দলের কর্মীদের কাটমানি খাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুলতেই তা নিয়ে গ্রাম-শহরে প্রবল হইচই। খবরের কাগজ, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটমানি নিয়ে অভিযুক্তদের বাড়িতে হামলা, মারধোর, ঘেরাও শুরু হয়েছে। মারাও গেছেন একজন। বেশ কদিন ধরে ভাবছিলাম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ এমন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন কেন? খবরের কাগজের বন্ধুদের থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দাদা ও বন্ধুদের সঙ্গে বহু আলোচনাতেও এর কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে মুখ্যমন্ত্রী এই কথাটা খুব হিসেব করেই বলেছেন। এ কথা বলার এক গভীর কারণ রয়েছে।

কর্মসূত্রে তার সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে এটুকু জানি আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর কোন মন্তব্যই হঠাৎ বা আলটপকা নয়, কোন কথাই তিনি না ভেবে বলেন না। নিজের অভিজ্ঞতায় আমি বারবার এর প্রমাণ পেয়েছি। দলীয় কর্মীসভায় কাটমানি খাওয়ার কথাটা তিনি খুব ভেবেচিন্তেই বলেছেন। বিষয়টি রাজনৈতিক তাই আমার ভাবনাচিন্তা রাজনৈতিক কর্মীদের কাটমানি নেওয়াতেই আটকে ছিল। কিন্তু গতকাল তিনি বিধানসভায় সাংবাদিকদের কাটমানি খাওয়ার প্রসঙ্গ তুলতেই বুঝতে পারলাম সমস্যাটা আরও ব্যাপক এবং এই অন্যায়ের গভীরতা আরও বেশি। সাংবাদিকরা গণতন্ত্রের স্তম্ভ, তাদের বিরুদ্ধেই যখন কাটমানির অভিযোগ ওঠে তখন গোটা সিস্টেমটাই ঠিকঠাক চলছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়।
বিধানসভায় রাজ্যপালের বক্তব্যের জবাবী ভাষণ দিতে গিয়ে দিদি সাংবাদিকদের নানারকম ভাবে কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। আমি নিজে দীর্ঘদিন আজকাল ও আনন্দবাজারে চিত্রসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। আমার পেশার লোকজনদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ তুলছিলেন তিনি। সত্যি কথা বলতে কী শুনতে খারাপই লাগছিল,একটু অবাকও হয়েছিলাম। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখেই বুঝতে পারলাম তিনি মোটেই ভুল কিছু বলেননি। বরং ঢিলটি মেরেছেন একেবারে ঠিক জায়গায়।
৪০ বছরের সাংবাদিক জীবনের নানা ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই ঘটনাগুলোর নিরিখেই মুখ্যমন্ত্রীর কথাটাকে নিয়ে ভাবছিলাম। ঘুষ নেওয়া নিয়ে ইংরেজিতে একটা কথা চালু আছে – ক্যাশ অর কাইন্ড। আমার মতে শুধু নগদই নয়, কোন কিছু করে দেওয়া বা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে কোন সুবিধা বা সুযোগ নেওয়াও আদতে কাটমানি নেওয়ার মতই অপরাধ। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমি একেবারে একমত। সোজা কথাটা তিনি সোজাভাবে বলেছেন। দিদির কথার সূত্র ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আমি নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই।
তখন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু। আনন্দবাজারের স্বনামধন্য এক সাংবাদিক ঠিক করলেন তিনি কাগজের কিছু ঘনিষ্ট সাংবাদিকদের নিয়ে একসঙ্গে থাকবেন। যদিও এই সাংবাদিকদের পারিবারিক বাসগৃহ আছে, কিন্তু সেখানে তারা কেউ থাকেন না। আমার অনেক বন্ধুই নিজেদের বাড়ি থাকা সত্বেও ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। হঠাৎ একদিন অফিসে এসে শুনি কিছু সাংবাদিকদের নিয়ে তিনি সল্টলেকে একটা জমি পাওয়ার জন্য জ্যোতিবাবুর কাছে দরবার করতে গিয়েছেন। কিছুদিন পর জ্যোতিবাবু সল্টলেকে একটা জমিও দিয়ে দিলেন। প্রথমদিকে আমি এই বাড়ির চক্করে ছিলাম না। পরে তিন চারজন ঐ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর পর আমার জায়গা হয়।
সে সময় স্টেটসম্যান এনিয়ে খবরও করেছিল। সেখানে লেখা হল আনন্দবাজারের কিছু সাংবাদিক বেআইনিভাবে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছ থেকে জমি পেয়েছেন। আমার মনে হয়, সরাসরি টাকা না নিলেও এটা কাটমানি নেওয়ার সমতুল্য অপরাধ। আমরা সাংবাদিকরা যে ধোয়া তুলসীপাতা নয়, তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে কাজেই সত্যিটা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল।
আরেক স্বনামধন্য সাংবাদিককে দেখেছি ২০০১ সালে শিলিগুড়ি সার্কিট হাউসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ইন্টারভিউ করতে গিয়ে গুরুসদয় রোডের বিখ্যাত চাইনিজ রেস্তরাঁর বার লাইসেন্স পাওয়ার জন্য তদ্বির করতে। এই অন্যায় কাজের এক দুর্ধর্ষ যুক্তিও খাড়া করেছিলেন তিনি। বুদ্ধবাবুকে বলেছিলেন, যেখানে বার লাইসেন্স পেতে সাত মাস লাগে সেখানে ভালো ইন্ডাস্ট্রি চলবে কী করে? বুদ্ধবাবু কলকাতায় ফেরার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই রেস্তরাঁর বার লাইসেন্স হয়ে যায়। খবরের কাগজে কাজ করার সময় দেখেছি সেই রেস্তরাঁ থেকে বেশ কিছু উচ্চস্তরের সাংবাদিকদের বাড়িতে জন্মদিনের খাবার যেত। এসবও কাটমানি খাওয়ার মতই অপরাধ। এসব তো আমাদের পেশার লোকেরাই করে!
এক চিত্রসাংবাদিককে জানি, নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়ার সময় তার বাড়ির সব জিনিস প্রিজনভ্যানে গিয়েছিল। তিনি আবার তা গর্ব করে বলতেনও। সরকার বাড়ির না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয় কাগজে কাজ করার সময় দেখতাম, দুজন সাংবাদিককে মারুতি ভ্যান অফিসে নামিয়ে দিত, ফেরার সময়ও মারুতি আসতো বাড়ি পৌঁছে দিতে সেসময় তার কোন গাড়ি ছিল না। ফ্ল্যাট, ছেলেমেয়ের অ্যাডমিশন, স্ত্রীর চাকরি, বিয়ে, জন্মদিনের পার্টি থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধশান্তি সব ব্যাপারে প্রভাব খাটিয়ে নামমাত্র টাকায় সেরে ফেলাটা যেন একটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস। বহু সাংবাদিককেই তা করতে দেখেছি। এই কাগজের সম্পাদক থেকে শুরু করে একশ্রেণীর তথাকথিত বিখ্যাত সাংবাদিকদের সুবিধা নেওয়ার কথা বলতে গেলে দেশের মত একটা পেল্লায় পুজোসংখ্যা হয়ে যাবে। এসবও কাটমানি খাওয়ার তুলনায় কম অপরাধ নয়। ক্যাশ না হোক কাইন্ড তো আছে। এখানে একটা কথা জোর গলায় বলতে পারি চিত্রসাংবাদিকরা সাধারণভাবে এইসব সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকতেন।
এখন তো সারা দেশের মিডিয়া রাজনৈতিক দলের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। কোথায় সেই নির্ভীক সাংবাদিকতা? না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয় , ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায় না সবই তো সরকারি বিজ্ঞাপন নির্ভর। যে সরকার বিজ্ঞাপন দেবে তারা কি তাদের বিরুদ্ধে কোন খবর করতে দেবে? শুধু বাংলা নয়, দিল্লির কাগজেও এখন বিজেপির দাপট। আমরা সাংবাদিকরা এখন কি প্রকৃত সাংবাদিকতা করতে পারি? চাটুকারিতা করা ছাড়া আমাদের আর কী কিছু করার আছে?
অনেক কথা লিখে ফেললাম। অগ্রজ ও অনুজ সাংবাদিকদের কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন। তবে এখন আমাদের নিজেদের পেশাগত দায়বদ্ধতা রক্ষা করার সময় এসেছে। এটা করতেই হবে, নইলে আঘাত আসবে আমাদের পেশার ওপর। মুখ্যমন্ত্রী নিজে যদি তার দলীয় কর্মীদের এভাবে তিরস্কার করতে পারেন তাহলে আমাদের নিজেদের সংশোধন করতে বা কোন ফাঁদে না পড়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে অসুবিধা কোথায়?
মুখ্যমন্ত্রী সেদিন বিধানসভায় একটা কথা বলেছিলেন সাংবাদিকদের কাজ সঠিক খবর পরিবেশন করা, সত্য খবর জানানো। কিন্তু আমরা কি সে কাজ করতে পারছি? একটু ভেবে দেখবেন। কাটমানি বা ক্যাশ অর কাইন্ডের কানাগলি থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা আমাদের নিজেদেরই খুঁজতে হবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত