‘আমাদের সব মৃতদের নামে আমি শাস্তি দাবি করছি/ যারা চৌরাস্তায় গুলি করে হত্যা করেছে আমার ভাইকে’ – এই অমর পংক্তির স্রষ্টা যিনি, আজ ১২ জুলাই সেই বিপ্লব ও প্রেমের কবি, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কবি, সর্বোপরি শোষিত মানুষের কবি পাবলো নেরুদার ১১৫ তম জন্মদিন। ১৯০৪ সালে আজকের দিনেই চিলির পাররাঙ্গল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তবে পাবলো নেরুদা নামে খ্যাত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম কিন্তু নেফতালি রিকার্ডো রেয়েস বোসোয়াল্টো। কৈশোরে তিনি ওই ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়ে তার নিচে লিখে দিতেন, ‘পাবলো নেরুদা’। আসলে তাঁর লেখালেখি নিয়ে বাবার অপছন্দের জন্যই চেক রিপাবলিকের কবি জাঁ নেরুদার অনুসারে পাবলো নেরুদা ছন্দনাম গ্রহণ করেন তিনি। যা পরে আইনি বৈধতা পায়।
নেরুদার বাবা ছিলেন একজন রেল শ্রমিক আর মা ছিলেন শিক্ষয়ত্রী। নেরুদার জন্মের ২ মাসের মধ্য তাঁর মা মারা যান। বাবাও বেশী দিন বাঁচেননি। সৎ মায়ের কাছে কেঁটেছে শৈশব। তবে সেই যে ১৯২০ সালে ষোল বছর বয়সে পত্রিকায় নেরুদা নাম নিয়ে তাঁর লেখালেখি শুরু, তারপর এক স্বপ্নের উড়ান দেয় তাঁর কলম। যার ফলস্বরূপ ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ক্রেপুস্কুলারিও অর্থাৎ গোধূলি লগ্নের গ্রন্থ। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হলো ভেইন্তে পোয়েমাস দে আমোর ই উনা কানসিওন দেসেসপেরাদা অর্থাৎ ‘কুড়িটা প্রেমের কবিতা ও একটি নিরাশার গান’। মূলত এই বই দুইটির মাধ্যমেই সাহিত্য জগতে ঝড় তোলেন নেরুদা। যার প্রতিটি পাতায় পাতায়, ছত্রে ছত্রে ছিল প্রেম-ভালবাসা ও যৌবনের আবেদন। এ নিয়ে অনেকে তাঁর প্রশংসা করলেও, সমালোচনাও কম হয়নি। বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয় বই দুটির।
এরপর ১৯২৭ সালে সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে আর্থিক অনটনের কারণে রেঙ্গুনে (বার্মা) চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবে সরকারী চাকরিতে যোগ দেন নেরুদা। পরবর্তী সময়ে একই দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন সিলোনের কলোম্বোয়, বাটাভিয়ায় (জাভা) ও সিঙ্গাপুরেও। ১৯৩৪ সালে তিনি চিলির রাষ্ট্রদূত হয়ে স্পেনে যান। জাভায় সাক্ষাৎ পান মারিকা অ্যান্টোনিয়েটা হ্যাগেনার ভোগেলসাং নামে এক ডাচ তরুণীর। পরে তাঁকেই বিয়ে করেন। তবে ১৯৩৬ সালেই তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এবং এরপর নেরুদার সম্পর্ক গড়ে উঠে দেলিয়া দেল কাররিল নামে এক নারীর সাথে। এই সময়ই স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এবং পারিতে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠন গড়ে তোলেন এবং নানা স্থানে বক্তৃতা দেন নেরুদা।
১৯৪২ সালে নেরুদা রচনা করেন ‘কান্তো আ স্তালিনগ্র্যাদো’ নামে একটি কবিতার বই। ১৯৪৩ সালে ‘নুয়েভো কান্তো দে আমোর আ স্তালিনগ্রাদো’ নামে আরেকটি বই রচনা করেন। এ দুটো কবিতায় তার কমিউনিস্ট চেতনা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। এ সময় তিনি চিলির রাষ্ট্রদূত হয়ে মেক্সিকোতে ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৪ মার্চ আতাকামা মরু অঞ্চলের আন্ডোফাগাস্তা ও তারাপাকা প্রদেশের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সিনেটর নির্বাচিত হন নেরুদা। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৫৩ সালে পান নেরুদা স্তালিন শান্তি পুরস্কার। তবে ওই বছরই স্তালিন মারা যাওয়ায় তাঁকে নিয়ে এক শোকগাঁথা রচনা করেন নেরুদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিউবার ফুল গেনসিও বাতিস্তা ও পরে ফিদেল কাস্ত্রোর প্রশংসা করেও কবিতা লেখেন তিনি।
শুধু তাই নয়। ১৯৬৯ সালে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি নেরুদাকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য মনোনীত করে। পরে সম্মিলিত বামফ্রন্ট সালভাদোর আলেন্দেকে সর্বসম্মত প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করলে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন নেরুদা। ১৯৭০ সালে আলেন্দে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়। আলেন্দে নেরুদাকে ফ্রান্সে চিলির রাষ্ট্রদূত করে পাঠান। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালে আসে সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান নেরুদা। ঠিক তাঁর দু’বছর পর ১৯৭৩ সালে প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়লে সে বছরই ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সান্তিয়াগোর সান্তা মারিয়া ক্লিনিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নেরুদা। তবে তিনি চলে গেলেও, পৃথিবীর সাহিত্য ভাণ্ডারে চিরদিনের জন্য অমর হয়ে থাকবে তাঁর ৬৫টি কাব্যগ্রন্থ। একদিন হয়ত তাঁর স্মৃতিও ভুলে যাবে মানুষ। কিন্তু পড়ে থাকবে তাঁর ‘অনুস্মৃতি’। সাধে কি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁকে বলেছেন, ‘যে কোনও ভাষায় বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি।’