সেল্যুলার জেলের দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা আছে বাঙালি বিপ্লবীদের নাম। সম্প্রতি বাংলার সাংসদ ঋতব্রত ব্যানার্জীর প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্র সরকার সংসদে জানিয়েছে, আন্দামানের সেল্যুলার জেলে মোট ৫৮৫ জন ভারতীয় বিপ্লবীকে বন্দি করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৩৯৮ জন বাঙালি। হ্যাঁ, সংখ্যাটা ঠিক শুনেছেন, ৩৯৮ জন বাঙালি। জেলের প্রতিটা ইঁট বাঙালি বিপ্লবীদের আত্মবলিদানের সাক্ষী। কিন্তু জেলের নাম কার নামে হল? ব্রিটিশ সরকারকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া ‘কাপুরুষ’ সাভারকারের নামে। হওয়া উচিত ছিল বাঙালি ‘বীর’ উল্লাস কর দত্তর নামে।
সবাইকে বলা হচ্ছে, দীনদয়াল উপাধ্যায়, মদনমোহন মালভ্যিয়া রাই ভারত স্বাধীন করেছে। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ১৮০ ফুটের মূর্তি তৈরি হয়েছে। আর এদিকে ইতিহাস বিস্মৃতির অতল গভীরে হারিয়ে যাবেন কানাইলাল ভট্টাচার্য, সূর্য সেন, বাঘাযতীন, প্রীতিলতা, মাতঙ্গিনীরা। কারণ বাঙালি হিন্দি সাম্রাজ্যের অংশ না, কলোনী মাত্র। আমরা ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ তত্ত্বের ধারক ও বাহক না, বরং শত্রু। কংগ্রেসী যুগে নেহেরু ও গান্ধীজীকে ভারতের প্রাণপুরুষ বলে প্রচার চলেছে, এখন আবার স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ না নেওয়া আর এস এস দেশপ্রেমের ট্যাবলেট গেলাচ্ছে মুখ চেপে। একটা জোক শোনা যায়, ‘আর এস এসের স্বাধীনতা সংগ্রামী খুঁজতে গিয়েই নাকি আর্যভট্ট শূন্য আবিষ্কার করেছিলেন।’ হ্যাঁ, বাঙালির আত্ম বলিদান কেউ মনে রাখেনি, বাঙালি বিপ্লবীরা সিবিএসই র সিলেবাসে ঠাঁই পাননি। অনুশীলন সমিতি বা যুগান্তর দলের কথা নব্য প্রজন্মের কজনই বা শুনেছে? যারা শোনেনি তাদের দোষ না, আসলে শোনানো হয়নি। এই বাংলা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। ‘বন্দেমাতরম’ বাঙালি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, ভারতের রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। ‘ভারতমাতা’ (যা আসলে ‘বঙ্গমাতা’) তা বাঙালি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা।
সুভাষচন্দ্র বসুর কথা না ই বা বললাম। বল্লভ ভাই প্যাটেলের বড় মূর্তি হবে, সাভারকারের নামে আন্দামানের সেল্যুলার জেল এবং বিমানবন্দরের নামকরণ হবে- আর মিথ্যে সুভাষপ্রেম দেখিয়ে আন্দামানের কোনো আনকোরা দ্বীপের তাঁর নামে নামকরণ হয়। প্রতিবছর ২৩ শে জানুয়ারীর আগে ‘নেতাজী’ সম্পর্কিত গোপন নথি প্রকাশের হাওয়া ওঠে, অনেকে সুভাষপ্রেমী সাজে, তারপর সব থিতিয়ে যায় কয়েকদিন পরেই। আর বাংলার ‘প্রাণপুরুষ’ চিত্তরঞ্জন দাসকে পরিকল্পনা করে ইতিহাস থেকেই মুছে দেওয়া হয়েছে।
বাঙালির রক্তের বিনিময়ে এল স্বাধীনতা, সেই সময় ‘বেওসা’য় ব্যস্ত ছিল কিছু গোষ্ঠী বা জাতি। তারা আজ বাঙালির রাষ্ট্রপ্রেমের পরীক্ষা নিচ্ছে, বাঙালির নাগরিকত্বের পরীক্ষা চলছে যত্রতত্র। ভারতের বাঙালির আজকের দুরবস্থা দেখলে সূর্যসেনরা কি করতেন জানা নেই। ভারতে বাংলা বললে ‘বাংলাদেশী’ দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্র সরকারি চাকরি থেকে হঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাঙালিদের, কারণ বেশিরভাগ চাকরির পরীক্ষা বাংলায় হয় না। বাংলা ভাষা সর্বত্র বঞ্চনার শিকার, বাঙালি অত্যাচারিত নানা রাজ্যে। বাঙালির সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি আজ আক্রান্ত। বাংলার নানা এলাকা দখল হয়ে যাচ্ছে, বাঙালি নারীরা আজ গোবলয়ের পুরুষদের চোখে ‘পতিতা’ ও ‘ভোগ্য বস্তু’ মাত্র, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাঙালির বাংলায় রাজনীতি কন্ট্রোল করছে বহিরাগতরা। আন্দামান জেলে যাদের জাতির একজনেরও নাম নেই, তারাই প্রভু হয়ে বাংলাকে ‘কাংলা’ এবং বাঙালিকে ‘কাঙালি’ বলছে, বলছে ‘উইপোকা’ও।
আগামীকাল ভারত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির ভূমিকা নিয়ে বলিউড সিনেমা বানায় না। সারাদিন জুড়ে টিভিতে দেখানো হবে ‘বর্ডার’, ‘গদর’, ‘ইন্ডিয়ান’, ‘উরি’ র মতো সিনেমা। মনে হবে ব্রিটিশ না, পাকিস্তানের থেকে স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত। স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস ভারতবাসীর কাছে অজানা রয়ে যাবে। যারা ব্রিটিশ প্রভুদের পদলেহন করত তারাই রাষ্ট্রকে আজ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই, ব্রিটিশ প্রভুদের বিরুদ্ধে আজকাল আর তেমন কোনো বক্তব্য শোনা যায় না, রাষ্ট্রপ্রেমের মানে আজ পাকিস্তানকে ঘৃণা ও একটা দলের চাটুকারিতা।
আগামীকাল রাষ্ট্রনেতারা ভাষণ দেবেন, রাষ্ট্রপ্রেমের জোয়ারে ভাসবে সবাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘জন গণ মন’ গাওয়া হবে ‘জ্যানা গ্যাণা ম্যানা’ বলে, বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরম’ উচ্চারিত হবে ‘ভ্যান্দেমাতারম’ হয়ে। আগামীকাল কেউই ভারতীয় সেনায় বাংলা রেজিমেন্ট নেই কেন- সে কথা তুলবে না। সূর্যসেন, বিনয়-বাদল-দীনেশের মাতৃভাষায় সেনাবাহিনীতে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন হয় না কেন- তা অজানাই থেকে যাবে। ওদিকে আসাম থেকে বাঙালিকে রাষ্ট্রহীন করা হচ্ছে, তা চলতে থাকবে। বাংলাতেও এন আর সি হবে এবং বাংলা ভাগ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগোবে।
আমরা ভারতের বাঙালি। আমাদের পূর্ব পুরুষদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে ভারতের স্বাধীনতা। ওরা ভুলিয়ে দিতে চায়, আমরা ভুলব না। আমরা সুভাষ, চিত্তরঞ্জন, মাতঙ্গিনী, ক্ষুদিরাম সকলকেই বুকে ধরে রাখব। আমরা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সমান অধিকার চাই। আমরা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাঁচতে চাই। ব্রিটিশ তাড়িয়ে গুজরাটি ও মাড়োয়াড়ি প্রভুদের গোলামী করার জন্য বাঙালি রক্ত ঝরায়নি। আমরা কেন রোজ নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্রপ্রেমের পরীক্ষা দেব? যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ‘বেওসা’ করতে ব্যস্ত ছিল, তারা বুঝে নিক, খারাপ সময় আসছে তাদের, বাংলা ও বাঙালি জাগছে। পালটা প্রতিরোধ শুরু হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে ‘জয় বাংলা’ ঝড় উঠেছে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত