বসে। বাসবের ‘জর্জ’ উপন্যাসে সেই সব দিনের কথা উঠে আসে অবিকল শব্দ-ছবিতে।
পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বসবেন বলে, একদিন সন্ধের তাসের আড্ডা বাতিল করে ঘরে ডাকলেন বিজন, ঋত্বিকদের।
‘‘সময় সন্ধে ছ’টা হলেও ঋত্বিক হাজির দুপুর তিনটেয়। তিন-চার কাপ চা হয়ে গেছে। অস্থির পায়চারি, মাথার চুল মুঠো করে ধরা। একবার এই মোড়াতে বসছে, পরক্ষণে ওইটায়।
‘স্থির হইয়া বস না।’ জর্জের কথায় কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।
‘সবাই আসবে তো?’
জর্জ উত্তর দিল, ‘খবর পাইছে হক্কলে, আইবে কিনা কইতে পারি না।’ তীব্র বেগে মাথা ঝাঁকিয়ে ঋত্বিক বলে, ‘সেইটাই প্রধান সমস্যা। বুঝলা, কেউ কারও মনের ভিতরটা জানে না।’’’
ঋত্বিক আর বেশিক্ষণ ঘরের ভিতর থাকতে পারেন না। অস্থির হয়ে কাঁধের ব্যাগ নিয়ে পার্কে চলে গেলেন। সন্ধে নামল।
বটুক আর বিজন ছাড়া কেউ এল না।
মিটিং বাতিল। ওরাও ফিরে গেল এক সময়।
জর্জকে অপেক্ষার আঁধার পেয়ে বসল যেন। এমন সময় দরজায় ঋত্বিক।
‘‘হাত দিয়ে কপাট ধরে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছে সে। ‘মিটিং, মিটিং হইল না? ডিসিশান দাও, দুই বছর এপাশ-ওপাশ, ভালো লাগে না। ডিসিশান চাই…। কোন পক্ষে যাব, কোন দলে?’’
জর্জ এর কী উত্তর দেবেন, জানেন না। যন্ত্রণায় বুক ফেটে যাচ্ছে তাঁর।
মাথা নামিয়ে ঋত্বিককে বাড়ি চলে যেতে বললেন। টাল খেতে খেতে ঋত্বিক চলে যাচ্ছেন। এখন ফের কোথায় যাবেন, কে জানে!
জর্জ কখনও মদ্যপান পচ্ছন্দ করতেন না। একদিন সন্ধের একটু আগে এসেছেন ঋত্বিক ঘটক। দরজার কাছে দাঁড়ালেন। জর্জ তাঁকে বললেন, ‘‘আসবা না, এখন আসবা না।’’
ঋত্বিক বললেন, ‘‘জর্জদা, টাকা দাও। মোড়ের বাংলার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।’’ জর্জ বললেন, ‘‘কত দেব, দশ টাকা?’’ এই বলে, তিনি দশ টাকা ছুঁড়ে দিলেন।
ঋত্বিকের সে দিকে হুঁশ নেই। কে ছুঁড়ে দিল, তাতে কিছু যায়-আসে না ওঁর। এমন দৃশ্য দু’দিন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁর ভাগ্নি পারমিতা। জর্জ ঋত্বিক কে বলতেন, ‘‘আমাকে বিরক্ত কোরো না। টাকা নিয়ে চলে যাও।’’
জর্জ ঋত্বিককে খুব ভালোবাসতেন। বলতেন, ‘‘ঋত্বিক মানিকের থেকে অনেক ট্যালেন্টেড। মদ খেয়ে খেয়ে শেষ হল।’’
ছিয়াত্তরে ঋত্বিক চলে গেলেন।
এমন হুট করে তাঁর চলে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারেননি জর্জ।
সে সময়ের একটি চিঠিতে লিখেওছেন, ‘‘ঋত্বিক ও বিজন তো আত্মহত্যা করল… এ বার বোধহয় আমার পালা।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঋত্বিকের শোকসভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিল। তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন জর্জ।— ‘‘ক্যান যামু, হারামজাদাটা না বইল্যা কইয়া চইল্যা গ্যালো, যামু ক্যান আমি, আপনারা মাফ করেন আমারে!’’
মিত আলোর ঘর। জর্জ একমনে সুপুরি কাটছিলেন ছোট জাঁতিতে।
ঘরে-বাইরে সর্বক্ষণ মিঠাপাতির এই এক নেশা ছিল তাঁর। কখনও মোটর সাইকেলে গোটা কলকাতা দাপিয়ে ধর্মতলা থেকে গণেশ অ্যাভিনিউয়ের দিকে যেতে যেতে গলির মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেন। পান কিনতেন। খুব করে দেখে, আদরে মুখে পুরতেন চুন-খয়ের-জর্দার মিঠাপাতি। এ দৃশ্য ছিল রোজকার। প্রিয় পানের দোকান, বাসার কাছে রাসবিহারীর ফুটপাতের উপরও।
জাঁতিটা বিছানায় রেখে, সুপুরিগুলো ছোট্ট হামান দিস্তায় গুঁড়ো করে, পান সেজে দিলীপের জর্দা মিশিয়ে নিতেন।
ডিব্বা সরিয়ে রাখতেন। অপূর্ব সে গন্ধ। ভুরভুর সারাটা ঘর।
ঘরে ছিল কেবল একজনেরই ছবি। তিনি জর্জের ‘দিদিমণি’।
ছিপছিপে গড়নের মেয়েটি কালোপাড়-সাদা শাড়িতে কলকাতার মঞ্চে গাইছে, ‘কোন খ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এলো’।
জর্জ তাঁকে ‘দিদিমণি’ বলে ডাকতেন।
বিশ্বভারতীর ছাত্রী হয়েও, তাঁর গানের মধ্যে ভিন্নতর আহ্বান। জর্জের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। একসঙ্গে গণসঙ্গীতের কত অনুষ্ঠানে যে গেয়েছেন! কোথাও কোথাও সকলে দেখতেন, নৃত্যনাট্য শেষ হল, সুচিত্রা কাঁদছেন জর্জের কাঁধে মাথা রেখে। কত বার!
এ দিকে বিশ্বভারতীর সঙ্গে জর্জের বিরোধ বাড়ল ’৬২-তে মিউজিক বোর্ড থেকে অনাদি দস্তিদার সরে যাওয়ার পর। ’৬৪-তে জর্জের ফের দুটি গান আটকে দিল বোর্ড। অনেকের সঙ্গে দায়িত্বে দিদিমণি।
একদিন, জর্জের ‘দিদিমণি’ এলেন তাঁর বাড়ি।
দেখলেন, লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে মোড়ায় বসে ডিম-ফুলকপি রান্না করছেন জর্জ। বললেন, ‘‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গানে ‘চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে’র জায়গায় ‘চন্’ কথাটি স্বরলিপি মতো হয়নি।’’
জর্জ হাসলেন। হারমোনিয়ম টেনে শোনাতে বললেন। সুচিত্রা গাইলেন।
জর্জ বললেন, ‘‘‘চন্’ শব্দডা যে স্বরলিপি অনুসারে হইল না দিদিমণি।’’
চলে গেলেন সুচিত্রা। সে দিনের মতো বিরোধ মিটলেও দিদিমণির সঙ্গে সম্পর্কে কোথায় যেন দূরত্ব বাড়ার সেই হল শুরু।
কিছু দিন পর শান্তিদেব ঘোষ অবশ্য জানালেন, জর্জই ঠিক।
১৯৬৯-এ ফের জর্জের দুটি গান আটকাল বোর্ড। আঘাত পেয়ে রেকর্ড বন্ধ করে দিলেন জর্জ!
কাতর হয়ে অভিমানে যখন থামলেন, তখন তিনি টপ ফর্মে। রেকর্ড বিক্রি বেড়েই চলেছে।
ভাগ্নি পারমিতার তাঁর স্মৃতিচারণেও এসেছে জর্জের শেষবারের জন্য শান্তিনিকেতন আসার কথা,
“তখন সবে খালেদবাবুর আঁকা ছবির প্রচ্ছদে ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’ বেরিয়েছে। আমি বিশ্বভারতী থেকে পাশ করে ভর্তি হয়েছি বর্ধমানে।
মামা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতি পথে আমার সঙ্গে দেখা করতে গেল। সেটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর। হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘‘যা, বন্ধুদের নিয়ে খাওয়াদাওয়া কর।’’ আর গাড়ি থেকে একটা বই বের করে দিল। ততক্ষণে আমার বন্ধুরা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ভিড় করেছে। আমি বললাম, তুমি কী খাবে? বলল, ‘‘আমি আর কী খাব, শক্তিগড়ের ল্যাংচা।’’
সে বারই শেষ শান্তিনিকেতন আসা মামার।” …
আবার আশ্রয় সেই একলা ঘর। সে সময় যাঁরা তাঁকে দেখেছেন, তাঁদের স্মৃতি থেকে মেলে সেই সকাতর সময়ের ছবি। মাঝে মাঝেই একে-ওকে সামনে পেয়ে স্বরবিতান ধরিয়ে দিয়ে জর্জ বলছেন, ‘‘আমি গাইতাছি তুমি স্বরলিপির সঙ্গে মিলাইয়া বলো। বলো না, কোনখানে আমি ভুল করছি!’’
কেমন ছিল জর্জের সঙ্গে তাঁর দিদিমণির সম্পর্ক?
চোদ্দো বছরের বড়, তবু সুচিত্রার কাছে তিনি ছিলেন শুধুই ‘জর্জ’!
প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে যে বার ভর্তি হলেন রামকৃষ্ণ শিশুমঙ্গল হাসপাতালে— অবচেতন জর্জের মুখে কখনও শোনা যায়, ‘সুচিত্রা’, কখনও ‘দিদিমণি, দিদিমণি’! জ্ঞান ফিরে দেখতে চাইলেন দিদিমণিকেই। ছুটে এলেন সুচিত্রা। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
সুচিত্রা যখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী, জর্জ জ্বর নিয়ে একবার চিঠির প্রত্যুত্তরে লিখলেন সুচিত্রাকে।— ‘‘আজ আপনাকে একটা ভীষণ সত্যি কথা বলছি— কথা হল এই— অসুখের মধ্যে আপনার চিঠিটা ভীষণ ভালো লেগেছে। এবং এত ভীষণ ভালো লেগেছে যে অনেকবার পড়ে ফেলেছি।’’ একটু পরেই লিখছেন, ‘‘মোহরের খবর কি? তাকে আমার কথা বলবেন।’’
এই সুচিত্রাই তাঁর অনুলিখিত আত্মকথায় লিখছেন, ‘‘জর্জের গান বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড বাতিল করেছিল বলে যা এক সময় বহু জায়গায় প্রচারিত হয়েছে, তা ঠিক নয়। জর্জের কোনও গান বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড খারিজ করেনি।’’
জর্জ-ঘনিষ্ঠ, তাঁর ‘ওস্তাদ’ শিল্পী খালেদ চৌধুরী সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত ভাবে এক বার বলেছিলেন, জর্জের সঙ্গে অন্যদের রেকর্ড বিক্রির বিরাট অঙ্কের ফারাকটাই বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডের লোকেরা মেনে নিতে পারেনি। তাদের ঈর্ষা ছিল। এও বলেছিলেন জর্জের পিছনে ‘‘সুবিনয় রায়, সুচিত্রা লেগেছিল, আবার লাগেনি।’’
উত্তাল সময়ে দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা খালেদকে জর্জ কি কিছু বলেছিলেন?
শেষ দিকে খালেদের সঙ্গে আলাপের গোড়ার কথাগুলো খুব মনে পড়ত জর্জের। গোয়াবাগানে আইপিটিএ-র সম্মেলনেই প্রথম আলাপ তাঁর সঙ্গে।
পার্টিতে যখন মতবিরোধ, সকলের মনে ধোঁয়াশা, সে সময়ের অনেকে তাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।
’৪৬। কলকাতায় রায়ট। উত্তাল মহানগর। কালীঘাট ট্রাম ডিপোতে লাশের স্তূপ। শুনশান রাসবিহারী। বারুদের হাওয়া কেটে একটা লোক পড়িমড়ি করে ছুটতে ছুটতে গলি দিয়ে ঢুকে পড়ল জর্জের ঘরে।
ছোট্ট ঘরে তখন জর্জের সঙ্গে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রও বসে।
লোকটাকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন জর্জ— ‘‘শালা… বাইচা আছো।’’
‘লোকটা’ কলিম শরাফী। পরে বাংলাদেশের বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ও পার থেকে গোপন আশ্রয় নিতে এসেছিলেন জর্জের ঘরে। পুলিশি-গ্রেফতারি এড়াতে সাত দিন সে-বাড়িতে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিলেন কলিম।
জর্জের ঘরে কয়েক দিনের জন্য আত্মগোপন করে ছিলেন আরও একজন। কাইফি আজমি।
দেশে তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। কবি, শিল্পী, নাট্যকর্মীদের একটি গোপন সভায় যোগ দিতে কলকাতায় এসে উঠেছেন জর্জের ডেরায়। হঠাৎ একদিন পুলিশের ইনফরমার খবর দিল রেড হবে।
যে দিন রেড হল, সে দিনই কাইফিকে ধুতি আর পৈতে পরিয়ে ছদ্মবেশে রওনা করিয়ে দিলেন জর্জ। তত ক্ষণে বাড়ির চার ধারে থিকথিকে পুলিশ। এক সময় দরজা ঠেলে পুলিশ কর্তারা ঢুকেই পড়লেন বাড়িতে।
প্রায় অন্ধকার ঘরে জর্জ তখন হারমোনিয়ম বাজিয়ে রবিঠাকুরের গানে একাত্ম। —‘চির সখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।’
উল্টো দিকে মুগ্ধ শ্রোতা কলিম শরাফী!
সুরের আসমানে ভেসে থাকা জর্জের চিঠির ফাইল ছিল দেখার মতো। লেখা জুড়ে কৌতুক। পরিহাস। আবার বিরোধের কথা। সহজিয়া শব্দ-রেখায়। শব্দের পিঠে শব্দ সাজিয়ে খুব যত্ন করে একটা সময়ের পর থেকে নিয়মিত দিস্তের পর দিস্তে চিঠি লিখেছেন প্রিয়জনদের। স্বজন-ভক্তদের। চিঠি আসতও নিয়মিত। সব চিঠির উত্তর দিতেন। আর সব ক’টির কার্বন-কপি করে রেখে দিতেন ফাইল-বন্দি করে।
কোনও চিঠি শুরু হত ‘কইলকাতা, ১৭৪-ই, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ’ দিয়ে। সে সব চিঠিই শোনাতেন তাঁর কাছে কেউ গেলে। নিজে কী উত্তর লিখেছেন, তাও শোনাতেন। চিঠির এক-এক ফাইলের নাম ছিল বিচিত্র। — ‘ভালবাসার অত্যাচার বা পাগলামি’, ‘টিন এজার্স’, ‘কোলাকুলি ও গালাগালির ফাইল’ বা ‘সেন্টিমেন্টাল অ্যাডাল্টস’।
তাঁর ভাগ্নি পারমিতার স্মৃতিতে, “যখন আমি শান্তিনিকেতনে, মামা অনেক চিঠি লিখত, তার উত্তরও দিতাম। মজার সব চিঠি। একটাতে যেমন চিঠি শুরুর জায়গায় আমার মুখের ছবি এঁকেছে। চিঠির শেষে নিজের মুখের স্কেচ!”
শেষ দিকের জর্জ যেন জেরবার। শরীরে, মনে। সবেতে।
রাসবিহারীর ভাড়াবাড়ি থেকে উঠে যাওয়ার তাগাদা। শরীর ভেঙে পড়েছে তখন। বার বার ইনহেলার নিয়ে আরাম হচ্ছে কতটুকুই বা! জ্বর আসছে কেবল। অসহায় হয়ে পড়লেন জর্জ। কিন্তু গান থেমে নেই।
কোনও কোনও গানে একই জায়গা গাইছেন বারবার। ‘ওহে চঞ্চল, বেলা না যেতে খেলা কেন তব যায় ঘুচে’। কলকাতার ভরা ময়দানে অগণিত মানুষ নির্বাক হয়ে তখনও শুনেছে তাঁর গান।
জর্জ তখন দাড়ি রাখছেন। গেরুয়া লুঙ্গি, ফতুয়া। হাতের লাঠিটি সর্বক্ষণের সঙ্গী। রোগজর্জর শরীর নিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে বাইরের আকাশ দেখছেন। উত্তমকুমার এলেন শিল্পী-সংসদের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে।
জর্জ বললেন, ‘‘আপনে আইছেন ক্যান? আমারে তো পুলিশ ডাকতে হইব?’’ অনেক করে উত্তম রাজি করালেন।
জর্জ শর্ত দিলেন দুটি। বিজ্ঞাপনে ‘দেবব্রত বিশ্বাস’ লেখা যাবে না। লিখতে হবে ‘এক বিতর্কিত শিল্পী’। আর মঞ্চেও তাই ঘোষণা করতে হবে।
তাই হল।
উত্তমকুমার মাইকে বললেন, ‘‘এ বার গান শোনাবেন এক বিতর্কিত শিল্পী।’’ পর্দা উঠে গেল, জর্জ গান শুরু করলেন।
হারমোনিয়ম একটু বেলো করে মাথাটা ঈষৎ উঠল যেন। গান শুরু করার আগে সব আলো জ্বালিয়ে দিতে বললেন।
গাইলেন, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’। তাঁর একের পর এক বর্ষার গানে খুলে যাচ্ছে মেঘের ডানা-ভাঁজ। স্থায়ী থেকে অন্তরায় ছড়িয়ে পড়ছে মেঘমন্দ্র উচ্চারণের সম্মোহন। কোথাও ঘুরে ঘুরে একই লাইন গাইছেন। কখনও একটু সুরের রেশ টেনে, বেশি মাত্রা নিয়ে গাইছেন। যেন বৃষ্টি-হাওয়ার নেশা পাক খেয়ে ঘুরছে ময়নাপাড়ার মাঠে।
একবার জর্জের রাসবিহারীর বাড়িতে গিয়েছিলেন সমরেশ বসুও। মায়া সেন নিয়ে এসেছিলেন। জর্জ পা তুলে বসে ছিলেন। ঘরে সমরেশ বসু ঢোকার পরও পা নামালেন না। মায়া সেন এ দিকে ইশারা করেই যাচ্ছেন, পা নামাতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই আর পা নামালেন না।
শেষে চলেই গেলেন সমরেশবাবু। মায়া সেন তাঁকে গাড়িতে চাপিয়ে ফিরে এসে বললেন, ‘‘জর্জদা, আপনি এটা কী করলেন?’’ জর্জ বললেন, ‘‘যে এত অশ্লীল গল্প লেখে, তাকে আমি পছন্দ করি না।’’
তিনি ছিলেন এই রকমই!
আরেক বারের কথা, উত্তমকুমার মারা গেলেন। তার কয়েক দিন বাদে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন তাঁর ভাগ্নি পারমিতা। দুটো চিঠি দেখিয়ে জর্জ তাঁকে বললেন, ‘‘এই দ্যাখ, উত্তমের দুটো শ্রাদ্ধের চিঠি এসেছে। সুপ্রিয়া পাঠাইছে, গৌরীদেবীও পাঠাইছে। কোনটায় যাব?’’
উত্তমকুমার কে নিয়ে জর্জের আরেকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন পারমিতা। টিভিতে একবার ‘আলো আমার আলো’ সিনেমাটা হচ্ছে। জর্জ দেখে বললেন, ‘‘বাবা, কী বিচ্ছিরি! উত্তম-সুচিত্রা কী করেছে এ সব! কেউ দেখে! জঘন্য!’’ ভাগ্নি ভ্রু তুলে হাইমাই করে উঠতেই বললেন, ‘‘আমার তো দমবন্ধ লাগে।’’
শেষ দিকে রোগা হয়ে গিয়েছিলেন জর্জ। কেবল চলে যাওয়ার কথা বলতেন। মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হত। এ সবের মাঝেও কিন্তু বাড়িতে তাসের আড্ডাটা ঠিক বসত সন্ধ্যাবেলায়। কয়েক জন আসতেন। তাঁদের সঙ্গে তিনি তাস খেলতেন।
শেষের দিকে চোখেও কম দেখছিলেন জর্জ। আগস্টেই গোলাম মুরশিদকে চিঠিতে লিখলেন, ‘‘আমার তো ভবনদী পার হবার সময় হয়ে এসেছে… বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল আমার চোখে ছানি পড়তে শুরু হয়েছে। এখন স্পষ্ট দেখতে পাই না। আর কিছুদিন বাদে হয়তো অন্ধ হয়ে যাব।’’ মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কিংশুক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসদনে জর্জকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। অনেক কষ্টে ‘কাকা’ জর্জকে রাজি করিয়েছিলেন তিনি। জর্জ গেয়েছিলেন, ‘এখন আমার সময় হল, যাবার দুয়ার খোল’।
কেই বা জানত সময়ের সেই কড়া নাড়া তখন তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন!
একেবারে শেষ দিকে যখন শরীরটা খুব ভেঙে গেল, তখন মনের দিক থেকেও তিনি ভেঙে পড়লেন। হাত নাড়িয়ে কেবল বলতেন, ‘‘ভাল নাই। ভাল নাই।’’
হয়তো নিজের ভাগ্নির সঙ্গে গল্প করলেন, কিন্তু বাইরের কেউ এলে, কথা বলতে চাইতেন না। শেষের দিকে কেবলই ভাগ্নি কে বলতেন, ‘‘তোকে এই রেকর্ড দিয়ে দিলাম। এই খাতা দিয়ে দিলাম।’’ তাঁকে বলতেন, কোথায় কী আছে। সব যেন বুঝিয়ে দিতে চাইতেন।
শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকামনা করে গিয়েছেন নিজের। শেষ চিঠি লিখলেন মৃত্যুর ১১ দিন আগে, অগস্টের ৭ তারিখ।
সিউড়ির সোনাতোড় পাড়ার অর্চনা বসুকে। জর্জ তাঁকে ‘মাসিমণি’ বলতেন। শ্বাসরোগের যন্ত্রণায় কাতর জর্জ লিখছেন, ‘‘ডাক্তারবাবু বলেছেন আমার হাঁপানি একেবারে সারানো যাবে না— হয়তো আক্রমণটা কিছু কমতে পারে। … এই রকম অকর্মণ্য হ’য়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভাল— কিন্তু আত্মহত্যা করার সাহস আমার নেই!’
চলে যাওয়ার সাত দিন আগে ভাগ্নি পারমিতাকে বললেন, ‘‘শোন, আমি আর এক সপ্তাহ আছি। সকালে উঠে দেবদুলালের গলায় রেডিওতে শুনবি, কুখ্যাত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস মারা গেছে!’’
কলকাতার ভোরের আকাশে সে দিনও মেঘ ছিল।
শোকমিছিলে কাঁদছে প্রিয় শহর।
মিছিল রবীন্দ্রসদনে।
পাটভাঙা গেরুয়া পাঞ্জাবি, সাদা ধুতি। ফুলের আড়ালে ঘুমিয়ে জর্জ।
কিছু দিন আগে এখানেই শেষ সংবর্ধনা নিয়েছেন জর্জ। স্মৃতি থেকে যেন তাঁর গান ভেসে আসছে। ফিরে ফিরে গেয়ে চলেছেন জর্জ। ‘আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে/ কাঁপন ভেসে চলে’।
মিছিল এ বার হরিশ মুখার্জি রোড ধরে ঘাটের কাছে। চোখের জলে ফুরল গান, ‘একদিন কোন্ হাহা রবে/ সুর হারায়ে গেল পলে পলে/ আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’।
প্রিয় মামার মুখাগ্নি করেছিলেন তাঁর প্রিয় ভগ্নিই।
বাঁ দিকে হেলানো মাথা। হাতে লাঠি। একা, নিঃসঙ্গ জর্জ যেন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন বাদল দিনের দিগন্তের ও পারে।
কান্নায় ভেঙে পড়ল কলকাতা। শোকসভায় কালো শাড়িতে দিদিমণি গাইলেন—
‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার।’
(তথ্যসূত্র:
১- ১৮ই আগস্ট ২০১৬ সালে আজকাল পত্রিকায় প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও জীবনীকার গোলাম মুরশিদ লিখিত ‘দেবব্রত বিশ্বাস: স্বকীয়তা ও অবদান’ প্রবন্ধ।
২- দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে, দেবব্রত বিশ্বাস, দে’জ পাবলিশিং।
৩- জর্জ, বাসব দাশগুপ্ত।
৪- শ্রী দেবব্রত বিশ্বাসের ভাগ্নি পারমিতার সাক্ষাৎকার। আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২শে আগস্ট ২০১৫ সাল।
৫- দেবব্রত বিশ্বাস স্মৃতিচারণে, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২শে আগস্ট ২০১৫ সাল।)