বলটা ক্রিজের মাঝখানে পড়ে ব্যাটসম্যানের চুম্বন দিয়ে কখন যে স্টাম্পটা উড়িয়ে দিয়েছে বুঝতেই পারেননি ব্যাটসম্যান। হতবাক হয়ে একবার নিজের ব্যাট ও উইকেট দেখে প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটা শুরু করে দিয়েছেন তিনি। আর ততক্ষণে দুহাত প্রসারিত করে এক চেনা দৌড় শুরু হয়ে গেছে বোলারের। এইরকম ভেল্কির শিকার হয়েছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যান। আর ইমরান তাহিরের ‘বুড়ো হাড়ের ভেল্কি’-তে মজেছেন বিশ্ববাসী। এই বিশ্ববিখ্যাত লেগ স্পিনার এই বিশ্বকাপের মধ্যে দিয়েই শেষ করলেন তাঁর ক্রিকেট জীবন। এখন তাঁর অবসরের সময়। ৮ বছরে সাদা বলে ব্যাটসম্যানদের কাছে ত্রাস ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই লেগি।
বিশ্ববাসী যেমন তাঁর অনবদ্য স্পেল, উদ্দাম প্রাণশক্তি, উইকেটের খিদে, রহস্যময় ঘূর্ণি মিস করবেন, তেমনই দক্ষিণ আফ্রিকা সাদা বলে তাঁর অভাব অনুভব করবে প্রতি নিহত। ইনিংসের মাঝের ওভারে রান আটকে দেওয়া থেকে শুরু করে সেট ব্যাটসম্যানের উইকেট তুলে নেওয়া সব ক্ষেত্রেই তাহিরের সাফল্যের ওপর নির্ভর করত দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই নির্ভরযোগ্য স্তম্ভকে বল হাতে আর দেখা যাবে না। নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সর্বমোট ১৭২ উইকেট আছে তাঁর ঝুলিতে। যা এত কম সময়ে সত্যিই অভাবনীয়। ফ্ল্যাটার, কুইকার ট্র্যাজেক্টরি, বিগ লেগব্রেক, কিংবা গুগলিকে স্টক বলে রূপান্তর করা। এর পাশাপাশি নিজের ‘রহস্য ডেলিভারি’ তো রয়েছেই। এ সবকিছুই সাদা বলে পূর্ণতা পেয়েছে তাহিরের হাত ধরে।
দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়করা যখনই দেখেছেন উইকেটের প্রয়োজন তখনই বল তুলে দিয়েছেন ‘বৃদ্ধ’ তাহিরের হাতে। সেই ভরসার হাত ধরে সাফল্যও এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ জেতাতে সর্বদাই অন্যতম ভূমিকা পালন করছেন তিনি। পরিসংখ্যান বলছে, নিজের ক্যারিয়ারের তিনি ৭৮.৫ শতাংশ উইকেট পেয়েছেন জেতা ম্যাচে, যেটি কি না দক্ষিণ আফ্রিকান বোলার হিসেবে নতুন রেকর্ড। ওয়ানডে ম্যাচেই ১০০ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সবচেয়ে দ্রুত এই মাইলফলক অর্জন করেন তাহির। পাশপাশি দ্রুততম ১৫০ উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রেও কিংবদন্তি অ্যালান ডোনাল্ডকে স্পর্শ করেন এই লেগি।
যখন ক্রিকেটারদের খেলার জীবন প্রায় শেষের দিকে চলে যায় সেই বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ করেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই তারকা। ২০১১ সালে ৩২ বছর বয়সে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক ঘটে তাঁর। তারপর একের পর এক ম্যাচে সাফল্য এনে দেয় তাঁকে। বিশ্বকাপে তাঁর দল সাফল্য না পেলেও বিশ্বকাপে তাঁর পারফরম্যান্স চোখে পড়ার মত। বিশ্বকাপে তাহির ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৪ বার। এছাড়াও ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ৪৫ রানে ৭ উইকেটের স্বপ্নের স্পেল সবার মননে থাকবে আজীবন। আর এই ৭ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড অন্য কোনো দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারের নেই।
তবে ক্যারিয়ারকে এভাবে গড়তে পারা দূরে থাক, তাহিরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটাও স্বপ্নই থেকে যেত একসময়। লাহোরে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটারের ছোট থেকেই বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে। সেখানেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি। সেখান থেকে ভাগ্যের পালাবদলের জন্য পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়, যেটি মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। সেই কঠিন পথ অতিক্রম করেছেন তিনি। নিজের পরিশ্রম ও প্যাশনের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনারের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। বিশ্ববাসীর স্মরণে থেকে যাবে তাঁর বলের ঘূর্ণি, উইকেট পাওয়ার পর তাঁর মাঠে দুহাত ছড়িয়ে পাখির মতো উড়ে যাওয়া।