সবদিক দিয়ে তলিয়ে না ভেবে, দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা না করেই এবার বেশ বড়সড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলল মোদী সরকার। বাজেটে এ কথা স্পষ্ট যে, এবার বিদেশি লগ্নিকারীদের থেকে বিদেশি মুদ্রাতেই ঋণ নেওয়ার পথে হাঁটতে চাইছে কেন্দ্র। পরে যার ফল ভুগতে হতে পারে দেশকে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালে দেশে বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ার প্রায় শূন্য, আবার জ্বালানি আমদানি করার ডলারও চাই। সেই কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের কাছে সোনা বন্ধক রেখে কেন্দ্রকে ঋণ নিতে হয়েছিল। কিন্তু তখন আন্তর্জাতিক বাজারে বন্ড বা ঋণপত্র ছেড়ে বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার পথে হাঁটেননি নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহ। আবার, ২০১৩-তেও মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নীতির ফলে দেশের বাজারে যখন ডলারের টানাটানি। ৭০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ডলারের দাম। সেই সময়েও মনমোহন সরকার বিদেশি মুদ্রায় বা ডলারে ঋণ নেওয়ার ঝুঁকি নেয়নি।
এই সবের পিছনে কারণ ছিল একটাই। আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তার ধাক্কায় যদি ডলারের দাম আচমকা তুঙ্গে ওঠে, তা হলে সেই অনুযায়ীই টাকা শোধ করতে হবে। তবে তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে মোদী সরকার কিন্তু বিদেশি লগ্নিকারীদের থেকে বিদেশি মুদ্রাতেই ঋণ নেওয়ার কথা ভাবছে। শুক্রবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বাজেটে এই ঘোষণা করেছেন। আসলে মোদী জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের বহর ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের বাজেট বরাদ্দের ২৩.৭ শতাংশই চলে যাচ্ছে সুদ মেটাতে। তাই এই মুহূর্তে কেন্দ্রের লক্ষ্য হল, কম সুদে ঋণ নেওয়া।
কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার ভাল দিক যেমন রয়েছে, তেমনই প্রবল ঝুঁকিও রয়েছে। ঝুঁকি কোথায়? ধরা যাক, ধার নেওয়ার সময় ডলারের দাম ছিল ৫০ টাকা। সেই হিসেবে এক ডলার ধার করলে ৫০ টাকা শোধ করার দায়। কিন্তু ডলারের দাম যদি কোনও কারণে ৭০ টাকায় পৌঁছে যায়, তা হলে ৭০ টাকাই শোধ করার দায় এসে পড়বে। অর্থনীতিবিদরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই পথে হেঁটেই আশি ও নব্বইয়ের দশকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। ১৯৯৭-তে তাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অর্থনীতিতে ‘এশিয়ার বাঘ’ বলে পরিচিত দেশগুলিও একই কারণে সঙ্কটে পড়ে।
সরকারি সূত্রের দাবি, মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যন কম সুদে বিদেশ থেকে ধার নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তবে অর্থনীতিবিদ অজিত রাণাডের মতে, এই ভাবনা নানা দিক থেকে বিপজ্জনক। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ওঠানামার সঙ্গে দেশের ঋণ শোধ করার দায়ও ওঠানামা করবে। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দেশের বাজারেও সুদ ওঠানামা করতে পারে। আর শুধু দেশের বাজার থেকে ধার নেওয়ার সীমাবদ্ধতা থাকলে, সরকারের ঘাটতি বাড়ানো বা ঋণ নেওয়ার ওপরেও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ থাকে। কারণ দেশের বাজার থেকে সরকার যথেচ্ছ ঋণ নিতে পারে না। কিন্তু বিদেশের বাজারে চাইলে সরকার অনেক বেশি সুদ গুনেও ধার করে ফেলতে পারে।
আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর সি রঙ্গরাজনের বক্তব্য, ‘আমরা নব্বইয়ের দশকে শুরুতে এ নিয়ে আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম, ও পথে না হাঁটাই ভাল। তা ছাড়া, দেশে বিদেশি মুদ্রার যদি টানাটানি নাথাকে, তাহলে ও পথে হাঁটার কারণ নেই।’