সাহিত্য জগৎ ‘ঠাকুর’ বলতে যেমন রবীন্দ্রনাথকে চেনেন, তেমনি দেশের বিনোদন জগতে ‘ঠাকুর’ বলতেই ভেসে ওঠে তাঁর মুখ। তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক ক্ষণিকের তারা। মাত্র ৪৭ বছরের আয়ু নিয়ে জন্মেছিলেন। আর তাতেই ‘শোলে’, ‘ত্রিশূল’, ‘বিধাতা’, ‘আঁধি’, ‘সিলসিলা’, ‘কোশিশ’, ‘নায়া দিন নায়ি রাত’, ‘দাস্তাক’, ‘অনামিকা’র মতো একাধিক দুর্দান্ত ছবি দিয়েছেন সঞ্জীব কুমার। আজ এই অবিস্মরণীয় অভিনেতার ৮১ তম জন্মদিন।
সঞ্জীব কুমারের আসল নাম হরিহর জেথালাল জরিওয়ালা। মুম্বাই সিনেপাড়ার ঘনিষ্টজনেরা তাকে হরিভাই বলে ডাকতেন। জন্ম ১৯৩৮ সালের ৯ই জুলাই এক গুজরাতি পরিবারে। পরিবারের সঙ্গে শৈশবের বেশ কয়েক বছর কাটে সুরাটে। পরবর্তীতে মুম্বাইয়ে স্থায়ী হয় তাদের পরিবার। তিনি একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক স্কুলে অভিনয় শেখেন।
তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয় মঞ্চে। প্রগতিশীল শিল্পী সংগঠন আইপিটিএর সদস্য ছিলেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটারেরও সদস্য হন। মঞ্চেও তিনি নিজের প্রকৃত বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করতে পছন্দ করতেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি আর্থার মিলারের মঞ্চনাটক ‘অল মাই সনস’ এ একজন বয়স্ক মানুষের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন।
চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমারের অভিষেক ঘটে ১৯৬০ সালে ‘হাম হিন্দুস্তানি’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৫ সালে ‘নিশান’ ছবিতে তিনি প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দীলিপ কুমারের সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’ ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি পান। ১৯৬৯ সালে ‘শিকার’ ছবিতে পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার জিতে নেন।
১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘খিলোনা’ ছবিতে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যাক্তির ভূমিকায় তার অভিনয়ও সাড়া ফেলেছিল। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় সুপার হিট ছবি ‘সীতা অউর গীতা’। এতে হেমা মালিনির বিপরীতে অন্যতম নায়ক ছিলেন সঞ্জীব। এ ছবির সুবাদে সফল তারকা হিসেবে বক্স-অফিসেও স্বীকৃতি পান। এরপরই রোমান্টিক নায়ক হিসেবে নির্মাতাদের কাছে তার চাহিদা সৃষ্টি হয়।
১৯৭৩ সালে রোমান্টিক থ্রিলার ‘অনামিকা’ তাকে বেশ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন জয়া ভাদুড়ী। ১৯৭৩ এ মুক্তি পাওয়া ‘মাঞ্চালি’ ছবিটিও ব্যবসা সফল হয়। তবে সঞ্জীব পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করতেই বেশি ভালবাসতেন। সে কারণেই রাজেশ খান্না-মুমতাজ জুটির ‘আপকি কসম’ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেন এবং প্রশংসিত হত।
বলিউডের স্বনামধন্য পরিচালক তথা গীতিকার গুলজার সঞ্জীবের অভিনয় প্রতিভার কদর করতেন। তিনি ‘কোশিশ’ ছবিতে সঞ্জীবকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। দুজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবন ও সম্পর্ক নিয়ে সিনেমাটিতে সঞ্জীবকে তরুণ ও বৃদ্ধ দুই বয়সেই দেখানো হয়। ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার আসরে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান এবং জিতে নেন বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড।
সে বছর সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার না পেলেও ১৯৭৬ সালে ‘আঁধি’ (১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) ছবিতে অভিনয়ের জন্য সে পুরস্কার অর্জন করে নেন। গুলজার পরিচালিত ‘আঁধি’ সিনেমায় এক রাজনৈতিক নেত্রীর অখ্যাত স্বামীর ভূমিকায় সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব। গুলজারের পরিচালনায় মোট নয়টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
তবে ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শোলে’তে ঠাকুর চরিত্রটি তার নাম হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিয়েছে। সেসময় তার বয়স ছিল ৩৭ বছর। অথচ তিনি মধ্যবয়সী ঠাকুরের ভূমিকায় ছিলেন সম্পূর্ণ মানানসই। পরের বছর ‘ডমরু’ ছবিতে তিনি ছয় সন্তানের জনক ষাট বছর বয়সী এক বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৭ সালে ফিল্মফেয়ার আসরে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান ‘অর্জুন পণ্ডিত’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে।
কেবল গম্ভীর চরিত্রে নয় কমেডিতেও ছিলেন অসামান্য। শেক্সপিয়রের নাটক ‘কমেডি অব এররস’ অবলম্বনে নির্মিত ‘আঙ্গুর’ ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে তার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। এ ছবিও তাকে ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন এনে দেয়।
‘দেবতা’, ‘নামকিন’, ‘ইয়ে হ্যায় জিন্দেগি’, ‘পতি পত্নী অউর ও’ – এমন অনেক ছবিতে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন তিনি।
সঞ্জীব কুমার দু’বার সেরা অভিনেতা এবং একবার পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার পেয়েছেন আর ১১ বার সেরা অভিনেতা এবং তিনবার পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। নায়ক হিসেবে সার্থক হলেও তার মূল আকর্ষণ ছিল বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করার প্রতি। আর তাই তাকে হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে সার্থক চরিত্রাভিনেতা বললে ভুল বলা হবে না।
সঞ্জীব কুমার হৃদপিণ্ডে ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিলেন। তার পরিবারের অনেক সদস্যই ৫০ বছরের আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ কারণে সঞ্জীবের ভয় ছিল তিনিও বেশিদিন বাঁচবেন না। বাস করতেন ভাড়া বাড়িতে। নিজস্ব বাড়ি কেনার কথা উঠলে অন্তরঙ্গদের বলতেন, ‘দু’দিনের দুনিয়া। জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই স্বল্পদিনের জীবনে আর স্থায়ী বাড়ি করে কি হবে।’
তিনি বিয়েও করেননি। অভিনেত্রী সুলক্ষণা পণ্ডিতের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। হেমা মালিনিকেও তিনি একতরফাভাবে ভালবাসতেন বলে সে সময়ে ফিল্মিমহলে গুঞ্জন ছিল। প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাইপাস অপারেশন করান। ১৯৮৫ সালের ৬ই নভেম্বর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ ছবি হল ১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্রফেসর কি পাড়োশান’।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত