মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করেন সাংবাদিকরা আর তাদের ক্লাবেই বিগত ৭৫ বছর ধরে ঘটে চলেছে সতীর্থদের অবমাননা। যাদের নাহলে সংবাদপত্র জগৎ চলেনা, সম্পূর্ণ হয়না খবর, সেই চিত্রসাংবাদিকরা চূড়ান্ত অবহেলিত ও অপমানিত হয়ে চলেছেন কলকাতার প্রেস ক্লাবে। বড় কাগজের মুখচেনা হাতে গোনা কয়েকজন চিত্রসাংবাদিককে ক্ষমা ঘেন্না করে অ্যাসোসিয়েটেড মেম্বার করা হলেও তাদের কোন ভোটাধিকার নেই। ক্লাব কর্তৃপক্ষ নিতান্ত দয়া করে তাদের ক্লাবে ঢোকার অনুমতি এবং খাদ্য ও পানীয় কেনার সুযোগ দিলেও কোন পেশাগত স্বীকৃতি দেননি। ক্লাবের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। কারণ ক্লাবের মান্ধাতার আমলের গঠনতন্ত্র বা সংবিধান অনুযায়ী তারা সাংবাদিক নন তাই ক্লাবের সদস্য হওয়া বা ভোট দেওয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।

কলকাতা প্রেস ক্লাব যেন চিত্রসাংবাদিকদের জন্য একটা নিষিদ্ধ নগরী। ১৯৪৫ সালে ক্লাবের জন্মলগ্ন থেকে এই নিয়ম চালু হয়েছে। কী কারণে এই নিয়ম চালু হল তা কেউ জানেন না। ক্লাবের প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তাদের বারবার জিজ্ঞাসা করেও আমি এই প্রশ্নের কোন উত্তর পাইনি। রাস্তার ধারের গণৎকারদের টিয়াপাখির �মতই তারা সব প্রশ্নের জবাবে ঠোঁটে তুলে ধরেন একটা খাম, যাতে লেখা আছে -� এটাই ক্লাবের নিয়ম। যাদের কলম সমাজ সংসারের সব জায়গায় আলো ফেলে তাদের রাজ্যে কেন এত অন্ধকার তার কারণ বোঝা কঠিন! এই কারণেই পুরনো আমলের দিকপাল চিত্রসাংবাদিকরা ক্লাব প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই ক্লাব থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রেস ফটোগ্রাফারস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া নামে একটা আলাদা সংগঠন গড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। একটা সিদ্ধান্তের ভুলের জন্য একই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা দুটি সংগঠনে ভাগ হয়ে গেলেন, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
এই ৭৫ বছরের কালপর্বে আমাদের দেশের সংবিধান ১০৩ বার সংশোধিত হয়েছে কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের অযৌক্তিক বৈষম্যমূলক নিয়মের কোন পরিবর্তন ঘটাননি তা যেন আত্মার মতই অজড়-অমর-অক্ষয়। চিত্রসাংবাদিকরা যে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, সংবাদের পৃথিবীতে একটা নেহাতই এলেবেলে ব্যাপার তা কয়েক বছর আগে আরও অনেক বেশি প্রকট ছিল। আমরা কাজের শেষে ক্লাবে গিয়ে ড্রিঙ্কস বা খাবার অর্ডার দিতে পারতাম অন্য কোন সদস্য সাংবাদিকের গেস্ট হয়ে। বহু ক্ষেত্রে তারা হতেন সদ্য কাজে যোগ দেওয়া কোন জুনিয়র সাংবাদিক। ৭৫ বছর ধরে চিত্রসাংবাদিকরা শুধু গেস্ট হয়েই রইলেন।
সমান অধিকার দিয়ে কেউ ক্লাবের তাঁবুতে ডেকে নিলেন না আমাদের। ৭৫ বছর পূর্তি উৎসবে ক্লাব প্রাঙ্গণ যখন আলোয় ঝলমল করবে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি, ক্লাব সদস্যদের নানা ইভেন্ট, পানভোজন এবং আড্ডায় গমগম করবে তখনও আমরা ব্রাত্যই থেকে গেলাম। মাঝেমধ্যে মনে হয়, একটা মই নিয়ে ক্লাবের টেন্টের ওপরে উঠে প্রেস শব্দটা সরিয়ে রিপোর্টার শব্দটা বসিয়ে দিই। এটা শুধু আমার কথা নয়, সব চিত্রসাংবাদিকদেরই মনের কথা। সত্যি এই ক্লাবটা তো শুধুই রিপোর্টারদের। অথচ আজকের সংবাদপত্র জগতে রিপোর্টার আর চিত্রসাংবাদিকরা তো একই বৃন্তে দুটি কুসুম। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স, ডিজিটাল সব মিডিয়াই তো ক্যামেরা ছাড়া অচল। �
সেদিন এক সিনিয়র ফটোগ্রাফার দুঃখ করে বলছিলেন, ৭৫ বছরে ক্লাব শুধু রিপোর্টারদের গিফট দেবে, আমাদের চিত্রসাংবাদিকদের সংবাদ জগতে কি কোন অবদান নেই? আমরা কি কিছু পেতে পারতাম না? ইতিহাসকে অদৃশ্য করে দেওয়ার এমন ঘটনা কলকাতা প্রেস ক্লাব ছাড়া অন্য কোথাও ঘটেনা। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, কেরালা, ত্রিপুরা সহ দেশের সব ছোট বড় শহরের প্রেস ক্লাবে রিপোর্টার ও চিত্রসাংবাদিকদের সমান অধিকার। তারা সবাই ক্লাবের সদস্য হতে পারেন। এমনকি আমাদের জেলার প্রেস ক্লাবগুলিতেও একই নিয়ম। ব্যতিক্রম হিসেবে জেগে আছে শুধু কলকাতা প্রেস ক্লাব।
আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী ২৩শে জুলাই ক্লাবের আমন্ত্রণে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তিনি যদি বর্তমান কমিটিকে ক্লাবের গঠনতন্ত্র বা সংবিধান সংশোধন করে চিত্রসাংবাদিকদের সাধারণ সদস্যের মর্যাদা দিতে অনুরোধ করেন তাহলে আমরা সন্মানের সঙ্গে পথ চলতে পারবো। ক্লাবের ৭৫তম বর্ষে একটা বড় ভুল শুধরে নেওয়া যাবে। একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে বর্তমান কমিটি। স্বীকৃতি পাবে চিত্রসাংবাদিকদের নুন্যতম অধিকার। কাজের নিরাপত্তাহীনতা ও আর্থিক বঞ্চনা তো সাংবাদিকদের আছেই, আমরা শুধু চাইছি �আমাদের সন্মান ও স্বীকৃতিটুকু একটু বাঁচার মত পরিসর পাক। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখবেন বলে আমরা আশা রাখি।
অতীতের ভুল শুধরে ৭৫তম বর্ষে নতুন রাস্তায় হাটা শুরু করুক প্রেস ক্লাব, কলকাতা। চলার পথে আমাদের ডেকে নিলে আপনাদেরই গৌরব বাড়বে।
জানালা খুলে দিন, আলো আসুক।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত