বিশ্বের কাছে সমাদৃত তাঁর লেখনী, তিনি নোবেলজয়ী। ভারতের কাছে তিনি মান, আর আপামর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ আবেগ, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে বেঁচে থাকার, কিংবা বলা ভালো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ প্রদান করেন যিনি। দু’টো স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা তথা বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মৃত্যুর ৭৭ বছর পরেও সমানভাবে সকলের কাছে স্মরণীয় এই তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান– সাহিত্যের কোন শাখায় তার বিচরণ নেই? প্রত্যেকটি শাখাতে তিনি তার নিজস্ব ছাপ রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথকে কিছু বলতে গেলে শেষ হবে না। এখানে তাই তার লেখনীর অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে। তা হল রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারী।
বিশ্ব সাহিত্য জগতে কীটসের পরেই রবীন্দ্রনাথের স্থান। তবে বিশ্বকবি নারীদেরকে কীভাবে উপস্থাপন করতেন, কেমন ছিল তার সময়কার বাঙালি নারীদের অবস্থা! তবে কেবল তার লেখনীতে নয়, তার জীবনেও নারীদের ভূমিকা ছিল। সে কাদম্বরী হোক কি রানু কিংবা ব্রিটিশ প্রেমিকা। জীবনের প্রেক্ষাপটকে তো কাগজে স্থান দিয়েছেনই কিন্তু তার গল্প উপন্যাসেও প্রকাশ পেয়েছে সেকালের নারীদের সংবেদনশীল অবস্থা। যদিও তিনি তার কবিতা, উপন্যাস এবং গানেও নারীদের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তারপরও ছোট গল্পে নারীদেরকে তিনি একটু বিশেষভাবে উপস্থাপন করেছেন। এটা চোখে পড়ার মতো। সুবেদীতা সেখানের প্রত্যেকটি নারীর ভেতরকার সাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের নারীরা সমাজের অন্তর্ভুক্ত যেকোনো অন্যায়ের শিকার হবে। কোনোভাবেই সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ তারা করতে পারে না। মুখ বুঝে সহ্য করে নেয় সব।
যেকোনো সামাজিক রীতিনীতি তাদের মেনে নিতে হয়, সেখানে তাদের নিজস্ব পছন্দ থাকুক বা না থাকুক। যা কিছু নিষিদ্ধ সেগুলো যদি তাদের ভাগ্যে এসে পড়ে সেটা তারা খুব শান্তভাবে মেনে নেয়। সমাজের কুসংস্কার এবং অযৌক্তিক রীতিনীতিকে হাসিমুখে বরণ করে। যত কষ্টই হোক না কেন, তাদের মনের কষ্ট মনেই লুকিয়ে রাখে, প্রকাশ করে না।
এবার আসি মূল বক্তব্যে। রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’র এক চরিত্র নিরুপমা। যৌতুকের কারণে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে ‘দেনাপাওনার’ এই নারী চরিত্র। একজন মেয়ে কম বয়সে যখন নতুন বউ হয়ে আসে তখন ছেলের বাড়ির লোকেদের অবহেলা, তিরস্কার, অপমান বারবার রবীন্দ্রগল্পে চলে এসছে। নিরুপমাও একইরকম বলির শিকার। শেষ পর্যন্ত অবহেলা, অমর্যাদার কারণেই তার মৃত্যু হয় কিন্তু সে নিজের সম্মানটুকু ঠিকই বাঁচিয়ে রেখে মৃত্যুর স্বাদ নেয়।
‘মধ্যবর্তিনী’ আরেকটি ছোট গল্প যেটা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি করা জটিল নারীচরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিবারণ এবং তার দুই সহধর্মিণী হরিসুন্দরী এবং শৈববালা- এই তিনজনকে নিয়ে গল্প এগিয়েছে। নিবারণ ও তার প্রথম স্ত্রী হরিসুন্দরী সুখেই ছিল কিন্তু তাদের কোনো সন্তান ছিল না। হরিসুন্দরী অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিল। স্বামীর অক্লান্ত যত্নে সে আরোগ্য লাভ করে। স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সে সিদ্ধান্ত নেয় যে স্বামীকে যেভাবেই হোক আরেকটি বিয়ে দেবে। হরিসুন্দরীর আশা সেই বিবাহ থেকে তার স্বামী পিতৃত্বের সুখ পাবে যেটা তার কাছ থেকে পায়নি।
‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে বিন্দু আরেকটি চরিত্র যাকে পরিবার এবং সমাজের নিষ্ঠুরতা বাধ্য করেছিল আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে। ‘পোস্টমাস্টারের’ রতন চরিত্রটি এক অনবদ্য সৃষ্টি। স্নেহের টানে রতন নামের মেয়েটির হঠাৎ তরুণী থেকে নারী হয়ে ওঠার গল্প এটি। একজন এতিম এবং গরীব মেয়ের প্রতি স্নেহ ভরা হাত বাড়িয়েছিল পোস্টমাস্টার যেটা কিনা রতনের জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। তার কাছে ছিল সেটা স্বপ্নের মতো। যখন পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লো তখন সেই তরুণী রতন যেন হয়ে উঠল এক পরিপূর্ণ নারী। মাতৃত্ববোধ তার ভেতরে জেগে উঠল। একজন পরিপূর্ণ নারীর মতো স্নেহ ভরা মনে পোস্টমাস্টারের সেবা করেছিল এই রতন। রবীন্দ্রনাথের এক অনবদ্য সৃষ্টি এই চরিত্রটি।
‘বিচারক’-এর ক্ষীরোদা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট এক অন্যরকম গল্প। অন্যান্য গল্পে তিনি সমাজে নতুন বউ যৌতুকের কারণে, কিংবা সমাজের রীতিনীতির কারণে যেসব সমস্যার ভেতর দিয়ে যায় সেগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘বিচারক’ গল্পে তিনি বিধবা বিবাহ নিয়ে কথা বলেছেন। তখনকার সমাজে বিধবা বিবাহকেও যে ভালো চোখে দেখা হতো না সেটা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ক্ষীরোদা চরিত্র দিয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ নিয়ে সামাজিক যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন সেই পরিবর্তন রবীন্দ্রনাথের সময়ও খুব বেশি প্রকাশ পায়নি। ১৯৫৫ সালের দিকে হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ আইন করা হয় এবং সেসময় থেকেই মূলত হিন্দু সমাজে এই বিবাহ মেনে নেয়া শুরু হয়।
রবীন্দ্রনাথের গল্প হোক বা উপন্যাস,…