ছাত্র রাজনীতি দিয়ে হাতেখড়ি তারপর নিজের যোগ্যতা দিয়ে বহু বাধা পেরিয়ে আজ তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। একদা তিনি ছিলেন বিরোধী দলের নেত্রী। পরে রেলমন্ত্রী। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা দেশের কাছে ‘দিদি’ নামেই পরিচিত। ‘দিদি’ নিজের দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যান সর্বদাই। এইবার সেই কাজ আরও মজবুত করতে উদ্যোগী মমতা। সেই ‘দিদি’তে আস্থা রেখেই তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী রাজ্যবাসীর আরও কাছে পৌঁছে যেতে চাইলেন ‘দিদিকে বলো’র মতো কর্মসূচির মাধ্যমে।
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আশা, মনের ক্ষোভ উগরে দেওয়ার জন্য ‘দিদিকে বলো’র চেয়ে ভালো ব্যবস্থা কিছু হতে পারে না। গণজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ তপতী বসুও মনে করেন, ‘দিদির মতো আবেগঘন শব্দ ব্যবহার করে মমতা আসলে বার্তা দিতে চেয়েছেন, বাংলার দিদি তো তিনিই। তাই তিনিই সুরাহা করবেন।’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ও মাস কমিউনিকেশনের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান তপতীর কথায়, ‘বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের পরেই দিদি। মা-এর পরেই এই শব্দটি বাংলা ও বাঙালির কাছে স্নেহ, মমতা, ভরসার প্রতীক। প্রচারের এই কৌশল সারা পৃথিবীতেই পরীক্ষিত। জনমানসে এর প্রভাব পড়ে ব্যাপক।’ একই সঙ্গে তপতী মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বের অনেক জায়গায় এই পদ্ধতির কমিউনিকেশন ব্যর্থও হয়েছে। তার কারণ, বার্তাবাহকের ভাবমূর্তি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই মমতার বার্তা বাংলার ঘরে ঘরে যাঁরা পৌঁছে দেবেন, তাঁদের ভাবমূর্তি এলাকায় পরিচ্ছন্ন হওয়া জরুরি কর্মসূচির সাফল্যের জন্যই।
সাহিত্য জগতের দিকপাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, এই কর্মসূচির নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সার্থকতার বীজ। কেননা, বঙ্গবাসীর কাছে দিদি এমন একটি শব্দ যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ভরসা, ভালোবাসা, আবেগ, আশ্রয়ের পরশ। দিদি এমন একটি সম্পর্ক যা প্রায় মাতৃরূপের সমতুল। এবং সেই সম্পর্কের বাঁধন বাঙালি সমাজ ছাপিয়ে এখন সর্বভারতীয়। ফলে বঞ্চিত মানুষ তাঁর অভিযোগ নিরসনের জন্য যেখানে যোগাযোগ করবেন, তা যদি দিদিকে বলা হয়, তা হলে সেই নালিশের মধ্যেও থাকবে নরম মনোভাব। পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মতে, ‘দিদি আদতে একটি বঙ্গদেশজ শব্দ। বাংলায় এর যা অর্থ, তার মধ্যে রয়েছে ভরসা আর আন্তরিকতার মিশেল। আমার বিশ্বাস, নয়া এই কর্মসূচির নামকরণে এত ঘরোয়া মিষ্টি শব্দের ব্যবহার সাধারণ মানুষের মনের গহনে পৌঁছে যাবে।’
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও একমত। তাঁর কথায়, ‘সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যেমন দাদা, মমতা তেমনই সারা দেশের দিদি। প্রধানমন্ত্রীও যখন দিদি সম্বোধন করেন, সকলে বুঝে যান, তিনি আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশেই বলছেন। অভিযোগ নিরসনের কর্মসূচির নাম ‘দিদিকে বলো’র চেয়ে ভালো কিছু হতে পারত না বোধ হয়। কেননা, দিদি শব্দটাই এ ক্ষেত্রে মানুষকে কাছে টানবে, ভরসা জোগাবে।’ কর্মসূচিকে সার্থকনামা আখ্যা দিচ্ছেন আর এক সাহিত্যিক আবুল বাশারও। তিনি বলেন, ‘দিদি সম্পর্কটা অভিভাবকসম। বাংলা সাহিত্যেও এই শব্দটা মমতার, সম্মানে, মায়ার। সে শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’ হোক বা ‘শ্রীকান্তে’র অন্নদাদিদি। যতীন্দ্রমোহন বাগচির ‘শোলোক বলা কাজলাদিদি’কে তো অমর করে দিয়েছে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়কী। অভিযোগ নিরসন কর্মসূচির নামকরণের ক্ষেত্রে এত ভালো শব্দচয়ণ আর কিছু হয় না।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে তৃণমূল স্তরে গিয়ে সবসময় দরদী হয়ে উঠেছেন তার প্রতিফলন সবসময় দেখা গেছে। ‘দিদি’ ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছে সর্বদা। তাতে পাশে পেয়েছেন অসংখ্য গুণী ব্যক্তিদের।