আগে বহুবারই বাংলা তথা রাজ্য সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু লোকসভা ভোটের পর রাজ্য জুড়ে গেরুয়া সন্ত্রাসের শুরু হওয়া ইস্তক হঠাৎ করেই বদলে গিয়েছে তাঁর সুর। বিজেপির গুণ্ডাবাহিনীর তাণ্ডবের ঘটনাতেও আকারে-ইঙ্গিতে সরকারকেই দুষেছেন তিনি। তবে এবার তিনি পার করেছেন শোভনীয়তার সকল মাত্রা। হ্যাঁ, বিদায়লগ্নে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর বিভিন্ন মন্তব্য ঘিরে এখন তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে রাজ্যে। যে ভাবে তিনি চাঁচাছোলা ভাষায় রাজ্যের শাসকদলকে একহাত নিয়েছেন, ছেড়ে কথা বলেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও, তাতে তৃণমূলের তরফে যে নিন্দা করা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তা হয়েওছে। কিন্তু পাশাপাশি, বিদায়ী রাজ্যপালের মন্তব্যের সমালোচনায় সরব হয়েছে নাগরিক সমাজও।
শনিবারই রাজভবনে রাজ্যপালের কুর্সিতে বসেই মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ‘বিরোধীদের কথা শোনেন না’, ‘ওঁকে সংযত হতে হবে’, ‘তোষণের রাজনীতি করছেন’ ইত্যাদি বলে অভিযোগ করেছিলেন ত্রিপাঠী। সরকারি আধিকারিকদের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। এই সব কথা বলার জন্যই রবিবার, আনুষ্ঠানিক বিদায়ের দিন তাঁর সমালোচনা হয়েছে রাজ্যের সর্বস্তরে। অধিকাংশেরই বক্তব্য, বিদায়ের সময়ে এমন আচরণ শুধু কুরুচিকরই নয়, রাজ্যপালের চেয়ারের মর্যাদাকেও ভূলুন্ঠিত করার সমতুল্য। যদিও গতকাল সন্ধ্যায় ‘বাংলা থেকে ভালো স্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি’ বলে কিছুটা ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করেন বিদায়ী রাজ্যপাল। তবে ততক্ষণে তাঁর ভাবমূর্তির যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গিয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় ত্রিপাঠী রাজভবন ছেড়ে হাওড়া স্টেশন যান। এবং সেখান থেকে কালকা মেলে তিনি প্রয়াগরাজের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার আগে প্রথামাফিক তাঁকে বিদায় জানান রাজভবন ও রাজ্য সরকারের পদস্থ আমলা-আধিকারিকরা। যদিও রেওয়াজের তোয়াক্কা না করে কেশরীনাথ রাজভবন ছাড়ার প্রাক্কালে বেনজির ভাবে কোনও বিদায়ী বার্তা (ডিপার্চার মেসেজ) দেননি। ফলে সৌজন্যের বাতাবরণ লঙ্ঘিত হয়েছে বলে এ ক্ষেত্রেও সুর চড়িয়েছে সমালোচকরা। অধিকাংশেরই বক্তব্য, রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধ কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু বিদায়বেলায় সে সব তেতো ব্যাপার টেনে আনেন না কোনও রাজ্যপালই।
অথচ রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের চেয়ারে থেকেও কেশরীনাথের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাই হল। রাজভবন ছাড়ার আগেও তিনি মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে যে সব বিরূপ মন্তব্য করেছেন, তাকে তাই ভালো চোখে দেখছেন না বুদ্ধিজীবীরাও। যেমন অভিনেতা কৌশিক সেন বলেন, ‘উনি তো বিজেপিরই লোক। তৃণমূলের সমালোচনা ওঁর মুখে স্বাভাবিক। কিন্তু বিদায় বেলাতেও! শেষলগ্নে এমন রাজনৈতিক বক্তব্য অশোভন। রাজ্যের অশান্তির নেপথ্যে বিজেপির ভূমিকাও কম নয়। উনি তো তৃণমূলের পাশাপাশি বিজেপির সমালোচনাও করতে পারতেন।’ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের কথায়, ‘আমরা যারা গণতন্ত্রের সৌন্দর্যায়নে বিশ্বাস করি, তাদের কাছে এ ধরনের জিনিস কখনওই কাম্য নয়।’ আবার নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্রও বলেন, ‘এখন সব কিছুতেই এমন চূড়ান্ত একটা রূপ দেখি। আগে কখনও এমন দেখিনি।’
উল্লেখ্য, বাম জমানার শেষ দফায় তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের তুমুল বিরোধ সত্ত্বেও বিদায়বেলায় সব কিছু ভুলে সৌজন্যের বার্তাই দিয়েছিলেন জাতির জনকের বংশধর। নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনাকে ‘হাড়হিম করা সন্ত্রাস’ আখ্যা দিয়েছিলেন গোপালকৃষ্ণ। ২০০৭-র ৭ নভেম্বর সিপিএমের নন্দীগ্রাম পুনর্দখল ঘিরে যে ‘সূর্যোদয়’ হয়েছিল, সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও তিনি নজিরবিহীন সমালোচনা করেছিলেন শাসক বামফ্রন্টের। কিন্তু মেয়াদ শেষে রাজভবন ছাড়ার আগে বিদায়ী বার্তায় তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন। রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজের আক্ষেপ, কেশরীনাথের ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এমনটা হল না।