নিজেদের তৈরি রেকর্ড ভাঙাটাই ফি বছর অভ্যাসে পরিণত করেছে তৃণমূলের একুশে জুলাইয়ের শহীদ দিবসের সমাবেশ। তবে এবারের একুশ ছিল ‘নতুন লড়াই’য়ের একুশ। হ্যাঁ, লোকসভায় ১২টি আসন খুইয়ে তৃণমূলের সাংসদ এখন ২২ আর বিজেপি এ রাজ্যে ২ থেকে সাংসদ সংখ্যা বাড়িয়ে এখন ১৮! সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে একেবারে সমানে সমানে টক্কর না হলেও গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে এখন থেকেই জোরদার লড়াই শুরু করতে হবে, তা বিলক্ষণ জানেন দুঁদে রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাই ২৬ বছর আগের পুরনো অস্ত্রেই নতুন করে শান একুশে জুলাইয়ের মঞ্চকে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং ২১’-এর ভোটযুদ্ধের জন্য দলের সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী।
একটি বিখ্যাত হিন্দি ছবির সংলাপ, ‘হারকার জিতনেওয়ালোকো হি বাজিগর ক্যাহতা হ্যায়’। তৃণমূল না হারলেও এবারের ভোটযুদ্ধে আগের তুলনায় তাদের আসন কমেছে। তাই এই সময়ে প্রয়োজন ছিল কামব্যাকের। আর ইতিহাস সাক্ষী, খারাপ সময় থেকে তুমুলভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে যে কামব্যাক করতে পারে, তাঁর নামই লেখা থাকে স্বর্ণাক্ষরে। মমতা কি পারবেন সেই ‘কামব্যাক’ ঘটাতে? বিগত কয়েকদিনে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল রাজ্য রাজনীতির অন্দরে। তবে গতকাল গোটা ধর্মতলা, টিভির পর্দা, সোশ্যাল মিডিয়া সব জায়গাতেই আজ একটা কথা স্পষ্ট, মমতার ভাষণ পালটে গেছে। এক নতুন রূপে কামব্যাক করেছেন তিনি।
কারণ রবিবার মমতা ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে হাঁটেনইনি। বরং আক্রমণ করেছেন সংগঠিতভাবে। ঝাঁঝ বাড়িয়েছেন দ্বিধাহীন গতিতে। যা দেখে গতকাল তৃণমূলের অনেক নেতাই বলছিলেন, ‘আজ যেন সেই বাম আমলের অগ্নিকন্যাকে দেখলাম। বল পেলাম বুকে। ফিরে গিয়ে জেলায়-জেলায় এবার রুখে দাঁড়াতে হবে। বিজেপিকে ছেড়ে কথা বলব না।’ তবে প্রতিটি কর্মীই যেমন এই মমতাকে দেখে, তাঁর ভাষণে উদ্বুদ্ধ, তেমনি কর্মীদের পাশেও দ্ব্যর্থহীনভাবে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী। কাটমানি নিয়ে যে বিজেপি সচতুর রাজনীতিতে নেমেছে, তাঁদের দিকে পালটা আক্রমণের অস্ত্র দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ওরা বলছে কাটমানি ফেরত দাও, ওরাই তো সবচেয়ে বড় চোর। আমি নতুন কর্মসূচি নিচ্ছি, ব্ল্যাক মানি ফিরিয়ে দাও।’ বলেছেন, ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব ওদের।’
প্রসঙ্গত, কলকাতায় যে কোনও রাজনৈতিক দলের বড় সমাবেশ মানেই ভিড়ের একটা বড় অংশ ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা দর্শনে। ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা, গড়ের মাঠ… না, এবারের ভিড় কিন্তু অন্যান্য বারের মতো ছিটকে বেরিয়ে যায়নি ধর্মতলা থেকে। বরং মমতা-চুম্বকের আকর্ষণে বসে থেকেছে অপেক্ষায়, দেখার-শোনার-শক্তি সঞ্চয়ের অভিপ্রায় নিয়ে। তাই তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে চাঁদিফাটা রোদেও একচুলও সরেননি প্রতিটি জেলা থেকে আসা বিশাল জনস্রোত। তাই ভিক্টোরিয়া হাউসের থেকে অনেকটা দূরে লিন্ডসে স্ট্রিটের সামনে দাঁড় করানো পেল্লাই জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনেও ছিল কয়েকশো মাথার ভিড়। কেউ বা রোদ বাঁচতে ছাতা মাথায়, কেউ বা এমনিই। ঘামছে শরীর, তবু মনের বল ভাঙছে না।
উল্লেখ্য, বিজেপি বলেছিল, রবিবার কলকাতায় ‘সার্কাস’ হবে। বাস্তবে কিন্তু এবারের একুশে জুলাই তৃণমূলের জন্যে আপাতভাবে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার উপহার দিয়ে গেল। কর্মীদের উপস্থিতি দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাসী করল নেত্রীকে, আর নেত্রী স্বপ্ন দেখালেন কর্মীদের। তবে শুধুই আবেগের ফল্গুধারা নয়, মমতা পথ দেখিয়েছেন পথের দিকেই। বলেছেন, ‘ঘরে বসে কখনই রাজনীতি করা যাবে না। রাস্তাই আমাদের রাস্তা দেখাবে।’ আসলে রাস্তা থেকেই উঠে এসেছেন তিনি। রাস্তার প্রতিটা বাঁকই তাঁর চেনা। তাই খোদ নিজেই সারথী হয়ে দলের রথী-মহারথী-যোদ্ধাদের চিনিয়ে দিতে চাইছেন সেই অন্ধকার অলিগলি। যার শেষে আসলে আলো থাকে। আর ঠিক সেই সময়ই সমাবেশে আগত লাখ লাখ মানুষ দেখলেন, ডানা মেলছেন বাংলার অগ্নিকন্যা। নীল দিগন্তের দিকে উড়ে চলেছে একটা ফিনিক্স।