‘কেয়া হুয়া, তেরা ওয়াদা’, ‘লিখে যো খত তুঝে’, ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিলকো’ এই সমস্ত গানগুলো আজও বহু মানুষের ফোনের প্লে-লিস্টে স্থায়ী ভাবে থাকে। বিভিন্ন রেডিও চ্যানেল এই গানগুলোকে আজও অন এয়ার করে। যে সময়ে খুব কম গানই মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে, সেই সময়ে এতগুলো দিন পরেও স্বর্ণযুগের গান নিয়ে সঙ্গীত প্রেমী মানুষের মনে চির অমর হয়ে রয়েছেন মহম্মদ রফি। সশরীরে না থেকেও আজও তিনি উজ্জ্বল উপস্থিতিতে রয়ে গেছেন। আজ এই মহান শিল্পীর ৩৯ বছরের মৃত্যুবার্ষিকী। তবে মৃত্যুর এত বছর বাদেও তিনি তাঁর সৃষ্টিতে উজ্জ্বল।
তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব এলাকার অমৃতসর গ্রামের কাছাকাছি কোটলা সুলতান সিংয়ের অধিবাসী হাজী আলী মোহাম্মদের ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন মহম্মদ রফি। সঙ্গীত শিল্পী রফি’র ডাক নাম ছিল ফিকো। তাঁর নিজ গ্রামে এক ফকিরের ভজন গানকে অনুকরণ করে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি।জীবিকার সন্ধানে তাঁর বাবা হাজী আলী মোহাম্মদ ১৯২০ সালে লাহোরে চলে যান এবং ভাট্টি গেটের নূর মহল্লায় একটি সেলুনের মালিক হন।
তাঁর বড় ভাই মোহাম্মদ দ্বীনের বন্ধু আবদুল হামিদ লাহোরে অবস্থানকালীন সময়ে রফি’র সঙ্গীত প্রতিভা দেখে তাঁকে গান গেতে সাহস জুগিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রফি’র শ্যালক হয়েছিলেন। আবদুল হামিদ পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিবারের বড়দের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে তাঁকে মুম্বাই পাঠান। ১৯৪৪ সালে রফি বোম্বেতে গেলে সঙ্গী হিসেবে তাঁর সাথে আবদুল হামিদও গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবনলাল মত্তো এবং ফিরোজ নিজামী’র মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন।
১৩ বছর বয়সে রফি লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে এল সাইগলের সঙ্গে জীবনের প্রথম শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে গান পরিবেশন করেন। ১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের নির্দেশনায় লাহোরে চলচ্চিত্রের গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র গাও কি গৌরী চলচ্চিত্রে গান করেন। ১৯৪৯ সালে নওশাদ (চাঁদনী রাত, দিল্লাগী, দুলারী); শ্যাম সুন্দর (বাজার); হুসনলাল ভগতরাম (মীনা বাজার) প্রমুখ সঙ্গীত পরিচালকের নির্দেশনায় একক সঙ্গীতে অংশ নেন। রফি তখনকার বেশিরভাগ নামকরা সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর মধ্যে আছেন- নওশাদ, ও পি নায়ার, শঙ্কর জয়কিষাণ ও শচীন দেব বর্মণ।
রফি লায়লা-মজনু (১৯৪৫) এবং জুগনু চলচ্চিত্রে সংক্ষিপ্তভাবে, অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। লায়লা-মজনু চলচ্চিত্রে ‘তেরা জ্বালা’ কোরাস গানে তাঁকে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে গাইতে দেখা যায়। তাঁর প্রতিটা গানই অসাধারণ কৃতিত্বের দাবি রাখে যে কারণে সেই সমস্ত গান আজও এতদিন বাদেও এতটা বেঁচে আছে প্রতিটা মানুষের মনে।
‘ইয়াহু! চাহে কোই মুঝে জাংলী কাহে’ গানটি ছিল একমাত্র গান যাতে দ্রুতলয়ের অর্কেষ্ট্রা ঘরাণার গান করেছেন রফি। কিশোর কুমারের পরিবর্তে রফিকে সারারাত ছবিতে আজব হ্যায় দাস্তান তেরী ইয়ে জিন্দেগী গানে অন্তর্ভুক্ত করেন শঙ্কর জয়কিষাণ। মোহাম্মদ রফি তাঁর সঙ্গীত নির্দেশনা ও পরিচালনায় সর্বমোট ৩৪১টি গান গেয়েছিলেন, তার মধ্যে ২১৬টি গানই ছিল একক সঙ্গীতের। বসন্ত বাহার, প্রফেসর, জাংলী, সুরজ, ব্রহ্মচারী, এ্যান ইভ্নিং ইন প্যারিস, দিল তেরা দিওয়ানা, ইয়াকিন, প্রিন্স, লাভ ইন টোকিও, বেটি বেটে, দিল এক মন্দির, দিল আপনা আউর প্রীত পারাই, গবন এবং জব পেয়ার কিসি সে হোতা হে ছবিগুলোতে তার গান রয়েছে।
জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মান্না দে রফি সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ‘তিনি সকলের চেয়ে সেরা গায়ক ছিলেন। রফি এবং আমি সকল স্তরের গানই গেতে পারি এবং তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন ভদ্রলোক। তিনি আমার চেয়েও সেরা গায়ক ছিলেন এবং আমি অবশ্যই বলবো যে, কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি যখনই যা চেয়েছেন, তা-ই করতে পেরেছেন। আমরা সকলেই একবাক্যে ও কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্বীকার করি’।
মানুষ মাত্রেই মরণশীল। তবুও কিছু কিছু মানুষের শুধু দেহের মৃত্যু ঘটলেও তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁরা আজীবন বেঁচে থাকেন। রফিও এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, তাঁর গাওয়া গানেরা আজও তাঁর মতই জীবন্ত। এভাবেই ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে চির দীপ্তিময় এক অধ্যায় থেকে যাবেন স্বর্ণযুগের অন্যতম গায়ক মহম্মদ রফি।