সবদিক দিয়ে তলিয়ে না ভেবে, দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা না করেই এক বড়সড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে মোদী সরকার। বাজেটেই এ কথা স্পষ্ট যে, এবার বিদেশি লগ্নিকারীদের থেকে ডলারেই ঋণ নেওয়ার পথে হাঁটতে চলেছে কেন্দ্র। পরে যার ফল ভুগতে হতে পারে দেশকে। এ নিয়ে আগেই অর্থনীতিবিদদের মহলের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল মোদী সরকারকে। আর এবার বিদেশ থেকে ডলারে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আপত্তি উঠল সঙ্ঘ-পরিবারের মধ্যে থেকেই। আরএসএসের সংগঠন স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ রীতিমতো বিবৃতি জারি করে জানিয়ে দিল, এই পদক্ষেপ বিপজ্জনক হতে পারে।
মঞ্চের যুগ্ম-আহ্বায়ক অশ্বিনী মহাজনের মতে, কম সুদ মেটাতে হবে ভেবে বিদেশ থেকে ধার করতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, মেক্সিকো-র মতো ঋণের বোঝার ফাঁদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ারও ঝুঁকি বাড়বে। শুধু তা-ই নয়। মহাজন মনে করিয়ে দিয়েছেন, গত অর্থ বছরে সরকারের অনুমানের তুলনায় কর বাবদ আয় অনেক কম হয়েছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বাজেটে সে কথা স্বীকার করেননি। তবে ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কথাই আউড়েছেন।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সরকার বিদেশে সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত বন্ড ছেড়ে ডলারে ঋণ করবে। কম সুদে ঋণ পেতেই এই পরিকল্পনা। আমলারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থ বছরের ৭ লক্ষ কোটি টাকা রাজকোষ ঘাটতির প্রায় ১০ শতাংশ বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া হবে। অর্থাৎ, ডলারের বর্তমান দর হিসেব করলে তা দাঁড়ায় প্রায় হাজার কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম দফায় জল মাপতে ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হবে বলে অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর।
মোদী সরকারের এই পরিকল্পনা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন রঘুরাম রাজন, সি রঙ্গরাজনের মতো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নরেরা। রঘুরামকে সমর্থন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রথীন রায়। রঘুরাম বলেন, বিদেশি ব্যাঙ্কের কর্তারা এসে অর্থ মন্ত্রকে বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নিতে সওয়াল করে। কারণ এতে তাদের লাভ। অশ্বিনী মহাজনেরও দাবি, সরকারের মধ্যে কারা এই সব সুপারিশ করছে, তাদের মুখোশ খোলা দরকার। শুধু আমলাদের কথায় না চলে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা।
অশ্বিনী মহাজনের মতে, বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার যখন ৪৩০০০ কোটি ডলার, তখন বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার কোনও যুক্তিই নেই। ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো-র মতো দেশগুলি ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ঋণ নিতে গিয়েই এখন তাদের ঋণের পরিমাণ ৩০ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে। সেই ধার মেটাতে আরও ধার করতে হচ্ছে। কারণ কম সুদে ধার মিললেও ডলারের দাম বেড়ে গেলে সুদের বোঝাও বেড়ে যাবে। ডলারে ধার নিলেও তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকায় বদলে নিতে হবে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে।
তবে মহাজনের আগেই অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ায় প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকি কোথায়? ধরা যাক, ধার নেওয়ার সময় ডলারের দাম ছিল ৫০ টাকা। সেই হিসেবে এক ডলার ধার করলে ৫০ টাকা শোধ করার দায়। কিন্তু ডলারের দাম যদি কোনও কারণে ৭০ টাকায় পৌঁছে যায়, তা হলে ৭০ টাকাই শোধ করার দায় এসে পড়বে। অর্থনীতিবিদরা এ-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এই পথে হেঁটেই আশি ও নব্বইয়ের দশকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। ১৯৯৭-তে তাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অর্থনীতিতে ‘এশিয়ার বাঘ’ বলে পরিচিত দেশগুলিও একই কারণে সঙ্কটে পড়ে।