গর্বের শতবর্ষ, স্পর্ধার শতবর্ষ। ছিন্নমূল বাঙালির লড়াইয়ের শতবর্ষ। গত ২-৩ দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে এরকম কিছু শব্দবন্ধনী আপনার চোখে পড়তে বাধ্য। শুরু হয়েছিল ২৮ তারিখ কুমারটুলি পার্ক থেকে ক্লাব তাঁবু অবধি হওয়া র্যালি দিয়ে। আর তারপর আজ ১লা আগস্ট হল ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ পূরণ। তাই স্বাভাবিকভাবেই লাল-হলুদ দিবস নিয়ে উত্তেজনার রেশ তো থাকবেই। সকাল থেকেই লেসলি ক্লডিয়াস সরণিতে লাল-হলুদ সমর্থকদের দাপুটে উপস্থিতি চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বেলা যত বাড়ল, এই আনন্দ বেড়ে চলল পাল্লা দিয়ে।
সকালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ চৌধুরির বাড়িতে গিয়েছিলেন প্রাক্তন ফুটবলাররা। সেখানে ছিলেন বাইচুং ভুটিয়া, সুভাষ ভৌমিক, অ্যালভিটো ডি কুনহারা। শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকারও ছিলেন। শতবর্ষ উদযাপনের সেলিব্রেশন হিসাবে কেক কাটা হয় সেখানে। পুরো জায়গাটা বিশাল লাল-হলুদ পতাকা ও রং দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছিল। ওড়ানো হল লাল-হলুদ বেলুনও। ঘরের ছেলে বাইচুং। এমন দিনে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না তিনিও। বললেন এবছর একটি ম্যাচ খেলে ক্লাবকে বিদায় জানাবেন তিনি।
তবে অনুষ্ঠানের সেখানেই শেষ নয়। বলা ভালো, সেটাই ছিল শুরু। সন্ধ্যের আসর বসেছিলো নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। সেখানে কে না উপস্থিত ছিলেন! কপিল দেব থেকে শুরু করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বাইচুং থেকে সুনীল, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরুপ বিশ্বাস, কলকাতার মেয়র তথা তৃণমূল মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। ঝটিকা সফরে ঘুরে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এছাড়াও ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের দ্রোণাচার্য প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন ফুটবলাররা। যেন একেবারে চাঁদের হাট বসেছিল এদিনের নেতাজি ইন্ডোরে।
অনুষ্ঠান মঞ্চে তথাগত রায়ের মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন,”ইস্টবেঙ্গলের লোকেরা নাকি শুধু ইস্টবেঙ্গল। ওয়েস্ট বেঙ্গল-ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে ফারাক আছে। এটা শুনে আমি নিজে সবচেয়ে লজ্জিত বোধ করেছি। আমি এপার বাংলায় জন্মেছি বলে এটা নয় যে আমি ইস্টবেঙ্গলকে ভালবাসি না। এটা ইস্টবেঙ্গলের অসম্মান। ফুটবলের কোনও ভৌগলিক সীমারেখা থাকে না। আমি আপনাদের স্যালুট জানাতে এসেছি। ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে এসেছি।” একই সঙ্গে একশো বছর পূর্ণ হওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইস্টবেঙ্গলকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
এদিনের শতবর্ষে ‘ভারত গৌরব’ সম্মান পেলেন বিশ্বকাপজয়ী ভারত অধিনায়ক কপিল দেব। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হল ‘কোচ অব কোচেস’ সম্মান। শতবর্ষে জীবনকৃতি সম্মান পেলেন দুই প্রাক্তন ফুটবলার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। এবছরের বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন লালডানমাওয়াইয়া রালতে। সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য এবং প্রখ্যাত ধারাভাষ্যকার এবং ফুটবল লিখিয়ে নোভি কাপাডিয়া, এই দুই বরেণ্য সংবাদিককে সম্মান জানানো হয়। সংবর্ধনা দেওয়া হয় দুই রেফারি রত্নাঙ্কুর ঘোষ এবং সুনীল মল্লিককে। বিশেষ সম্মান দেওয়া হয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। ‘শতবর্ষের সেরা আবিষ্কার’ খেতাব পেলেন বাইচুং ভুটিয়া। সম্মাননা দেওয়া হয় ভারতীয় ফুটবল দলের বর্তমান অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীকেও।
তবে এদিন সমর্থকদের জন্য সবচেয়ে বড় খুশির খবর ছিল মজিদ বাসকরের ভিডিও বার্তা। আশির বাদশা মজিদ সেখানে বলেছেন, “ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ। ক্লাব ও অসংখ্য সমর্থককে শুভেচ্ছা। শীঘ্রই কলকাতা আসছি।” নেতাজি ইন্ডোরে সেই ভিডিও দেখানো হয় মূল অনুষ্ঠানের শুরুতেই। জানা যাচ্ছে, আগামী ১১ আগস্ট তিনি কলকাতায় আসছেন। ইতিমধ্যে তাঁর হাতে পৌঁছে গিয়েছে বিমানের টিকিট। এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। দীর্ঘদিন ধরে ভিসা সমস্যায় তাঁর এদেশে আসা আটকে ছিল। কিন্তু সেই সমস্যা আপাতত মিটে গেছে। ইরান থেকে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন মজিদ বাসকর ও জামশেদ নাসরি। তাদের ফুটবল দক্ষতা তখনই নজর কাড়ে সকলের। সেখান থেকেই ইস্টবেঙ্গলে আগমন। আর তারপরই মজিদ ম্যাজিকে আবিষ্ট হয়ে যায় কলকাতা ময়দান। সেই মজিদ আবার আসছেন তাঁর প্রিয় শহরে। আর প্রিয় ফুটবলারের জন্যে অসীম উষ্ণতা নিয়ে অপেক্ষায় ফুটবলের মক্কাও।