শহরের রাস্তার গাছগুলোর চারপাশ ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছেন সরকার। পরিবেশপ্রেমের নামে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর এই অপকর্মটি দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। উত্তর থেকে দক্ষিণ শহরের সর্বত্র এক ছবি। শুধু শহর কেন কলকাতা ছাড়িয়ে শহর যেখানে তার বহর বাড়াচ্ছে সেখানকার হালচালও একইরকম। পরিবেশের তোয়াক্কা না করা একশ্রেণীর মানুষের পাশাপাশি এই অপকর্মে ধর্ম ব্যবসায়ীরাও সমান সক্রিয়। রাস্তায় দোকান আছে এমনকিছু বড় ব্যবসায়ীও তাদের দোকানের সামনেটা দখলমুক্ত করতে সৌন্দর্যায়নের দোহাই দিয়ে দোকানের সামনের গাছগুলো বাঁধিয়ে দেন। বৃক্ষরা প্রতিবাদ করতে পারেনা, পরিবেশপ্রেমীদেরও এই যুক্তি দিয়ে বেশ ঠেকানো যায়। আশা রাখি এমন অপকর্ম এবার কিছুটা হলেও বন্ধ হবে।
পুরোটা বন্ধ করা বেশ লম্বা লড়াই। কারণ, আমি জানি এর প্রতিবাদে এবার আসরে নামবেন শহরের ফুটপাথকে হকারদের পর যারা সবচাইতে বেশি কলুষিত করছেন, হাজার হাজার পথচারীকে ঠেলে দিচ্ছেন দুর্ঘটনার মুখে, সেই ধর্ম ব্যবসায়ী ও একশ্রেণীর দোকানদার এবং কিছু বিজ্ঞাপন সংস্থা। শহরের অভিজাত রাস্তা পার্ক স্ট্রিট, সেই রাস্তার ময়দানের দিকের মোড় থেকে মল্লিকবাজারের মোড় অবধি ১১টা শনিমন্দির। প্রতি কটাতেই কোপনস্বভাব শনিদেবকে তুষ্ট করার অঢেল আয়োজন। পথচারী থেকে পুলিশ সবাই দেবতাকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত। প্রণামীর থালি কিছুক্ষণ পরপরই বেজে উঠছে পয়সা পড়ার শব্দে। থালা ভরে উঠলেই তৎপর পূজারী কিংবা তার অনুচর তা ঢেলে রাখছেন একটা আলাদা বাক্সে। পয়সা পড়ছে থালায় আর নোট ঢুকছে পাশে রাখা একটা ক্যাশ বাক্সে। দেবতার কৃপায় এই আয় পুরোটাই করমুক্ত।
একই অবস্থা কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে প্রায় শিয়ালদা অবধি। অভিজাত এলাকা বলে বহু বিজ্ঞাপিত লর্ডস মোড়ের সামনে মন্দির ফুটপাথ ছাড়িয়ে এসে দাঁড়িয়েছে মাঝ রাস্তায়। শনিকালী নয়, এখানে প্রবল বিক্রমে ভক্তদের কৃপা বিতরণ করছেন সাঁইবাবা। সন্ধ্যায় ভিড় ছড়িয়ে যায় দুপাশের ফুটপাথবিহীন রাস্তায়। দেবদেবীর কৃপাতেই রোজ প্রতি সন্ধ্যাতে এ রাস্তা দিয়ে মানুষ অক্ষত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছন। কলকাতার কথা আর কী বলবো? আমি যেখানে থাকি সেই সল্টলেকেও মন্দির ব্যবসায়ীদের দাপট ক্রমেই বাড়ছে। ইদানিং সেখানেও শনিকালীর মন্দিরের বেশ রমরমা। সব জায়গাতেই ধর্ম ব্যবসায়ীদের চোখ প্রথমে পড়ে রাস্তার পাশে একটা জুৎসই জায়গার লাগোয়া গাছটির ওপর। তাকে ঘিরেই এই ব্যবসার সূচনা।
প্রথমেই গাছের গুঁড়ি পেরেক কণ্টকিত করে তাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দেবদেবীর ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার। তারপর আস্তে আস্তে গাছের নানা ডালে লাগানো দড়ি ও পেরেকে ভর দিয়ে ঝুলতে থাকেন পুরুষ ও মহিলা নানা রাগী দেবদেবীরা। গাছতলাতে তুষ্ট না হলেই শাপ দেবেন এমন দেবদেবীর সংখ্যাই বেশি। তারপরের পর্বে ক্যালেন্ডার নয়, গাছতলায় গেড়ে বসেন দেবতা নামধারী নানা সাইজের পাথর, শনি, কালী, মা তারা, শিব, শীতলার মূর্তি। ইদানিং মহাবিক্রমে এই দলে যোগ দিয়েছেন বীর হনুমান। শনি, কালী, হনুমান এই তিনজনই এখন গাছতলার মেগাস্টার। স্থানীয় ভক্তরা কোন জায়গায় বসিয়ে নেন লোকনাথ বাবার মূর্তি। ঠিক এর পরের পর্বেই গাছের চারপাশ বাঁধানো হয়, মাস ছয়েকের মধ্যেই যেখানে গজিয়ে উঠবে একটা মন্দির এবং রাস্তা আটকে সেই মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিৎ অনেক নামী মানুষকে যোগ দিতেও আমি দেখেছি।
মন্দির বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে গাছটির দুর্দশা। বছরের বারোমাস তার কেটে যায় ধর্মীয় নিশান, নানা সাইজের রঙিন আলো, মাইক ফেস্টুন, ব্যানার, বিজ্ঞাপন শৃঙ্খলিত অবস্থায়। ব্যহত হয় তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি। প্রাণ নয়, গাছ হয়ে যায় একটা সংগঠিত ব্যবসার ডেকোরেটিভ আইটেম। বিজ্ঞাপন ব্যবসার একটা অপরিহার্য অঙ্গ। যে কোন উৎসবে গাছের ডালে লাগানো মাইক স্থানীয় মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দেয়। এসবকিছুই মানুষ ও গাছ সবার পক্ষেই ক্ষতিকর। আমাদের পুরাণে গাছতলায় দেবদেবীর উপাসনাস্থলের যে রূপকটি রয়েছে তাকে সুচতুরভাবে ব্যবহার করেন ধর্ম ব্যবসায়ীরা। ঈশ্বরের প্রাণ প্রতিষ্ঠার নাটকে যায় গাছের প্রাণ।
মন্দিরের দাপট থাকলেও গাছতলায় কোন মসজিদ নেই। এর একটা বড় কারণ হল মসজিদের জায়গা লাগে বেশি। যারা হিন্দুত্ব নিয়ে বেশি সরব আর কথায় কথায় দেশে মসজিদের সংখ্যা ও আয়তন বাড়ছে বলে নানা সংখ্যাতত্ব পেশ করেন তারা কিন্তু গাছের দুর্দশা ও শহরের পরিবেশ ধ্বংস, স্থানীয় মানুষ ও পথচারীদের সমস্যা নিয়ে একটি কথাও বলেন না।
বুদ্ধ কিংবা বিশ্বামিত্র নয়, শহরের গাছতলায় এখন সুচতুর বেওসায়ীদের আনাগোনা। তারাই সেখানে সিদ্ধিলাভ করেন। প্রাণ যায় বৃক্ষের।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত