ফুটবলের প্রতি ভালবাসা ছিল শৈশব থেকেই। আর স্বাভাবিকভাবেই সেই ভালবাসা থেকে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দুই প্রধানের ফুটবলারদেরই ছবি কেটে দেওয়ালে আটকাতেন তিনি। ফুটবলার জীবনের শুরুতে এরিয়ানে খেললেও ১৯৬০ এ এসেছিলেন মোহনবাগানে। নিয়মিত খেলতেনও। কিন্তু তিনিই একসময় মোহনবাগানে খেলবেন না বলে মান্না দে কে মিথ্যে বলেছিলেন। ইস্টবেঙ্গলের ক্রীড়াদিবসে এসে এভাবেই স্মৃতির সরণিতে ডুব দিলেন সুকুমার সমাজপতি।
এদিন তিনি বলেছিলেন, “মোহনবাগানে এসে প্রথম বছর লিগের পঞ্চম ম্যাচে ইস্টার্ন রেলের বিরুদ্ধে ০-২ হেরে গেলাম। দ্বিতীয়ার্ধে পিছিয়ে থাকার সময়ে চুনীদাকে (চুনী গোস্বামী) জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি রাইট আউটে খেলব? মান্নাদার সঙ্গে কথা বলাই ছিল, যদি সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে ব্যর্থ হই, তা হলে অন্তত একটা ম্যাচে রাইট আউট পজিশনে খেলাতে হবে। দিপু (দিপু দাস) চলে এল আমার পজিশন, অর্থাৎ সেন্টার ফরোয়ার্ডে। বিপক্ষের ফুটবলারদের কাটিয়ে উইং দিয়ে উঠে একের পর এক পাস করলাম। যদিও জিতিনি। তার পর থেকে রাইট আউটে খেলা শুরু। আমার পাস থেকে কখনও চুনীদা, কখনও অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় গোল করেছেন।”
এদিন তিনি আরও বলেন, “১৫তম ম্যাচে হাঁটুতে চোট পেয়ে দু’মাসের জন্য ছিটকে গেলাম। দিপু দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটাল। হেডে টানা গোল করতে শুরু করল। ফিট হয়েও প্রথম একাদশে ঢুকতে পারছি না। আইএফএ শিল্ডের সময়ে বলা হল, লেফ্ট আউটে খেলতে হবে। আমি রাজি। প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রথম দলে ঢোকা। সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ মহমেডান। আমি মাঠে নামার জন্য তৈরি। আমাদের কোচ ছিলেন অরুণ সিনহা। উনি হঠাৎ বললেন, ‘‘তুমি কুড়ি মিনিট পরে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসবে!’’ বিস্মিত হয়ে বললাম, তা হলে তো সবাই ভাববে আমি ফিট হইনি। না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে জার্সি খুলে ফেললাম। ড্রেসিংরুমে বসে কাঁদলাম। খেলাই দেখলাম না। খেলা শেষ হওয়ার পরে কেম্পিয়া অবশ্য আমাকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল।”
এরপর তিনি খেলেছিলেন ডুরান্ডেও। সেখানেও দুর্দান্ত খেলেছিলেন তিনি। ডুরান্ড শেষ হওয়ার পরেই কালিকটে সন্তোষ ট্রফি খেলতে যান তাঁরা। তার পরে মোহনবাগানের হয়ে তিন মাসের জন্য পূর্ব আফ্রিকা সফরে যাওয়ার কথা। তিনি বলেন, “সেখান থেকেই তাঁর জীবন নাটকীয় মোড় নিল। সন্তোষ ট্রফি খেলতে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা আগেই চলে গিয়েছিল। মোহনবাগানের আমরা পাঁচ জন—জার্নেল, কেম্পিয়া, দিপু, অমল ও আমার বিমানে যাওয়ার কথা। এখনও মনে আছে, সে দিন সরস্বতী পুজো ছিল। মনটা তাই এমনিতেই একটু খারাপ। সন্ধেবেলা হঠাৎ মোহনবাগানের এক কর্তা এসে হাতে ট্রেনের টিকিট দিলেন। বললাম, আমাদের তো বিমানে যাওয়ার কথা। ট্রেনের টিকিট কেন? কোনও উত্তর নেই। ফের জিজ্ঞেস করলাম, বাকি চার জনও কি ট্রেনে যাচ্ছে? এ বারও উত্তর নেই। রাগে টিকিটটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিলাম। বলে দিলাম, খেলব না সন্তোষ ট্রফি। ঘণ্টাখানেক পরে ফের বিমানের টিকিট নিয়ে হাজির সেই কর্তা। কেন শুধু আমাকেই ট্রেনে পাঠানোর পরিকল্পনা হয়েছিল, আজও তা আমার কাছে রহস্য। সে দিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আর মোহনবাগান নয়। ইস্টবেঙ্গলে সই করব।”
সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে হেরে কলকাতায় ফেরার সময় চুনীদা বললেন, ‘‘ক্লাব তাঁবুতে চলে আয়, পূর্ব আফ্রিকা সফরের জন্য টিকা দেওয়া হবে।’’ কিন্তু আমি যাইনি। কারণ, তত ক্ষণে ইস্টবেঙ্গলে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে ফেলেছি। বিকেলবেলা কালীঘাটের রোয়াকে বসে যখন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছি, মান্নাদা এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, সকালে কেন টিকা নিতে যাইনি? বললাম, শরীরটা ঠিক নেই। কিন্তু বিশ্বাস হল না মান্নাদার। বললেন, ‘‘আমার আঙটি ছুঁয়ে বল, ইস্টবেঙ্গলে সই করবি না।’’ সে দিন আঙটি ছুঁয়ে মিথ্যে কথা বলেছিলাম মান্নাদাকে। তখন আমার শরীর রীতিমতো কাঁপছিল। মান্নাদা বললেন, ‘‘গাড়িতে উঠে পড়। এক্ষুনি চল ক্লাব তাঁবুতে। বিকেলেও টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।’’ মান্নাদাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আপনি এগোন, আমি আসছি। এর পরেই একটা কাণ্ড করেছিলাম। ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন ফুটবল সচিব মন্টু বসুকে ফোন করে বললাম, আমাকে যদি চান, এক্ষুনি বাড়ি থেকে নিয়ে যান। মন্টুদা জানালেন, দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে। ঠিক তাই হল। আমাকে নিয়ে চলে গেলেন। পরের দিন কয়েকটা খবরের কাগজে লেখা হল, সুকুমার সমাজপতিকে অপহরণ করা হয়েছে!
স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে তিনি বলেন, “ইস্টবেঙ্গলকে পাকা কথা দিয়েছিলাম সন্তোষ ট্রফি চলাকালীনই। কোঝিকোড়ের (তৎকালীন কালিকট) এক হোটেলে কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়। ১৯৬১ সালে ইস্টবেঙ্গলে সই করলাম। কেউ চাইছিল না মোহনবাগান ছাড়ি। বলছিল, সামনেই পূর্ব আফ্রিকা সফর। এখন যেন ইস্টবেঙ্গলে সই না…