মেট্রোয় উঠতে গিয়ে পুরো শরীর ঢোকাতে পারেননি। বন্ধ দরজার ভেতর শুধু হাত আটকে ছিল যাত্রীটির। কিন্তু মেট্রোর দরজার ফাঁকে কিছু আটকে গেলে দরজা বন্ধ হলেও সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে আবার বন্ধ হওয়ার কথা। দরজার মধ্যে কিছু আটকে পড়লে তো ট্রেন চলারই কথা নয়। তবু কেন এমন ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটল? এই একটি প্রশ্নের আড়ালেই লুকিয়ে রয়েছে আরও অনেক প্রশ্ন। সে প্রশ্ন যেমন গাফিলতি নিয়ে, তেমনই যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়েও।
একটি দরজাও বন্ধ না হলে তো মেট্রোর মোটরে বিদ্যুৎ সরবরাহ হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে ‘রিলে’র যান্ত্রিক ত্রুটির দিকেই আঙুল তুলছেন মেট্রো কর্তাদের একাংশ। ছাড় দেওয়া যাচ্ছে রেলপুলিশের গাফিলতিকেও। দরজা বন্ধ করার পরে গাড়ি ছাড়ার সঙ্কেত দেওয়ার আগে গার্ডের দেখে নেওয়ার কথা কেউ আটকে আছেন কি না। তাঁর কামরার কাছে প্ল্যাটফর্মে সিসি ক্যামেরার মনিটর আছে। প্ল্যাটফর্মে থাকা রেল পুলিশেরও নজর রাখার কথা। তাঁরাও কোনোরকম সংকেত আদৌ দিয়েছিলেন কিনা, তা জানা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ট্রেন চলতে শুরু করার পরে আরপিএফ এবং উপস্থিত অন্যরা চিৎকার করতে শুরু করেন। কিন্তু এই নতুন রেক খুব দ্রুত গতি বাড়ায়। ফলে থামতে সময় লেগেছে।
চেন্নাইয়ের ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে তৈরি রেকগুলির গুণমান নিয়ে গোড়া থেকেই প্রশ্ন আছে। যার মধ্যে দরজার সমস্যাও ছিল। সে সব সারাতে গিয়ে প্রায় দেড় বছর ফেলে রাখা হয় রেকগুলি। সম্প্রতি তিনটি রেক চালানো হচ্ছে। যাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, বোতাম টেপার পরেও ট্রেন থামেনি। মেট্রো কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, অ্যালার্ট বোতাম টেপার পরেও ট্রেন থামাতে একটু সময় লাগবেই। এ ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেই ট্রেন থামানো হয় বলে তাঁদের দাবি।
এই ঘটনাটির পর একের পর এক অভিযোগ তুলছেন ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। কেন কাজ করেনি ডোর-সেন্সর? যাত্রীর হাত আটকে রয়েছে জেনেও কেন ট্রেন থামাননি চালক? প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় ৬০ মিটার পর্যন্ত ঘষটাতে ঘষটাতে গেছে দেহ! এইরকম চলতে থাকলে যাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়? শনিবারের সন্ধ্যায় কলকাতা মেট্রোয় এই দুর্ঘটনার পরে ঘাতক মেট্রোর চালক ও গার্ডকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হলো।
কী কারণে মানুষের হাত আটকে থাকা সত্ত্বেও কাজ করেনি দরজার সেন্সর, কী কী ঘাটতি রয়েছে মেট্রোর রেকগুলিতে, সেটা খতিয়ে দেখতে চেন্নাই থেকে কলকাতা রওনা দিয়েছে বিশেষজ্ঞের দল। ঘটনার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেট্রো রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন তিনি বলেন, “মেট্রো রেলে এমন ঘটনা প্রথম। মেট্রো কর্তৃপক্ষের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে তদন্ত কমিটি তৈরি করা হয়েছে। দোষ প্রমাণিত হলে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।”
প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীদের কথায়, এ দিন পৌনে সাতটা নাগাদ পার্ক স্ট্রিট থেকে কবি সুভাষগামী মেট্রোয় ওঠার চেষ্টা করছিলেন সজলবাবু। মেট্রোতে ভিড় থাকায় তিনি চটজলদি উঠতে পারেননি। সামনের দিক থেকে মেট্রোর তৃতীয় কামরায় ওঠার সময়েই দরজা বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। মরিয়া হয়ে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন দরজার দিকে। বাকি যাত্রীদের কথায়, সম্ভবত তাঁর ধারণা ছিল হাতের স্পর্শ পেলেই স্বয়ংক্রিয় দরজা ফের খুলে যাবে। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং দুই দরজার মাঝে হাত আটকানো অবস্থাতেই মেট্রো চলতে শুরু করে দেয়। পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করেন সজল বাবু।
এদিন পার্ক স্ট্রীট মেট্রো স্টেশনে মর্মান্তিক এই ঘটনা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন যাত্রীরা। তাঁদের অধিকাংশের অভিযোগ, কখনও রেক বিকল, কখনও ধোঁয়া, যাত্রীদের নিরাপত্তা নেই। এক জন যাত্রীর হাত ভিতরে থাকা অবস্থায় এতটা পথ মেট্রো চললই বা কী করে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, গেট বন্ধ না হওয়ার কোনও সিগন্যালই বা কেন মেট্রোর চালক পেলেন না? প্ল্যাটফর্মে থাকা আরপিএফ কর্মীরাও জরুরিকালীন কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি কেন, উঠেছে সেই অভিযোগও।
দুর্ঘটনার পরেই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যান কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। ডিসি (দক্ষিণ) মিরাজ খালিদের নেতৃত্বে পুলিশ পৌঁছয় ঘটনাস্থলে। পৌঁছয় দমকল বাহিনী। মেয়র বলেছেন, “কী ভাবে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মেট্রোর চালক ও গার্ডকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হবে।” ঘটনার পরেই প্রতিক্রিয়া জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আগে মেট্রোর জন্য আলাদা জোন তৈরি করেছিলাম। এখন আর রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। নতুন একটাও প্রকল্প করেনি ওরা। কলকাতায় মেট্রো রেল সবচেয়ে অবহেলিত।”