আমাদের দেশে হতভাগ্য মূর্খ যেন গিজগিজ করছে। কিন্তু তুমি তো ঠাকুর। অথচ তথাকথিত ইস্কুলের গণ্ডিও পার করোনি। তবু এ দেশের তাবড় শিক্ষিত বিদ্বান ব্যক্তিও বলতে গেলে তোমার হৃদয়মথিত চিন্তাভাবনা, শিক্ষাদীক্ষা, দর্শন, আনন্দ-বেদনাময় অনাবিল অগণন সৃষ্টির গহন গভীরে ডুব দিয়েও তলের নাগান পাননি! তুমি যে কী অথবা তুমি যে কে, তাই আমাদের মতো নগণ্য অন্ধ ভক্তরা বোঝার বা জানার ব্যর্থ চেষ্টার শেষে তোমার অফুরন্ত ভাণ্ডারের সামান্য প্রসাদ পেয়েই তৃপ্ত হয়েছি, ক্লান্ত হয়েছি, আবেগে ঝাপসা হয়ে এসেছে দু’চোখ বারেবারেই। তোমার সৃষ্টি তো হে চিরপ্রণম্য, অকূল পাথার! এত গান, কবিতা,গদ্য, পত্রাবলী, এ ছাড়া আরও কত রচনা যে তোমার অপছন্দের তালিকাভুক্ত হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ছিন্নভিন্ন নিশ্চিহ্ন হয়েছে, তার হিসেব আর কে রেখেছে?
বলা যায় রবীন্দ্রনাথের আপন অপছন্দ রচনাসমূহের কোনও তালিকা আমাদের জানা নেই! কারণ সে সব কাটাছেঁড়া করা লেখা নিশ্চয়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে চলে গেছে মহাকালের গহন গহ্বরে। কিন্তু তার বদলে আমরা যাঁকে পেয়েছি, তিনি আর এক রবীন্দ্রনাথ।
একেবারেই ভিন্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে সব রচনার কোনও একটি শব্দ বা পঙক্তি, ছত্র অথবা স্তবক হয়তো তাঁর মনমতন হয়নি, তক্ষুনি তা কেটেকুটে অন্য শব্দ বা স্তবক লিখে ফেলতেন। কোনও পৃষ্ঠায় হয়তো একাধিক কাটাকুটির পর তবেই পদ্য বা গদ্যটি ঠাকুর মশাইয়ের পছন্দ হত। চিরসুন্দরের পূজারী কবি সেই বিক্ষিপ্ত কাটাকুটি ভর্তি পাতাটিকে কী আশ্চর্য সুন্দর করে সাজিয়ে, তুলে দিলেন চিরকালের হাতে। সেই সব কাটাছেঁড়া অংশগুলি অবলীলায় চোখ জুড়ানো ডিজাইনে রূপান্তরিত হল। যেন মডার্ন আলপনা বা রঙ্গোলি-র ডিজাইন!
যত দূর জানা যায়, পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় এই কাটাকুটিগুলি ক্রমশই চিত্তাকর্ষক ডিজাইনের রূপে প্রথম ধরা দিয়েছিল ১৯২৪-এ – কবি যখন রীতিমতো পরিণত বয়স্ক, ষাট অতিক্রান্ত। ভাবুন, যে বয়সে আমরা সাধারণ নশ্বর মানুষ রিটায়ার করে দাওয়ায় বসে গুড়ুক গুড়ুক তামাক খাই – সেই বয়সে এই মহামানবটি কিনা নিজেকে সহসা ‘ডিজাইনার’ তথা ‘শিল্পী’ হিসেবে আবিষ্কার করলেন। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ রচনাকালেই তিনি বাতিল শব্দের কাটাকুটি দিয়ে পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলতে থাকেন। যদিও কবির ড্রইংয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল বালক বয়সেই এবং তা গৃহশিক্ষকের কাছে। অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্কেচও তাঁকে যথেষ্ট আকর্ষণ করত। তবু বিশেষজ্ঞরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ভেতরকার শিল্পীকে প্রথম আবিষ্কার করেন ওই ‘পূরবী’ রচনা-কালেই। তেষট্টির বৃদ্ধ কবি আপন আনন্দে নিজেকেই নবরূপে আবিষ্কার করলেন সেই প্রথম। তার পর ক্রমশ এই ‘নবীন রবি’ উঠেপড়ে কাগজে-রঙে-রেখায় আপন শিল্পকে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন।
রবীন্দ্রনাথ এমনই। বিনা প্রশ্নে আধুনিক ভারতের বিখ্যাততম কবি তিনি। কিন্তু দিগন্তপ্রসারী ও আকাশছোঁয়া স্তুতির পাশাপাশি বেচারির কপালে ব্যজ্জস্তুতি ও প্রকট নিন্দেও কম জোটেনি। তাতে যে রবীন্দ্রনাথের খুব একটা এসে গিয়েছে, তা’ও না। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ টেস্ট রানের গড়ের মতো এও এক দুর্লঙ্ঘ্য মানুষ। কাল ছিলেন, আজ আছেন, আগামীকালও থাকবেন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত